হুগলীর তীরে প্রিয় শহর কলকাতায়, পর্ব-4


চলচ্চিত্র ও ভ্রমণ লেখক লিয়াকত হোসেন খোকন ভারত ভ্রমণ করেছেন ষাটেরও বেশি বার। লেখকের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে আছে তিলোত্তমা নগরী প্রাণবন্ত কলকাতা। বারবার ভ্রমণের সেই অভিজ্ঞতা লেখক প্রান্জল ভাষায় ধারাবাহিকভাবে লিখছেন সাগরপারের পাঠকদের জন্য। আজ প্রকাশিত হল তৃতীয় পর্ব। আগের পর্ব সমূহ পড়ুন: পর্ব-৩ পর্ব-২পর্ব-১
কলকাতার শ্যামপুকুর – বরাহনগর -জানবাজার -ময়দান -সোনাগাছি পায়ে হেঁটে হেঁটে ঘুরে দেখার কথা খুব করে মনে পড়ে।
শ্যামপুকুর উত্তর কলকাতার একটি অঞ্চল।
শ্যামপুকুরের ঐতিহাসিক স্থান হ’ল – শ্যাম স্কোয়ার।
১৮৯১ সালে শ্যামপুকুরের মহারাজা দুর্গাচরণ লাহার বদান্যতায় মোহনবাগান দল ফড়িয়াপুকুর থেকে শ্যামবাজারের মাঠে উঠে আসে – সেই মাঠটি বর্তমানে শ্যাম স্কোযার নামে পরিচিত।
শ্যামপুকুর বাটী – ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে দক্ষিণেশ্বর থেকে কলকাতার শ্যামপুকুরের ৫৫ নং শ্যামপুকুর স্ট্রিটের বাড়িতে এনে রাখা হয়। এই বাড়িটি শ্যামপুকুর বাটী নামে পরিচিত।
পরে তাঁকে এই বাড়ি থেকে কাশীপুর উদ্যানবাটীতে নেয়া হয়েছিল।
সেই কাশীপুরের বাড়িতে তাঁর প্রয়াণ ঘটেছিল।
শ্যামপুকুর
বর্তমানে শ্যামপুকুর বাটী বেলুড় মঠের অধীনস্থ একটি মঠকেন্দ্র ও রামকৃষ্ণ মন্দির।
যে ঘরটিতে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব থাকতেন, সেই ঘরটি এখন ঠাকুরঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
যে ঘরটিতে সারদা দেবী থাকতেন, সেই ঘরটিকেও ঠাকুরঘরে রূপান্তরিত করা হয়েছে।
রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ব্যবহৃত কিছু জিনিস ও কয়েকটি চিত্র এই বাটীতে রয়েছে।
অনেক আগে থেকেই এখানে কালীপূজা হলেও কোন বিগ্রহ ছিল না – এখানে কালীপূজার আয়োজন করতে বলেছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নিজেই । তখন তিনি অসুস্থ  ছিলেন, সেই সময়  ধ্যানমগ্ন রামকৃষ্ণকেই পুজো করেন ভক্তবৃন্দরা।
ভক্তদের তালিকায় ছিলেন – নট গিরিশচন্দ্র ঘোষের মতো ব্যক্তিত্বরাও।
অসুস্থ শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে দেখতে এই শ্যামপুকুরের বাটীতে ছদ্মবেশে এসেছিলেন বিখ্যাত নটী বিনোদিনী।
শ্যামপুকুরের সেই বাড়ী বর্তমানে রামকৃষ্ণ মিশনের অন্তর্গত – বাড়ীর খিলান থেকে খিড়কি – শ্যামপুকুর যেন রামকৃষ্ণময় – ঠাকুরমার। মূল শ্যামপুকুর এলাকার আয়তন অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রাকার হলেও – থানা ও বিধানসভা কেন্দ্রটি বেশ বড়ো।
হুগলি জেলার শেঠ ও বসাক বণিকগণ ছিলেন সুতানুটি অঞ্চলের আদি বাসিন্দা। এরাই সুতানুটির বন জঙ্গল পরিস্কার করে এই অঞ্চলটিকে বাসযোগ্য করে তোলে।
শ্যামপুকুর এবং এর পার্শ্ববর্তী শ্যামবাজার অঞ্চল দু’টি বসাকদের গৃহদেবতা শ্যাম রায়ের নামে নামাঙ্কিত। শ্যামের আরেক নাম কৃষ্ণ।
