প্রথম দেখা পার্বত্য জেলা  রাঙামাটি  


পাহাড়ের বনপথে ঘুরে বেড়াব- কত-না অচেনার সাথে পরিচয় হবে, অতঃপর আন্তরিকতা গড়ে উঠবে। ভাবতাম, অচেনা বন্ধুকে গানের ভাষায় শুনাব : ‘এই বন ছায়া ওই বাঁকা পথ/ এরা শুধু হায় জানে… সেদিন আমায় কী বলেছ তুমি গানে’- গানের একথাগুলো।

১৯৬৮ সালের শেষদিকে একখানা পত্র এলো আমার বাড়ির ঠিকানায়। প্রেরক-  সুমনা চাকমা, রাঙামাটি, পার্বত্য চট্টগ্রাম। খামখানি খুলে দেখলাম, সুমনা চাকমা আমার সাথে বন্ধুত্ব করতে চায়। আমাদের মধ্যে পত্রবিনিময় চলতে লাগল। একবার সুমনা লিখল : দাদা, আসুন না আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে। এখানে এলে দেখবেন-  অরণ্য, পাহাড়, ঝরনা, জলপ্রপাত…। দু-নয়ন ভরে দেখবেন, থাকবেন আমাদের বাড়িতেই। কর্ণফুলির তীরেই আমাদের বাড়ি। বাবার নাম দেবাশীষ চাকমা। বন্ধু সুমনা চাকমার ডাকে পাহাড়িয়া রাঙামাটিতে বেড়াতে গিয়ে (১৯৭০ সালে) মনের কোণে উঁকি দিয়েছিল- ‘এই রাঙামাটির দেশে এই গাঁয়ের পথের ধারে আমার মনের মানুষ এলো কী তাই আজ মন ভোলাতে…’ গানের একথাগুলো। সেটাই ছিল আমার প্রথম ভ্রমণ রাঙামাটিতে।

 

রাঙামাটি’র পাহাড়ি পথ ধরে কখনো বাস উপরে, কখনো-বা নীচে নামছে- কেমন জানি ভয় ভয় লাগল। তবুও আনন্দ। পাহাড়ের গায়ে গায়ে ঝরনা দেখে শুধুই তাকিয়েছিলাম। তখন আর বয়স কত হবে হয়ত প্রায় আঠারো ।

 

বাস এসে থামল বিকাল চারটায়। দেখি বাসস্ট্যান্ডে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অপরূপ সুন্দরী দেখতে মনে হলো চিত্রনায়িকা যমুনা দেবীর মতো। হাতে একটি ‘গোলাপ ফুল’। একে অপরকে চিনতে অসুবিধা হয়নি। কারণ, আগেই আমরা ফটো দেওয়া-নেওয়া করেছিলাম।

 

সুমনার জিজ্ঞাসা, আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো? একটু থেমে- ‘না’। ভেবেছিলাম আপনি বাসস্ট্যান্ডে আসবেন-ই। সুমনার মুখে হাসি। দেখি ওখানে একটি রিকশাও নেই। সুমনার মুখে শুনলাম, পাহাড়ের উঁচুনীচু পথ বলে রাঙামাটিতে কোনো রিকশা চলাচল করে না। হঠাৎ দেখি এক উপজাতি মহিলার মুখে চুরুট। তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সুমনা হেসে- পাহাড়ি মহিলাদের অনেকেই চুরুট টানে। এটা এখানে অহরহ দেখতে পাবেন। স্কুটারে উঠে দুইজনে পাশাপাশি বসলাম। মিনিট পনেরো পরে কর্ণফুলির কাছে ওদের কাঠের ঘরের কাছে গিয়ে পৌঁছালাম। কর্ণফুলি নদীকে আবার হ্রদও বলা হয় ওখানে। দেখা যায়- ওই যে পাহাড় মনে হয় পাহাড় যেন আকাশ ঢেকে দিচ্ছে।

 

রাঙামাটি  

 

