মঙ্গোলিয়া: দুর্ধর্ষ মোঙ্গল সম্রাট চেঙ্গিস খান জন্মেছিলেন যে দেশে


মঙ্গোলিয়া দেশের বিখ্যাত উৎসবের নাম নাদাম। খোলা প্রান্তরে অনুষ্ঠিত হয় এ উৎসব। এই উৎসবে থাকে চিরাচরিত নাচগান, তীরন্দাজি, কুস্তিখেলা, ঘোড়দৌড়। তা দেখার জন্য লাখ লাখ লোকের ভিড় জমে। লিখেছেন দুই বাংলার অন্যতম সেরা ভ্রমণ লেখক লিয়াকত হোসেন খোকন

Table of Contents

অসংখ্য লোক উৎসবের সময় ছবি বা সেলফি তোলেন। ঘোলের মতো দেখতে এমন পানীয় গ্লাসে গ্লাসে বিক্রি চলে তখন। এ রকম পানীয় তৈরি হয় ঘোড়ার দুধ দিয়ে। মঙ্গোলিয়ানরা এটা নিয়মিত পান করেন। তবে এটি সামান্য টক, তবে ভীষণ স্বাদ রয়েছে। এর নাম আইরাগ। জানা যায়, এতে নাকি বারো রকমের ভিটামিন আছে। তাছাড়া এতে শতকরা ছয় থেকে বারো ভাগ অ্যালকোহলও আছে। ভয়ানক ঠান্ডায় খিদে -তেষ্টার কষ্ট কাটিয়ে আইরাগ পান করলে শরীরটা চাঙ্গা হয়। পর পর দু’গ্লাস আইরাগ পান করলে মনে হবে দেহে অন্য রকমের একটা প্রাণ ফিরে এসেছে।

ঘোড়াকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর ১১ জুলাই নাদাম উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। তখন মঙ্গোলিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বহু ঘোড়া এসে এক বিস্তীর্ণ প্রান্তরে জড়ো হয়। ছয়টি বয়সভিত্তিক বিভাগে ঘোড়া ভাগ করা হয়। যেমন – দু’বছর, চার বছর, ছ’বছর ইত্যাদি। চার থেকে পাঁচ হাজারেরও বেশি ঘোড়া নাদাম উৎসবে অংশগ্রহণ করে। একসঙ্গে সাত কি আটশো ঘোড়া দৌঁড় শুরু করে।

আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ঘোড়সওয়াররা সবাই ছয় থেকে দশ বছরের বালক। আর হবে না -ই বা কেন। ওরা তো তিন বছর বয়স থেকেই ঘোড়ায় চড়তে শুরু করে।

প্রবাদ আছে, প্রত্যেক মঙ্গোলীয়ই ঘোড়ার পিঠে জন্মায়।

নাদাম উৎসবে এক হাজারেরও বেশি কুস্তিগির অংশগ্রহণ করে। অষ্টম বা নবম রাউন্ড পর্যন্ত টিকে থাকে তাকেই বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। পঞ্চম রাউন্ড পর্যন্ত বিজয়ী কুস্তিগির বাজপাখি এবং সপ্তম রাউন্ড পর্যন্ত বিজয়ী হাতি উপহার পায়।

দুর্ধর্ষ মোঙ্গল নেতা চেঙ্গিস খান –

মধ্যযুগের দুর্ধর্ষ নেতা চেঙ্গিস খানকে নেপোলিয়ন ও আলেকজান্ডারের সমকক্ষ মনে করা হয়। যদিও নেপোলিয়ন কিম্বা আলেকজান্ডার চেঙ্গিস খানের মতো ইতিহাসের সর্ববৃহৎ ও দীর্ঘস্থায়ী রাজবংশের স্থপতি নন। মানবসভ্যতার সবচেয়ে বৃহৎ ও দীর্ঘস্থায়ী সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ইতিহাসের পাতায় আজো অমর হয়ে আছেন মোঙ্গল নেতা চেঙ্গিস খান।

চেঙ্গিস খানের ছেলেরা এমন এক সাম্রাজ্য শাসন করে গেছেন, যে সাম্রাজ্যের বিস্তার ছিল রাশিয়া, ইউক্রেন থেকে কোরিয়া অবধি। তাঁর দৌহিত্ররা চীন, পারস্য ও রাশিয়ার শক্তিশালী রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর বংশধরেরা ছিল মধ্য এশিয়ার পরাক্রমশালী সম্রাট। সাইবেরিয়ার দক্ষিণে হ্রদ বৈকাল। হ্রদ বৈকালের ধারেই একটি নদী। নদীর নাম ওনান। সেই ওনান নদীর পাড়েই মধ্যযুগের দুর্ধর্ষ মোঙ্গল সম্রাট চেঙ্গিস খানের গল্পটা শুরু হতে পারে এভাবে।