প্রাচীন সুতানুটির প্রাণকেন্দ্র ছিল এই শ্যামপুকুর – ১৭৮৫ সালে প্রথম কলকাতার থানাগুলির তালিকা প্রস্তুত করা হয়। সেই তালিকায় শ্যামপুকুর থানার নাম ছিল।
কিন্তু বর্তমানে শ্যামপুকুরের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ একই থানা এলাকার অন্তর্গত শ্যামবাজার ও বাগবাজার।
এই দুই অঞ্চল ছিল সেকালের বাঙালি সংস্কৃতি ও আভিজাত্যের পীঠস্থান।
কলকাতা পুলিশের শ্যামপুকুর থানা এলাকাটি শ্যামবাজার, বাগবাজার, কুমারটুলি ও
শোভাবাজারের একাংশ নিয়ে গঠিত।
শ্যামপুকুর থানার অন্তর্গত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘাট হ’ল –
বাগবাজার ঘাট ; প্রমদাসুন্দরী ঘাট ; কাশী মিত্র ঘাট ; কুমারটুলি ঘাট ; শোভাবাজার ঘাট।
এই ঘাটগুলি হুগলি নদীর তীরে, বলা হয় – এ ঘাটগুলি খুবই ঐতিহ্যবাহী।
টাউন স্কুলটি খুবই প্রাচীন – এটি দেখার মতো।
নিবেদিতা পার্ক এখানের আরেক দর্শনীয়।
শ্যামপুকুর থানা কলকাতার পৌর সংস্থার ৭ নং বাগবাজার ; ৮ নং বাগবাজার – শোভাবাজার ; ৯ নং শোভাবাজার ; ১০ নং শ্যামবাজারের কিছু অংশ ও ১১ নং শ্যামপুকুরের আংশিক, আংশিক বড়তলা ওয়ার্ডগুলি নিয়ে গঠিত।
শ্যামপুকুর বিধানসভা কেন্দ্র কলকাতা উত্তর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত।
এই কেন্দ্রটি ২৪ নং কলকাতা উত্তর লোকসভা কেন্দ্রের অংশ।

বরাহনগর

বরানগর বা বরাহনগর কলকাতা মহানগরীর  উত্তর সীমান্তে অবস্থিত একটি প্রাচীন জনপদ।
বরাহনগর উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার অন্তর্গত একটি এলাকা।
বরাহনগর অঞ্চলটি পৌরশহর
এবং এখানে রয়েছে বিধানসভা কেন্দ্র।
বরাহনগর
বরাহনগর বিধানসভা কেন্দ্রটি দমদম লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত।
সপ্তদশ শতকে এই জনপদে একটি ডাচ কুঠি স্থাপিত হয় –
পরে এ অঞ্চলটি পাট-শিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হয়ে ওঠে।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে বরাহনগরের দক্ষিণেশ্বরে রাণী রাসমণি তাঁর প্রসিদ্ধ কালীমন্দিরটি স্থাপন করেছিলেন।
রামকৃষ্ণ মিশনের প্রথম মঠও বরাহনগরেই স্থাপিত হয়েছিল।
বর্তমানে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের প্রধান কার্যালয় বরাহনগরে অবস্থিত।
বরাহনগরের সরকার ধরন – পুরসভা।
শাসক – বরাহনগর পুরসভা।
পুর চেয়ারম্যান – অপর্ণা মৌলিক।
বিধায়ক – তাপস রায়।
বরাহনগর – ব্যারাকপুর মহকুমার অন্তর্গত।
২০০১ সালের জনগণনা অনুসারে বরাহনগরের জনসংখ্যা মোট ২,৫০,৬১৫ জন।
বরাহনগরের উল্লেখযোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হ’ল –
ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র কলেজ ;
প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিশ মহাবিদ্যালয় ;
বরাহনগর বিদ্যামন্দির ; রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয় ;
বরাহনগর নরেন্দ্র নাথ বিদ্যামন্দির ;
রাজকুমারী মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল ; বরাহনগর রামেশ্বর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ;
