মেক্সিকো: মায়া সভ্যতার পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের দেশ


আমেরিকার প্রতিবেশী দেশ মেক্সিকো। ফুটবলের কল্যাণে তাদের বিশ্বব্যাপী খ্যাতি। মেক্সিকোর উল্লেখযোগ্য বিষয় নিয়ে লিখেছেন দুই বাংলার অন্যতম সেরা ভ্রমণ লেখক লিয়াকত হোসেন খোকন

Table of Contents

উত্তর আমেরিকা মহাদেশের দেশ মেক্সিকো। এই দেশটির অফিসিয়াল নাম ইউনাইটেড মেক্সিকান স্টেটস। মেক্সিকোর জাতীয় প্রতীক সোনালী ঈগল।

মেক্সিকোর উত্তরে যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ ও পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগর, দক্ষিণ -পূর্বে গুয়াতেমালা, বেলিজ ও ক্যারিবিয়ান সাগর এবং পূর্বে মেক্সিকো উপসাগর অবস্থিত। প্রায় দুই মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার জুড়ে অবস্থিত। আয়তনের হিসাবে দুই আমেরিকার পঞ্চম বৃহত্তম রাষ্ট্র তথা পৃথিবীর চতুর্দশ বৃহত্তম রাষ্ট্র মেক্সিকো। এই দেশের জনসংখ্যা ১০৯ মিলিয়ন। মেক্সিকো রাষ্ট্রে মোট একত্রিশটি রাজ্য রয়েছে।

এ দেশটি ল্যাটিন আমেরিকার সবচেয়ে উত্তরে ও সবচেয়ে পশ্চিমে অবস্থিত। এছাড়া পৃথিবীর বৃহত্তম স্পেনীয় ভাষাভাষী রাষ্ট্র।

প্রাক কলম্বিয়ান মধ্য আমেরিকায় ইউরোপীয়ানদের আগমনের আগেই ওলমেক, তোলতেক, তেওতিউয়াকান, মায়া ও আজটেক সভ্যতার মতো একাধিক উন্নত সভ্যতা বিকাশ লাভ করেছিল।

১৫২১ খ্রিস্টাব্দে স্পেন মেক্সিকোতে নিউ স্পেন প্রতিষ্ঠা করে। এই দেশটিই পরে মেক্সিকো নামক উপনিবেশে পরিণত হয়। ১৮২১ খ্রিস্টাব্দের ২৭ সেপ্টেম্বর দেশটি স্প্যানিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতার পর নিউ স্পেন স্থির করে নতুন রাষ্ট্রের নামকরণ হবে রাজধানী মেক্সিকো সিটির নামে।

চিচেন_ইৎজা_মেক্সিকো
মেক্সিকোর চিচেন ইৎজা

মেক্সিকো দর্শনীয় স্থান হল – বেসিলিকা দে গুয়াদালুপে ; লুইস ব্যারাগন হাউস ও স্টুডিও ; জাদুঘর ; টিয়োটিহকান ; টেনায়ুকার অ্যাজটেক পিরামিড ; চ্যাপুলটেপেক দুর্গ ও পাহাড় ; নৃবিজ্ঞানের জাতীয় জাদুঘর ; জুয়ারেজ ; গ্রান হোটেল সিউদাদ দে মেক্সিকো ; প্যালাসিও ডি বেলাস আর্টেস ; তুলা এবং টোলান ধ্বংসাবশেষ ; পালাসিও ন্যাশনাল প্রাসাদ ; মেক্সিকো সিটি মেট্রোপলিটন ক্যাথেড্রাল ; মিউজিও ফ্রিদা কাহলো ; আগ্নেয়গিরির বলয় ; প্রশান্ত মহাসাগর ; কাসা আজুল প্রভৃতি।

১৫২৪ খ্রিস্টাব্দে প্রাচীন আজটেক রাজধানী তেনোচতিৎলানের ওপর শহরটি স্থাপিত হয়। স্বাধীনতা -উত্তর মেক্সিকোতে ছিল অর্থনৈতিক অস্থিরতা, অঞ্চল হস্তচ্যুত হওয়া, গৃহযুদ্ধ এবং বৈদেশিক হস্তক্ষেপ, দু’টি সাম্রাজ্য ও দু’টি দীর্ঘ একনায়কতন্ত্রের ইতিহাস। সর্বশেষ ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে মেক্সিকোতে সংগঠিত হয় বিপ্লব। এই বিপ্লবের ফলে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের সংবিধান ও দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান। লাতিন আমেরিকার আঞ্চলিক রাজনীতিতে মেক্সিকোর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে।

পর্যটনে উল্লেখযোগ্য স্থান মেক্সিকো – লাতিন আমেরিকার পর্যটকদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় গন্তব্য মেক্সিকো সিটি। অপরূপ সুন্দর মেক্সিকো শহরটি দেখতে প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক ভিড় করেন শহরটিতে। পুরো শহরটিকে ঘিরে রেখেছে সমুদ্রের নীল জল। এখানকার বিলাসবহুল পাঁচ তারকা হোটেল, সমুদ্র সৈকতে পর্যটকদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা প্রভৃতি পর্যটকদের আকৃষ্ট করে।

আকর্ষণীয় ট্যুরিস্ট স্পটগুলোর মধ্যে বিখ্যাত দ্য প্লাজা দে লাস ট্রেস কালচারস, দ্য মেট্রোপলিটন ক্যাথেড্রাল প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। পর্যটকদের সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করে ৫৫তলা বিশিষ্ট তরে মায়র টাওয়ার।