পরদিন সুমনা চাকমার সাথে কর্ণফুলির তীরে এলাম। এবার আমাদের সাম্পানে চড়ে যাত্রা শুরু শুভলঙের দিকে। এর আগেই সুমনার মুখে শুনেছিলাম- শুভলঙের সৌন্দর্যের কথা। চারদিকে চোখধাঁধানো প্রাকৃতিক রূপ। সবুজ রঙের পাহাড়- গাছে গাছে ছেয়ে আছে সর্বত্র। এখানে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো উপত্যকা। কাকের চক্ষুর মতো জল, দুই পাহাড়ের মধ্যে স্রোতহীন ছোটো ছোটো ঢেউয়ে বয়ে যাওয়া নদী বার বার অবিরল ঝরছে শুভলঙের পাহাড়ি ঝরনায়।

 

সাম্পানে বসে দেখছি পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য। দৃশ্যের পর দৃশ্য। মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্যকে ঢেলে দিয়ে বিধাতা অবর্ণনীয় রূপে সাজিয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রামকে। ১ ঘণ্টা পরে সাম্পান এসে পৌঁছাল শুভলঙে। সুমনা একটু হেসে- দাদা, ওই যে দেখুন দুই পাহাড়ের মধ্য দিয়ে গভীর নদীর জল বয়ে গেছে। শুভলং নেমেই দেখলাম উঁচু উঁচু পাহাড়ের পাদদেশে রয়েছে পাহাড়ের মতো বড়ো বড়ো মাটির ভাঁজ। মনে হলো পাথরগুলো এমনভাবে সাজানো রয়েছে যেন কেউ কোনো প্রয়োজনে এভাবে সাজিয়েছে। দেখলে মনে হয় কোনো একসময় এখানে সভ্যতার ছড়াছড়ি ছিল। দুইজনে খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে দেখলাম, দুই পাহাড়ের দুপাশে অগণিত ঝরনায় ঝরছে অবিরল জলধারা। পাহাড় গড়িয়ে এ জল মিশেছে নদীর গহিন জলে। শুভলং ঝরনার জল স্পর্শ করে সুমনা এরই কয়ফোঁটা জল আমার হাতে দিল। তখন কী যেন আনন্দের পরশ খুঁজে পেলাম। ভাবনায় বার বার আচ্ছন্ন হলোÑ একটি নাম সুমনা চাকমা। পাহাড়ি মেয়ে ওর হৃদয়ে আছে প্রেম-ভালোবাসা। সুমনার মুখে হাসি- ‘ওই যে দেখুন দুটি বানর। ওরা মেতেছে চিরাচরিত ভালোবাসার বন্ধনে।’ তখন তো তাকিয়ে থাকা।

 

শুভলং থেকে রাঙামাটি ফিরে এলাম সন্ধ্যার আগেই। রাতে সুমনার বাবার সঙ্গে কথা হলো। উঁনি শুভলঙের বর্ণনাও দিলেন- ‘ওখানে ঝরনার কাছে গিয়ে দাঁড়ালে হরেক ভাবনা হৃদয়ের একোণ থেকে ওকোণে ছুটাছুটি করে হাজারো শব্দমালা নিয়ে অজানা আবেগে। কি তাই না?’

হাসলাম। উঁনি এবার জানালেন, শুনেছি ১৭৯৮ সালে ফ্রান্সিস বুকানন নামে একজন পর্যটক পার্বত্য চট্টগ্রাম ভ্রমণ করেন। রাঙামাটির সীতা পাহাড়, রাম পাহাড়, কাপ্তাই, রাইংখং, জয়ন্ত, শুভলং হয়ে সেই পাহাড়সমৃদ্ধ ঘন অরণ্যে বরকল পর্যন্ত এ সুযোগ্য পর্যটকের চরণ পড়েছে।

 