বরাহনগর ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশন – ইত্যাদি।
বরাহনগরের আশেপাশের এলাকা হ’ল –
সিঁথি মোর, নোয়াপাড়া, নেতাজী কলোনি, যুগিপাড়া, কালিমাতা কোলনি, সুভাষ নগর, ব্যানার্জি পাড়া ; বোনহুগলি ; টোবিন রোড ; কুঠিঘাট।
কেউ বলেন বরাহনগর – কেউ আবার বলেন বরানগর।
জানা যায়, বহু বছর আগে এই জনপদে বরাহ মুনি নামের এক সিদ্ধপুরুষ বাস করতেন। তাঁর নামানুসারেই এই জনপদের নাম হয়েছে বরাহনগর।
আবার অনেকে মনে করেন, এই বরাহ মুনিই বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভার বরাহমিহির – তবে বরাহ শব্দের অর্থ শূকর। আর এই শূকর থেকে বরাহনগরের উৎপত্তির যে ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তার ভিত্তি খুব একটা জোরালো নয়।
এও জানা যায়, বরহা শব্দের অর্থ ময়ূরপুচ্ছ। তিন – চারশো বছর আগে থেকেই এই অঞ্চলে ময়ূর ও ময়ূরপুচ্ছের বাজার ছিল। বরাহনগর পার্শ্ববর্তী চিড়িয়া মোড় সেই কারণেই নামকরণ করা হয়েছে অনুমান করা হয়। তাই মনে করা হয়, এই অঞ্চলের আদি নাম ছিল বরহান নগর।
বিহার, ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা, আসাম, ত্রিপুরা ও ভারতের অন্যান্য রাজ্যের অনেক লোক বরাহনগরে বসবাস করে।
অধিকাংশ লোক এখানে বাংলায় কথা বলে। এখানের ডানলপ ও বনহোগলি এলাকায় পাঞ্জাবি শিখরা প্রধানত গুরুমুখী ভাষায় একে অন্যকে এবং হিন্দিতে অন্য ধর্মীয় লোকদের সাথে কথা বলে। বিহারি ও ঝাড়খণ্ডীরা প্রধানত ভোজপুরী ভাষায় একে অন্যকে এবং হিন্দিতে অন্যদের সাথে কথা বলে।
বরাহনগরের দর্শনীয় স্থান হ’ল –
বরাহনগর মঠ ; আলমবাজার মঠ ; কৃপাময়ী কালীমন্দির ; বরাহনগর রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয় ; জয় মিত্রের কালীবাড়ি ;
ব্রহ্মময়ী মন্দির ; কুঠিঘাট,
সোনালী সিনেমা হল ; নারায়ণী সিনেমা হল।
উল্লেখযোগ্য সড়ক –
গোপাল লাল ঠাকুর রোড ; বরাহনগর রোড ; সূর্য সেন রোড ; প্রামাণিক ঘাট রোড ; ব্যারাকপুর ট্রাংক রোড।
ব্যারাকপুর ট্রাংক রোডেই
শিশির কুমার ভাদুড়ীর বাড়ী।
বরাহনগর শ্মশানে
চির নিদ্রায় শায়িত আছেন বিখ্যাত নট শিশির কুমার ভাদুড়ী।

জানবাজার

জানবাজার হ’ল কলকাতার একটি অঞ্চল।
এই এলাকাটি মধ্য কলকাতা মহানগরীর একটি ব্যস্ততম এলাকা।
রাণী রাশমনির দুশো বছরের পুরনো বাসভবনটি এই জনপদের প্রধান আকর্ষণ ও
দর্শনীয়।
রাসমণির বংশধরেরা এখনও এই বাড়িটিতে বসবাস করেন।
রাণী রাশমনি ছিলেন দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা।
মাত্র এগারো বছর বয়সে জানবাজারের জমিদার রাজচন্দ্র দাসের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়।
রাসমণি নানা জনহিতকর কার্যের জন্য
বিখ্যাত ছিলেন।
জানবাজার
রাণী রাশমনি রোড ও সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী রোডের সংযোগ স্থলে অবস্থিত রাণী রাশমণির বাসভবনটির আদি ঠিকানা ছিল ৭০ ও ৭১ ফ্রি স্কুল স্ট্রিট। রাসমণির শ্বশুর প্রীতিরাম দাস ১৮০৫ সালে
এই বাড়িটি নির্মাণ কাজ শুরু করিয়েছিলেন।
