চড়ক পূজা ও গাজনের উৎসব


চড়ক পূজা বাংলাদেশের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোকোৎসব – চৈত্রের শেষ দিনে এ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। দু’তিন দিনব্যাপী চড়ক পূজার উৎসব চলে। এটি চৈত্র মাসে পালিত হিন্দু দেবতা শিবের গাজন উৎসবের একটি অঙ্গ। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে যা কিনা চড়ক সংক্রান্তির মেলাও বলা হয়। চড়ক পূজার পূজার অন্য নাম – নীল পূজা, হাজরহা পূজা বা হরব পূজা। হিন্দুদের এ পূজা হলেও জাতিধর্ম নির্বিশেষে আজও এ পূজা ও উৎসব উপভোগ করা হয় – বিশেষ করে চড়ক পূজা, মেলা ও গাজনের উৎসব দেখার জন্য আজও আমি ব্যাকুল হয়ে থাকি।

জনশ্রুতি আছে, ১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দে সুন্দরানন্দ ঠাকুর নামের এক রাজা এই পূজা প্রথম শুরু করেন। গম্ভীরা পূজা বা শিবের গাজন এই চড়ক পূজারই রকমফের।

চড়ক পূজা মানে কি?

চড়ক পূজা পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোকউৎসব। চৈত্রের শেষ দিনে এ পূজা অনুষ্ঠিত হয় এবং বৈশাখের প্রথম দু’তিন দিনব্যাপী চড়ক পূজার উৎসব চলে। এটি চৈত্র মাসে পালিত হিন্দু দেবতা শিবের গাজন উৎসবের একটি অঙ্গ।

চড়ক পূজা কেন করা হয়?

চড়ক পূজার মূলে রয়েছে ভূতপ্রেত ও পুনর্জন্মবাদের ওপর বিশ্বাস। পূজার উৎসবে বহু প্রকারের দৈহিক যন্ত্রণা ধর্মের অঙ্গ বলে বিবেচিত হয়।

চড়ক গাছে ভক্ত বা সন্ন্যাসীকে লোহার হুক দিয়ে চাকার সঙ্গে বেঁধে দ্রুতবেগে ঘোরানো হয়। তার পিঠে, হাতে, পায়ে, জিহ্বায় এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গে বাণ শলাকা বিদ্ধ করা হয়।

নীল ষষ্ঠীতে কি খাবেন?

বেশির ভাগ ভক্তরা কাছাকাছি শিব মন্দির এবং শিবলিঙ্গ পূজায় যান। ভগবান শিবকে দুধ বা ক্ষীরাভিষেক, বেল পাতা এবং ফুল নিবেদন করা হয়। নৈবেদ্য হিসাবে বিশেষ সুস্বাদু খাবার দেওয়া হয়। বাড়ি ফিরে মহিলারা প্রসাদ খেয়ে উপবাস ভাঙেন।

গাজন বলতে কি বুঝায়?

গাজন উৎসবে শিব, নীল, মনসা ও ধর্মঠাকুরের পূজাকেন্দ্রীক উৎসব। মালদহে গাজনের নাম গম্ভীরা এবং জলপাইগুড়িতে গমীরা। চৈত্র মাসের শেষ সপ্তাহ জুড়ে সন্ন্যাসী বা ভক্তদের মাধ্যমে শিবের গাজন উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।

সন্ন্যাসীদের নাচ কতদিন ধরে চলে?

সন্নাসীদের নাচ দশ -বারোদিন ধরে চলে।

আজ একাত্তর বয়সে এসে খুব করে মনে পড়ছে শৈশবের স্মৃতি – চৈত্রের শেষে চড়ক পূজা – মেলা কিম্বা গাজন উৎসব দেখতে ব্যাকুল হয়ে ছুটে যেতাম মেলা – পূজা – উৎসব প্রাঙ্গণে। তখন হিন্দু মুসলমান সবাই মিলে আমরা চৈত্র মাসের শেষের এই উৎসবগুলি হাতে হাত রেখে একত্রে উপভোগ করেছি। সেদিনের মতো আজও মনে করি তাই, এ উৎসব জাতিধর্ম নির্বিশেষে সবার। খুব করে স্মৃতিতে জাগে,

উদাত্ত কণ্ঠে সবাই মিলে গেয়েছি –

‘আমরা দুটি ভাই শিবের গাজন গাই / ঠাকমা গেছেন গয়া কাশী ডুগডুগি বাজাই।’

সেই আনন্দ কোথায় হারিয়ে গেল!                                                                                                 বাংলাদেশের  দক্ষিণের পিরোজপুর তখন খুবই ছোটো শহর। ওখানে বসন্তপুলের একটু দক্ষিণে এগোলেই দেখতাম মেলাটেলা। চৈত্র সংক্রান্তিতে ওখানে মেলা বসতো। সেই মেলাকে বলা হতো  চড়কের পূজা বা নীল পূজা ও মেলা।  সেই মেলা আর বসে কি না তা অজানা থেকে গেল।  মেলার মাঠের একদিকে ছিলো জলাজমি। অন্যদিকে বেড়া দেওয়া। ছিলো হাতেগোনা মাত্র একটি দালান আর তিনটি কি চারটি মাটির ঘর। 