রাতে খাওয়াদাওয়া শেষে ঘুমাতে গিয়ে দেখি জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে কর্ণফুলি নদী। চাঁদের আলো যেন দোল খাচ্ছে নদীর গহিন জলে। তখন মনে পড়ল- ‘তুমি হইও চান্দের বন্ধু, আমি গাঙের পানি/ জোয়ারেভাটাতে হবে নিতুই জানাজানি…’ গানের একথাগুলো। দৃশ্য দেখে দেখে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরদিন আমরা নৌপথে লঞ্চে চলছি বাঘাইছড়ির দিকে। ওখানে রয়েছে আর্যপুর ধর্মোজ্জ্বল বনবিহার। রাঙামাটি থেকে ওখানে পৌঁছাতে প্রায় ৭ ঘণ্টা সময় লাগল। পাহাড়ি নদী হয়ে লঞ্চ চলার সময় দেখেছি -কর্ণফুলির কত রূপ। জলের রং এক এক সময় যেন ওখানে পালটায়। এ ভ্রমণে সুমনা, আমি এবং ওর চাচাতো বোন শিখা চাকমা ছিল। লঞ্চে পরিচয় হলো এক বৌদ্ধ ভিক্ষুর সাথে। আমাদের গন্তব্য বাঘাইছড়ির দিকে শুনে তিনি বললেন, বাঘাইছড়ির আর্যপুর ধর্মোজ্জ্বল বনবিহার দেখে আসতে ভুলবেন না কিন্তু। জানেন, একবার ভারতের গয়ায় গিয়ে ভিক্ষুদের মুখেও শুনেছি, বাঘাইছড়ির এই বনবিহারের কথা। তাদের বড়ো আগ্রহ এই আর্যপুর ধর্মোজ্জ্বল বনবিহার দেখার। পাসপোর্ট-ভিসার ঝামেলায় তারা আসতে পারছেন না। তখন মনে হলো ওখানে গেলে বুঝি দু-দণ্ড শান্তি খুঁজে পাওয়া যায়।

 

রাঙামাটি  

 

বাঘাইছড়িতে সুমনাদের এক কাকা থাকেন, তার বাড়িতেই আমরা উঠলাম। ওদিন বাইরে আর বের হলাম না। পরদিন ঘুম থেকে উঠতে বেলা ১২টা বেজে গেল। এখানে এসে যেদিকে তাকাই দেখি পাহাড় আর পাহাড়- কী অপূর্ব মনোলোভা বাঘাইছড়ি।

বিকেলে পায়ে হেঁটে চললাম আর্যপুর ধর্মোজ্জ্বল বনবিহার দেখতে। বনবিহারের কাছে আসতেই এক ভিক্ষু এসে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা বুঝি বিহার দেখতে এসেছ? একবাক্যে সবাই বললামÑ ‘হ্যাঁ’। বনবিহার দেখব বলেই তো এসেছি। কথাটা শুনে উনি বললেন, ‘খুবই নির্জন এলাকা। বনবিহার দেখে সন্ধ্যার আগেই যেন স্থান ত্যাগ কোরো।’ একটু অবাক হয়ে কেন! হাসলেন উঁনি। যা বলছি তাই শোনো। এই তো কিছুদিন আগে সন্ধ্যার পরে ওই যে বাঁশঝাড়গুলো দেখছ ওখানে ধবধবে সাদা কাপড় পরা এক রমণীকে ‘হিহিহি’ করে হাসতে দেখে কেমন জানি ভয় ভয় লাগল। বন বিহারে ঢুকল সুমনা ও শিখা। আমি বললাম, তোমরা দেখে নাও আমি একটু প্রকৃতির অপরূপ পার্বত্য চট্টগ্রাম দেখি। পাহাড়ের পাদদেশে ধানক্ষেত, আনারসের বাগান, পেঁপে গাছের ছড়াছড়ি- ওই দূরে পাহাড়িয়া গায়ে কত ফলফলাদির বাগান। সে দৃশ্য দু-নয়নে আনন্দের রং লাগিয়ে দিয়ে গেল। মনে হলো সেই ক্ষণে- ‘ঐ দেবদারু বন ঝুরুঝুরু আর চঞ্চল মন দুরুদুরু/ ওই মৌসুমি যায় কোন ছন্দের খেলা হলো শুরু…’ গানের ওই কথাগুলো।