ওনান নদীটি পরে চেঙ্গিস খানের জীবনে দারুণ প্রভাব রেখেছিল। চেঙ্গিস খানের জন্ম সম্পর্কে স্থানীয় মোঙ্গল লোককাহিনী অদ্ভুত অদ্ভুত সব কথা বলে। বলে যে, চেঙ্গিস খানের পূর্বপুরুষের নাকি উত্থান ঘটেছে ধূসর নেকড়ে ও মাদি হরিণের মিথীয় সন্মিলন থেকে। জন্মানোর পর নবজাতকের হাতে ছিল রক্তের দলা। খুবই অদ্ভুত। মোঙ্গলরা এখন যতই সভ্য হোক, একাদশ -দ্বাদশ শতকের মোঙ্গলরা ছিল আসলে যাযাবর। মোঙ্গলদের ধর্ম ছিল শামানবাদ। শামানবাদ হলো এক ধরনের তান্ত্রিকতা। এছাড়া মোঙ্গলদের পূর্বপুরুষরা আত্মার পূজা -অর্চনাও করত।

মোঙ্গলদের একটি বড় অংশের ধর্ম ছিল তেনগ্রিবাদ। তেনগ্রি ছিলেন আকাশদেবতা অথবা এক দেবী।

দুর্ধর্ষ মোঙ্গল নেতা চেঙ্গিস খানের বাবার নাম ইয়সুগেই। তিনি ছিলেন পূর্ব মঙ্গোলিয়ার স্থানীয় সর্দার। মোঙ্গল গোত্রের শাসকদের বলা হতো খান।

গের নামের ঘর –

মঙ্গোলিয়ার যাযাবরদের অস্থায়ী বাসগৃহকে বলা হয়, গের। দুগান খাদে অসংখ্য যাযাবর বাস করে। উলানবাটোর থেকে প্রায় ১০৫ কিলোমিটার দূরে দুগান খাদ। এখানের অনেক জায়গাই পাহাড়ঘেরা উপত্যকাময়। কাছে দূরে ইতস্তত ছড়িয়ে রয়েছে যাযাবরদের গেরগুলো। কোথাও একটা দুটো আবার কোথাও বা চার -পাঁচটা। অনেকগুলো গেরের কাছেই রয়েছে যাযাবরদের ঘোড়া রাখার জায়গা। একেক জায়গায় একেক ধরনের দৃশ্য। অর্থাৎ এক যাযাবর প্রায় ৪০ থেকে ৫০টি ঘোড়া চরাচ্ছে। দূরে পাহাড় ও উপত্যকার পটভূমিতে সে এক অসাধারণ দৃশ্য। গেরের মেঝ গালিচায় আবৃত থাকে।

মঙ্গোলিয়া পূর্ব এশিয়ার একটি স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র।

এ দেশটির উত্তরে রাশিয়া ; দক্ষিণ, পূর্ব এবং পশ্চিমে গণচীন অবস্থিত। মঙ্গোলিয়ার বেশির ভাগ লোক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। আবার এ দেশের অনেকেই যাযাবর। জনসংখ্যার শতকরা ৩৮ ভাগ লোক শহরে বসবাস করে থাকে।

মঙ্গোলিয়া
মঙ্গোলিয়ান তরুণী

মঙ্গোলিয়াতে তিনটি প্রধান পর্বতমালা রয়েছে। আলতাই পর্বতমালা এর মধ্যে সর্বোচ্চ, এটি পশ্চিম ও দক্ষিণ -পশ্চিম মঙ্গোলিয়াতে উত্তর -পশ্চিম ও দক্ষিণ -পূর্ব বরাবর বিস্তৃত। খানগাই পর্বতমালাটিও একই দিক বরাবর মধ্য ও উত্তর -মধ্য মঙ্গোলিয়াতে অবস্থিত – এগুলি অপেক্ষাকৃত পুরাতন, ক্ষয়ে যাওয়া পর্বত এবং এখানে অরণ্য ও চারণভূমি দেখতে পাওয়া যায়।

রুশ সীমান্তের কাছে উলানবাটারের উত্তর -পূর্বে অবস্থিত খেনতিল পর্বতমালা আরও কম উচ্চতাবিশিষ্ট।

পূর্ব মঙ্গোলিয়ার অধিকাংশ এলাকা সমতল। পূর্বদিকে এটি গোবি মরুভূমির সাথে মিশে গেছে।