আরও পড়ুন: দিলীপ কুমারের দাদাবাড়িতে

পশ্চিমবঙ্গ: সপ্তাহান্তে লাল পাহাড়ীর দেশ পুরুলিয়া আর জয়চন্ডী পাহাড় ভ্রমণ

মনে আছে, চৈত্র সংক্রান্তির দুদিন আগে থেকেই এই উৎসব শুরু হতো। ওখানের এক পাশে মঞ্চের সামনের দিকে একটা  ঝাঁপানতলা তৈরি করা থাকতো। প্রায় ১৬ ফুট উঁচু ছিলো হয়তোবা। সেখান থেকে সন্ন্যাসী দল ঝাঁপিয়ে পড়তো। মঞ্চ ঘিরে থাকতো প্রচুর ভিড়। চোখের দেখা সেই স্মৃতি হলো, কিছু লোক মোটা দড়ির জাল ধরে দাঁড়িয়ে থাকতো। দড়ির জালের উপর কিছু বাবলা কাঁটা ও ছুরি পাশাপাশি থাকতো। যার ফলার দিকটা উর্ধ্বমুখী এবং আড়াআড়িভাবে থাকতো। কিছু গাজনের সন্ন্যাসী মহিলাদের কোল থেকে বাচ্চা নিয়ে সেই ছুরি ও কাঁটার উপর শুইয়ে দিয়ে আবার কোলে ফিরিয়ে দিতেন। ওই বাচ্চাদের বয়স বেশি হলে পাঁচ মাস থেকে আট মাসের মধ্যে থাকতো। মনে আছে, ওখানে একটি মন্দিরও ছিলো। মন্দির ঘিরে বেশ ভিড় থাকতো। মঞ্চে নাটকও হতো, মহাকালী নাটকটির কথা এখনও ভাসাভাসা মনে পড়ে। সামান্য ওইটুকু জায়গায় শত শত মানুষ হাঁ  করে  নাটক গিলতো। কোথাও মাচা বেঁধে অল্পবয়সি মেয়েদের গানের তালে তালে নাচ হতো। ম্যাজিশিয়ান জাদু দেখাতেন। কোথাও একটা মেয়ের দুটো মাথা, একটা গরুর পাঁচটা পা। বিজলিকন্যা ইত্যাদি কত কি। মাটির হাঁড়ি – কলসি ইত্যাদির দোকানও থাকতো। মেয়েদের সাজের দোকানও ছিলো। ফুচকা, ঘুগনি, দেলবাহার, আলুকাবলির স্টলও ছিলো। কিছুটা মনে পড়ে, অল্পবয়সি যুবক – যুবতীদের হাত ধরাধরি করে ঘুরতেও দেখেছি।                             

প্রকৃতির সন্তান মানুষ – একা একা থাকতে না পেরে একে অপরের সংগে আলাপ করে। পরে এই আলাপই ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়। আর এই ঘনিষ্ঠতাই পরিণত হয় মিলনক্ষেত্রে। সে যে কোনও একটা উপলক্ষ হতে পারে। পূজো – ধর্ম, হাট, বাজার ইত্যাদি। তবে মানবজীবনের আদিম রূপটি একমাত্র আদিবাসী সমাজে দেখা যায়। সে রকমই একটা ছোঁয়া ছিলো চড়ক পূজা,   মেলা ও গাজনের উৎসবে । তা আজকের দিনের শহরের মেলা থেকে অনেক আলাদা ছিল বৈকি!

পূজার আগের দিন চড়ক গাছটিকে ধুয়ে মুছে পরিস্কার করা হয়। এতে জলভরা একটি পাত্রে শিবের প্রতীক শিবলিঙ্গ বা সিঁদুরমথিত লম্বা কাঠের তক্তা বা শিবের পাটা রাখা হয়, যা পূজারিদের কাছে বুড়োশিব নামে পরিচিত। এ পূজার পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করেন পতিত ব্রাহ্মণ। এ পূজার বিশেষ বিশেষ অঙ্গ হ’ল – কুমীরের পূজা, জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর হাঁটা, কাঁটা আর ছুঁড়ির ওপর লাফানো, বাণফোঁড়া, শিবের বিয়ে, অগ্নিনৃত্য, চড়কগাছে দোলা – ইত্যাদি।    


গাজন
উৎসব

গাজনের উৎসব আরও উপভোগ্য – যেন মন কেড়ে নেয়। চড়ক পূজার আগের দিন নীল চণ্ডীকার পূজা হয়, এদিন কয়েকজনের একটি দল সারা গ্রাম ঘুরে বেড়ায়। দলে থাকে একজন শিব ও দু’জন সখী। সখীদের পায়ে থাকে ঘুঙুর – তাদের সঙ্গে থাকে ঢোল – কাঁসরসহ বাদকদল। সখীরা গান ও বাজনার তালে তালে নাচে। এদেরকে দেল বা নীল পাগলের দলও বলা হয় – এরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে গাজনের গান গায় এবং নৃত্য পরিবেশন করে।

গাজনের সন্ন্যাসী বা ভক্তরা নিজেদের শরীরকে বিভিন্ন উপায়ে যন্ত্রণা দিয়ে কৃচ্ছ্র সাধনের মাধ্যমে ইষ্ট দেবতাকে সন্তোষ প্রদানের চেষ্টা করতেন – আহা চোখের দেখা গাজন উৎসব ও চড়ক পূজার সেই স্মৃতি কি করে ভুলি!

আমাদের ফেসবুক পেজ ফলো’তে নিন