বাড়িটি সম্পূর্ণ হতে ৭ কি ৮ বছর সময় লেগেছিল।
রাণী রাসমণি ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর
বাংলায় নারী – ক্ষমতায়নের প্রতীক।
রাণী রাসমণির চারটি মেয়ে ছিল, তাঁদের নাম হ’ল –
পদ্মমণি ; কুমারী ; করুণাময়ী ও জগদম্বা।
তাঁর বাসভবনের সব কটি ঘর
এখনো বাসযোগ্য। বাড়ির বারান্দায় একটি নাটমন্দির আছে, সেখানে প্রতি বছর পারিবারিক দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়।
সুনীল কুমার বিশ্বাসের ছেলেরাই বর্তমানে ১৮ নং রাসমণি রোডে – রাণী রাসমণি ভবনের দুর্গাপূজা পরিচালনা করেন যা বিশ্বাস বাড়ির পুজো নামেই পরিচিত। সমগ্র বাড়িটির এখন তিনটি অংশ – জগদম্বার বংশধরেরা বাস করেন ১৩ নং রাসমণি রোডে ; কুমারীর বংশধরেরা থাকেন ১৮ / ৩ সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী রোডে এবং
পদ্মমণির বংশধরেরা বাস করেন
২০ নং সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী রোডে।
জানবাজারের নিকটতম মেট্রো স্টেশন হ’ল –
এসপ্ল্যানেড।
১৭৮৫ সালে প্রথম যখন কলকাতা শহরকে ৩১ টি থানায় বিভক্ত করা হয়, তখন জানবাজার ছিল কলকাতার অন্যতম থানা।
পলাশীর যুদ্ধের পর ১৭৫৮ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়।
দুর্গ নির্মাণের জন্য গোবিন্দপুর সহ এই অঞ্চলটিকে মনোনীত করা হলে, এই অঞ্চলের অধিবাসীদের সুতানুটিতে সরিয়ে দেয়া হয়। আর কলকাতার ইউরোপীয় বসতি পুরনো এলাকার গন্ডী ছাড়িয়ে ময়দান এলাকার আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে। নতুন দুর্গের ভিতর সাধারণ মানুষের বসবাস নিষিদ্ধ হয়ে যায়। তবে লালদিঘীর দক্ষিণ ও চৌরঙ্গী রোডের পূর্বদিকের অংশটিতে ইংরেজ বসতি প্রসারিত হয়।
সেই থেকে সুতানুটি ব্ল্যাক টাউন বা ভারতীয়দের বসতি এবং এসপ্ল্যানেড ও চৌরঙ্গী হোয়াইট টাউন বা শ্বেতাঙ্গদের বসতি এলাকা নামে পরিচিতি লাভ করে।
প্রথম দিকে সেকালের জানবাজার রোড ও পার্ক স্ট্রিটের মাঝের এলাকায় প্রায় ৪০ টি ইউরোপীয়দের বাড়ি ছিল। যদিও রাইটার্স বিল্ডিং বা অধুনা মহাকরণ ; বৈঠকখানা বা বউবাজার ; ধর্মতলা ও জানবাজার অঞ্চলে পরে নিম্নবর্ণীয় হিন্দু, পর্তুগিজ, আর্মেনিয়ান প্রমুখেরা এসে বসবাস শুরু করে। ফলে এই অঞ্চলটি পুরনো কলকাতার ভারতীয় ও শেতাঙ্গ প্রধান অঞ্চলের মাঝামাঝি এলাকায় পরিণত হয়।
কলকাতা পৌর সংস্থা এলাকার ৫২ ও ৪৬ নং ওয়ার্ড দু’টি জানবাজার এলাকার অন্তর্গত।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত চৌরঙ্গী থেকে সার্কুলার রোড বা অধুনা আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু রোড পর্যন্ত এক মাইল দীর্ঘ রাস্তাটির নাম ছিল জানবাজার রোড। পরে এটির নাম হয় কর্পোরেশন রোড। অবশেষে এই নাম পাল্টে করা হয়েছে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী রোড।
একদা জানবাজার এলাকায় তেলের আলো থাকত। তারপর গ্যাসের আলো এলো – শেষতক জানবাজার এলাকার রাস্তাঘাটে দেয়া হ’ল বৈদ্যুতিক আলো।