এদিকে দেখি খালিগায়ে ধুতি পরা একটি ছেলে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমারই পানে। বয়স ষোলো হবে হয়ত-বা। দেখতে ফরসা স্লিম। গায়ের রং আপেলের মতো, গলায় একাধিক রুদ্রাক্ষের মালা, কপালে বড়ো লাল টিপ। বললাম, কী দেখছ? একটু হেসে- বুঝলেন না দাদা আপনাকে শুভেচ্ছা-স্বাগত জানানোর জন্যই অপেক্ষা করছি। তোমার নাম? একটু হেসে- ‘প্রদীপ’। বনবিহার দেখবেন না? বললাম, দূর থেকে দেখছি খুব খুব ভালো লেগেছে যে। প্রদীপই বলল, ওই যে বড়ো পাহাড়টা দেখছেন, এর পরেই আমার ঘর। তবে পথে দেখা মিলবে বাঁশবাগান, কলার বাগান। কথাগুলো শুনে কেমন জানি ভয় ভয় লাগল। ততক্ষণে মনে পড়ল বৌদ্ধ ভিক্ষুর সেই কথাগুলো। উঁনি যে বলেছেন, বাঁশঝাড়ের ওখানে ধবধবে সাদা কাপড় পরা ভূত…। এদিকে বনবিহার থেকে সুমনা ও শিখাকে বেরিয়ে আসতে দেখেই সেদিকে আগালাম। ওরা বলল, চলুন দাদা ঘরে ফিরে যাই।

ভ্রমণ থেকে আরও পড়ুন: হুগলীর তীরে প্রিয় শহর কলকাতায়

বাঘাইছড়িতে দু-রাত কাটিয়ে পরদিন সকালে লঞ্চযোগে রাঙামাটির দিকে রওনা হলাম। সন্ধ্যা হয়ে গেল পৌঁছাতে। পরদিন সুমনা, সুমনার বাবা এবং আমি চাকমা রাজার বাড়ি দেখতে গিয়েছিলাম। কর্ণফুলি নদী হয়ে সাম্পানে রাজবাড়ি দেখে আবার সাম্পানেই ফিরে এলাম।

 

রাতে গল্পে গল্পে সুমনার বাবা জানালেন, চাকমা বা চাংমা নামে আমাদের পূর্বপুরুষরা এই রাঙামাটিতে বংশপরম্পরায় বসবাস করে আসছে। একসময় আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবিকানির্বাহের প্রধান উপায় ছিল জুমচাষ। এখন তো তা নয়- এই যে ধরো, আমি লেখাপড়া শিখে সরকারি চাকুরি করছি। এবং আমার মতো অনেকেই এরকম চাকুরি করছে। কেউ সরকারি, কেউবা বেসরকারি চাকুরি আবার কেউবা ব্যবসাবাণিজ্য ইত্যাদি পেশায় নিয়োজিত রয়েছে। অনেক পরে হলেও আমরা বুঝতে শিখেছি, জুমচাষের উপযোগী পাহাড় চিহ্নিত করে পাহাড়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। এ-ও বুঝেছি বনজঙ্গল পোড়ানোর কারণে পরিবেশে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হচ্ছে। এখন তো রাঙামাটির সমতল জমিতে অনেকে লাঙল-ট্রাক্টর দ্বারা চাষাবাদ করছে।

 

রাঙামাটিতে ঘুরে বার বার চোখে পড়েছে আদিবাসী চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গা- এদেরকেই। সুমনার বাবার মুখে এ-ও শুনেছিলাম, উৎপত্তিগত দিকে চাকমারা মোগল থেকে উদ্ভব হয়েছে। কোনো একসময়ে মোগলরা আরাকানিদের হাতে বন্দি হয়েছিল এবং তাদের যুদ্ধবন্দি হিসেবে আটক করে রাখা হয়। পরে আরাকানি রাজা নির্দেশ জারী করেন যে, বন্দি মোগলরা স্থানীয় নারীদের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবে। এইভাবে দাম্পত্য জীবনযাপনের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া সন্তানদের মধ্য হতে চাক বা চেক নামে নতুন একটি জাতিগোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়। চাক শব্দ থেকে পরে ‘চাকমা’ শব্দটি উৎপত্তি লাভ করেছে যার বার্মিজ অর্থ হচ্ছে ‘মিক্সড অরিজিন’।