সেলেঙ্গি নদী মঙ্গোলিয়ার প্রধান নদী।

মঙ্গোলিয়ার অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর।

মঙ্গোলীয় ভাষার খালখা উপভাষাটি মঙ্গোলিয়ার প্রধান ও জাতীয় ভাষা। আধুনিক লেখ্য মঙ্গোলীয় ভাষা এই কথ্য উপভাষাটিকে ভিত্তি করেই নির্মিত। মঙ্গোলিয়ার প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ লোক এই ভাষায় কথা বলে।

মঙ্গোলীয় ভাষা ছাড়াও আরও ১০টি ভাষা মঙ্গোলিয়ায় প্রচলিত। যেমন – চীনা ভাষা, রুশ ভাষা, আলতায়ী ভাষা, বুরিয়াত ভাষা, দারখাত ভাষা, তুভিন ভাষা, কাজাখ ভাষা, এভেনিক ভাষা – ইত্যাদি।

মঙ্গোলিয়ার সরকারি ভাষা মঙ্গোলীয়। এ দেশের জাতীয়তা – মঙ্গোল বা মঙ্গোলীয়।

দেশের আয়তন মোট ১৫,৬৪,১১৫.৭৫ বর্গকিলোমিটার।

জনসংখ্যা – ৩,৩৫৩,৪৭০ জন।

মঙ্গোলিয়ার রাজনীতি একটি অর্ধ রাষ্ট্রপতি শাসিত প্রতিনিধিমূলক বহুদলীয় গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কাঠামোয় সংগঠিত হয়ে থাকে। রাষ্ট্রপতি হলেন রাষ্ট্রের প্রধান। তবে সরকার প্রধান হলেন প্রধানমন্ত্রী।

আরও পড়ুন: মধ্য আমেরিকায় অবস্থিত চির বসন্তের দেশ

মঙ্গোলিয়ার রাজধানী বসেছে উলানবাটোরে। রাজধানী উলানবাটোর দেশটির সর্ববৃহৎ শহর। একদা মঙ্গোলীয় রাজপুত্রেরা উলানবাটোরকে একটি মৌসুমি অভিবাসনমূলক আবাসস্থল হিসেবে পত্তন করেছিলেন। শহরটি সমুদ্র সমতল থেকে ১৩৫০ মিটার উচ্চতায় একটি ঝঞ্ঝাপীড়িত মালভূমির উপরে তুল নদীর তীরে অবস্থিত। ১৬৩৯ খৃষ্টাব্দে দা খুরে মঠ নির্মাণের মাধ্যমে শহরটি বর্তমান অবস্থানে স্থায়ী হয়। এই মঠ বা ভবনটি তিব্বতি বৌদ্ধ ধর্মের বোদগো -গেগেন তথা উচ্চ যাজকের বাসভবনে পরিণত হয়। যা কিনা আরও প্রায় ২০০ বছর এ কাজে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু তখনও এটি যাযাবর এক মঠের শহর হিসেবেই বিদ্যমান ছিল। রুশরা দা খুরে মঠটিকে উর্গা নামে ডাকত। রুশরা এখানে চীনা ও রাশিয়ার মধ্যে একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলে। আর এ ভাবে উলানবাটোর শহরটির আয়তন বৃদ্ধি পেতে থাকে।

১৯১১ খৃষ্টাব্দে বহির্দেশীয় মঙ্গোলিয়া নিজেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করলে নিসলেল খুরেরে প্রথমে তাঁর অধীনে এবং পরে মঙ্গোলিয়ার বিপ্লবী নেতা দামদিনি স্যুবাতার শহরটির নিয়ন্ত্রণ হাতে নেন। সেই সময়ে উলানবাটোরের ধর্মীয় ভবনগুলিকে নিষিদ্ধ করা হয়।

১৯২৪ খৃষ্টাব্দে মঙ্গোলিয়াকে একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হলে শহরটিকে উলানবাতার বা উলানবাটোরা নাম দেওয়া হয়। যার অর্থ ‘লাল নেতা’। উলানবাটোর শহরের আয়তন মোট ৪,৭০৪.৪ বর্গকিলোমিটার।

শহরের উচ্চতা – ৪,৪২৯ ফুট।

জনসংখ্যা মোট ১৩,৮০,০০০ জন।

উলানবাটোর মঙ্গোলিয়ার প্রধান শিল্পকেন্দ্র। এখানে অবস্থিত শিল্প এলাকাটিতে বিভিন্ন ধরনের ভোগদ্রব্য প্রস্তুত করা হয়।

এই শহরে সিমেন্ট, লোহা ও ইট প্রস্তুত হয়। এছাড়া জুতা ও বস্ত্র প্রস্তুত, যানবাহন মেরামত, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও অন্যান্য কারখানা আছে। শহরটি একটি রেলপথ এবং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মাধ্যমে চীন ও রাশিয়ার সাথে সংযুক্ত রয়েছে।