ইতিহাস বলে, ১৯১৪ সালে কর্পোরেশন রোড ও চৌরঙ্গী রোডে এক হাজার ক্যান্ডেল পাওয়ারের কেইথ ল্যাম্প লাগানো হয়েছিল। ক্যালকাটা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কর্পোরেশন তখন নিজেদের খরচে বৈদ্যুতিক আলোর সুফল সম্পর্কে জনসাধারণকে অবহিত করতো।
জানবাজার এখন কলকাতা পুলিশের নিউমার্কেট থানার অন্তর্গত – তবে থানাটি জানবাজার এলাকায় অবস্থিত।
জানবাজারের সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী রোড একটি ব্যস্ত রাস্তা – সাধারণত এই রাস্তায় প্রচুর যানজট হয়।

ময়দান –

হুগলি নদীর তীর থেকে আজকের চৌরঙ্গী পর্যন্ত ছিল গভীর বনাঞ্চল – সেই বনাঞ্চলে ছিল বাঘের রাজত্ব। তাই  তখনকার কলকাতার গ্রামের বাসিন্দারা ওই দিকে বাঘের ভয়ে যেতে সাহস পেত না। সে কথা আজ আর কেউ মনেও করে না।
প্রায় আড়াইশো বছর আগে বাঘের জঙ্গল উজাড় করে ইংরেজরা গড়ে ছিল ময়দান, দুর্গ, ফোর্ট উইলিয়াম সহ কত কি স্থাপনা।
গড়েরমাঠ বা ময়দান হ’ল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতার বৃহত্তম নগরাঞ্চলীয় উদ্যান।
গড়ের মাঠ বিরাট একটি মাঠ।
কলকাতা ময়দান
কলকাতা মহানগরীর কেন্দ্রস্থলে এই ময়দান ৪০০ হেক্টর জুড়ে বিস্তৃত – এটি সবুজ এলাকা।
ময়দানের পশ্চিমে হুগলি নদী ; পূর্বদিকে চৌরঙ্গী এবং পার্কস্ট্রিট পর্যন্ত বিস্তৃত ;
দক্ষিণে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল আর
উত্তরে রাজভবন এবং ইডেন গার্ডেনস পর্যন্ত বিস্তৃত।
ক্রিকেট স্টেডিয়াম ইডেন গার্ডেনস ; কলকাতা রেসকোর্স ; নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়াম ;
রয়্যাল ক্যালকাটা গলফ ক্লাব ও
বেশ কয়েকটি ফুটবল
স্টেডিয়াম
এই মাঠের বা গড়ের মাঠের অংশ।
খেলার মাঠ ছাড়া ময়দানে
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল,
রাজভবন, ফোর্ট উইলিয়াম, বিদ্যাসাগর সেতু,
বিড়লা তারামন্ডল, সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল, নন্দন – রবীন্দ্র সদন চত্বর ;
পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির প্রধান কার্যালয়,
নিউমার্কেট, এশিয়াটিক সোসাইটি ভবন ;
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা ভবন,
আকাশবাণী কলকাতার কার্যালয় ও ভারতীয় সংগ্রহালয় সহ
কলকাতা মহানগরীর কয়েকটি দর্শনীয় স্থান। এই দ্রষ্টব্য স্থল হ’ল এই গড়ের মাঠের বা ময়দানের পাশে অবস্থিত।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সচিবালয় মহাকরণ, আলিপুর পশুশালা ও
ভারতের জাতীয় গ্রন্থাগারও
এই গড়ের মাঠের কাছেপিঠে অবস্থিত।
কলকাতার গড়ের মাঠে বা ময়দানে প্রচুর গাছপালা ও
খোলা মাঠ থাকায় এটিকে কলকাতার ফুসফুস বলা হয়।
ময়দান বা গড়ের মাঠটি ভারতীয় সেনাবাহিনীর সম্পত্তি।
এখানের ফোর্ট উইলিয়ামে সেনাবাহিনীর পূর্ব কম্যান্ডের প্রধান কার্যালয় অবস্থিত।
ময়দান বা গড়ের মাঠ কলকাতার অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।
অতীতে চৌরঙ্গী গ্রামসহ এই অঞ্চলটি ছিল জঙ্গলে পরিপূর্ণ – বসবাস করতো বাঘ সহ বিভিন্ন প্রজাতির ভয়ংকর পশু।