মেক্সিকোর তুলুমে রয়েছে নান্দনিক এক সমুদ্র সৈকত। এখানে ঐতিহ্য – সমুদ্রকে যেন নীরবে জানাচ্ছে তার জীবন কথা। আর সমুদ্র তার শীতল জলের ঝাপটায় দূর করছে নিজের সকল ক্লান্তি।

সূর্যস্নান আর মায়া সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ দেখতে হলে যেতে হবে তুলুম সৈকতে। এখানেও পর্যটকরা ভিড় করেন।

মেক্সিকোর সবচেয়ে জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট কানকুন। কানকুন উপকূলের তলদেশে রয়েছে চার শতাধিক স্থাপত্য সমৃদ্ধ এক আন্ডার ওয়াটার আর্ট মিউজিয়াম।

মায়া_সভ্যতা_মেক্সিকো
মায়া সভ্যতার একটি প্রতীকি চিত্র Image copyright: the Americas

মায়া সভ্যতার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ধ্বংসাবশেষ বা পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনটির অবস্থান বর্তমান মেক্সিকোতে। কানকুনের ১২৫ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত এই প্রাচীন শহরের ধ্বংসস্তূপটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তালিকায় জায়গাও করে নিয়েছে। মনে করা হয়, প্রাচীন এই শহরই ছিল মায়া সভ্যতার সবচেয়ে বড় শহর। শহরটিতে মায়ানরা গড়ে তুলেছিল আকাশচুম্বী পিরামিড, বৃহদায়তন মন্দির -গীর্জা, সর্পিল স্তম্ভ, বিশালাকৃতির খেলার ময়দানের মতো সব স্থাপনা। এখানে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার জন্য যেমন গবেষণাগার বাননো হয়েছিল, তেমনি ছিল বিশাল বিশাল সব ধর্মীয় স্থাপনা। নগরটির এই স্থাপনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত হল পিরামিড। এটি বানানো হয়েছিল জ্যোতির্বিদ্যার নানা হিসাব -নিকাশের ভিত্তিতে।

মেক্সিকোর উল্লেখযোগ্য শহরগুলি হলো – মেক্সিকো, চিহুয়াহুয়া, মনটেরি, হেরমোসিলো, সান লুইস পোটোসি, মোরেলিয়া, আকাপুলকো, ওয়াক্সাকা, ভিল্লাহারমোসা, ভেরাক্রুজ, ট্যাম্পিকো, কুলিয়াকান, সানলুইস, গুয়াডালদারা -ইত্যাদি।

মেক্সিকোতেই রয়েছে সোনো রান মরুভূমি, মালভূমি।

মেক্সিকোর ভাষা -স্প্যানিশ। দেশের লোকজন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। 

ভ্রমণ নিয়ে আরও পড়ুন: ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও পেরু ভ্রমনে যেসব স্থান ঘুরে দেখবেন

মেক্সিকোর ইতিহাস বলে, একদা আজটেক সাম্রাজ্য ছিল আমেরিকার সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও ক্ষমতাধারী শক্তি। আমেরিকার আদিবাসীদের এই সাম্রাজ্য পশ্চিমে মেক্সিকো উপত্যকা থেকে পূর্বে মেক্সিকো উপসাগর এবং দক্ষিণে গুয়াতেমালা পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। মধ্য আমেরিকার মায়া সভ্যতা থেকে প্রায় ৫০০ মাইল পশ্চিমে অ্যাজটেকবাসীরা নতুন সভ্যতার উন্মেষ ঘটায়। আজকের মেক্সিকো সিটি যেখানে অবস্থিত সেখানেই অ্যাজটেক সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন হয়। এই অ্যাজটেকরা মেক্সিকোর আরও উত্তরের জনগোষ্ঠী ছিল। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে এই জাতি মেক্সিকোর জলাশয়ের একটি দ্বীপে আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে বসতি গড়ে তুলেছিল। তাদের রাজধানী ছিল তেনোচৎলানে। ১৫২১ খ্রিস্টাব্দে স্পেনের নাবিক কোর্তেসের অধীনে স্পেনিয় ও স্থানীয় অ্যাজটেক বিদ্রোহীদের নিয়ে গঠিত যৌথবাহিনি যুদ্ধ করে দখল করে নিলে সেই সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে।

কথিত আছে, অ্যাজটেকরা যখন মেক্সিকো উপত্যকায় আগমন করে তখন এক জায়গায় এক ক্যাকটাসের উপর ঈগলের নখরবন্দি অবস্থায় একটি সাপ দেখতে পায়। সেই সময় ওই জায়গায় তারা সভ্যতার সূচনা করে এবং পরবর্তীতে সেখানে শহর গড়ে ওঠে। সেই সাপ ও ঈগল এখনও আধুনিক মেক্সিকোর জাতীয় প্রতীক এবং জাতীয় পতাকা ও মুদ্রায় প্রতীকগুলোকে খুঁজে পাওয়া যায়।

মেক্সিকোর তেনোচতিৎলান শহরের ধ্বংসাবশেষের উপরে স্পেনিয় মেক্সিকো সিটি তৈরি হয় ক্রমেক্রমে।

মেক্সিকো সিটির জোকালোয় প্লাজা দে লাতে গেলে এখনও অ্যাজটেকদের বহু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়।