ব্যাঘ্র বা বাঘে ভরপুর জঙ্গলটি পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে নদীকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল।
অতীতে বাঘের ভয়ে ওই এলাকার আশেপাশে স্থানীয় বাসিন্দারা যেতে সাহস পেত না।
কিন্তু সেই জঙ্গলটি  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতীয় শ্রমিকদের দ্বারা কেটে পরিস্কার করে ফেলে – এরই ফলে বাঘের বসবাস স্থল চিরনির্মূল হয়ে গেল আর গড়ে উঠলো
বিস্তৃর্ণ তৃণক্ষেত্র। আর ইংরেজরা এখানে গড়ের মাঠ স্থাপন করল। সেই সঙ্গে
১৭৭৭ সালে এখানে দুর্গ নির্মাণের নির্মাণ কাজও শেষ হয়ে যায়।
ময়দানের মূল ভূখণ্ডে রাস্তা ও ট্রামলাইন ছাড়া কোনোপ্রকার নির্মাণকার্য করা হয়নি। তবে এই অঞ্চলটির আশেপাশে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনা গড়ে উঠেছে।
১৮৮২ সালে ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কর্পোরেশন চৌরঙ্গী থেকে খিদিরপুর ও কালিঘাট পর্যন্ত যে বাষ্পচালিত ট্রাম চালানো শুরু করে, তা চলতো ময়দানের উপর দিয়েই।
১৮৮৯ সালে এখানে বৈদ্যুতিক ট্রাম চলাচল শুরু হয়।
ময়দানের প্রাচীনতম রাস্তাটি হ’ল দ্য কোর্স – এটি উত্তরে ককড হ্যাট থেকে খিদিরপুর ব্রিজ পর্যন্ত প্রসারিত ছিল।
পশ্চিম দিকের ব্রড গ্র্যাভেলড ওয়াক ছিল রেড রোডের একটি অংশ। এটি নির্মিত হয় ১৮২০ সালে।
দুর্গের দক্ষিণে এলেনবরো কোর্স নির্মিত হয় অশ্ব প্রশিক্ষণের জন্য। আর এর পূর্বদিকে রেসকোর্স চালু হয় ১৮১৯ সালে।
লাটভবন বা রাজভবন নির্মিত হয় ১৮০৩ সালে। অক্টারলোনি মনুমেন্ট বা বর্তমান শহীদ মিনার নির্মিত হয় ১৮৪৮ সালে। সেন্ট পল’স ক্যাথিড্রাল নির্মিত হয় ১৮৩৯ থেকে ১৮৪৭ সালের মধ্যে।
১৯২১ সালে নির্মিত হয় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল, এটি ময়দানের এক কোণে।
কাউন্সিল হাউস স্ট্রিটে অবস্থিত ছিল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ – এই কলেজ বহুকাল আগে অবলুপ্ত হলেও বাংলা সহ একাধিক ভারতীয় ভাষার বিকাশে এর গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
ক্রিকেট স্টেডিয়াম হিসেবে ময়দানে গড়ে ওঠে
ইডেন গার্ডেনস।
পরবর্তী সময়ে নির্মিত হয় – নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়াম।
এম পি বিড়লা তারামন্ডল – এই অঞ্চলের একটি উল্লেখযোগ্য বিজ্ঞান কেন্দ্র।
রবীন্দ্র সদন, অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস এবং নন্দন এখানকার তিনটি প্রধান প্রেক্ষাগৃহ।
ময়দানের পূর্ব সীমান্তে কলকাতা মেট্রোর টালিগঞ্জ – এসপ্ল্যানেড শাখাটি নির্মাণ করতে প্রায় সাত বছর সময় লেগেছিল।
মেট্রোর ময়দান সংলগ্ন স্টেশনের সংখ্যা ৩ টি –
এসপ্ল্যানেড, পার্ক স্ট্রিট ও ময়দান।
হুগলি নদীর উপর নির্মিত দ্বিতীয় হুগলি সেতু বা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সেতু ময়দানের
একটি অংশের উপর দিয়ে নির্মিত হয়েছে।
অতীতে ময়দানে ছিল লর্ড কার্জন, কিচনার, রবার্টস, লর্ড মিন্টো ; নর্থব্রুক, লর্ড ক্যানিং ও অন্যান্য ব্যক্তিবর্গের মূর্তি।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকে পর্যায়ক্রমে ১৬ টি মূর্তি অপসারিত করা হয়।
সেই মূর্তির শূন্য বেদীতে বসানো হয়
মহাত্মা গান্ধী, রামমোহন রায়, চিত্তরঞ্জন দাশ,
জওহরলাল নেহেরু, সুভাসচন্দ্র বসু, শ্রী অরবিন্দ, মাতঙ্গিনী হাজরান,প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, ইন্দিরা গান্ধী, গোষ্ঠ পাল প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের প্রতিমূর্তি।

সোনাগাছি যাওয়ার নিয়ম

সোনাগাছি হ’ল কলকাতা মহানগরীতে অবস্থিত ভারতের বৃহত্তম নিষিদ্ধ পল্লী। এই পল্লীতে বসবাস করে লক্ষাধিক যৌনকর্মী।
এই পল্লীটি উত্তর কলকাতার মার্বেল প্যালেসের উত্তরে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, শোভাবাজার ও বিডন স্ট্রিটের সংযোগস্থলের নিকটে অবস্থিত। সোনাগাছি যাওয়ার নিয়ম সম্পর্কে অনেক কথা শোনা যায় লোকমুখে।
নিষিদ্ধ পল্লীটির যৌনকর্মীরা দুর্বার মহিলা সমন্বয় সমিতি নামে একটি সমিতির অধীনে গণস্বাস্থ্য ও
সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালায়। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি বাবু সম্প্রদায় এই সোনাগাছিতে নিজ নিজ উপপত্নীদের প্রতিপালন করতেন।
সোনাগাছি অঞ্চলের বেশ কিছু ভবন নির্মিত হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনামলে বা ব্রিটিশ যুগে।
সোনাগাছি
কথিত আছে, প্যারিসের বিখ্যাত যৌনকর্মীরাও
কলকাতার সোনাগাছি অঞ্চলের খ্যাতি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন।
শোনা যায়, তারা নাকি সোনাগাছির মেয়েদেরকে বলতো,
রূপ ও সৌন্দর্যে সেরা সোনাগাছির ললনারা। বিশ্বের বিস্ময় ওরা।
সোনাগাছি অঞ্চলটি আমার জীবনে স্মরণীয় হয়ে আছে।
বন্ধু পায়নি তার প্রিয়তমাকে জীবন সাথী রূপে।
সেই বন্ধুটি ধরল মদ –
বোতলের পর বোতল –
নিদারুণ দুঃখ নিয়ে অন্তর্জালায় জ্বলতে জ্বলতে
গিয়েছিল সোনাগাছিতে
সেখানে তার দেখা হয় আরেক চন্দ্রমুখীর সঙ্গে
যখন খুশি তখন যায়
সুখ পায় আনন্দ পায়।
বন্ধুটি আমায় নিয়ে গেল
সোনাগাছিতে
ঘটনাটি ১৯৮২ সাল হবে হয়তো
আমি যাব না, কিন্তু এক অর্থে জোরপূর্বক আমাকে
নিয়ে দেখাল তার চন্দ্রমুখীকে
আমি তো অবাক – এ তো শ্রীদেবীর মতো
সুন্দরী –
চোখের চাহনি দেখে প্রথম দর্শনে
রীতিমতো প্রেমে পড়ে গেলাম
বন্ধুটি চন্দ্রমুখীর হাতে একশো এক রূপী তুলে দিয়ে
জানালো,
আমি চললাম,
আমার বন্ধুকে আপন করে নিও।
কিন্তু চন্দ্রমুখীকে দেখে, কেমন যেন শ্রদ্ধা জেগে উঠলো আমার বিচলিত ভীরু মনের গহনে
দুয়ার দিয়ে দিল – আমি বললাম, খুলে দাও।
কথা হ’ল চন্দ্রমুখীর সঙ্গে –
জানতে চাইলাম, তোমার আসল নাম কি?
একটু হেসে – নীলাঞ্জনা
কথা দিয়েছিল সে আসবে দার্জিলিং
দিন তারিখ সব বলা ছিল –
যাবার সময় নীলাঞ্জনা বলেছিল – চলে আসবো।
নীলাঞ্জনা চিঠিতে লিখেছিল –
তুমি দেখো, সেই তারিখ মতো সকাল সকাল দার্জিলিং পৌঁছবো এসে –
গাড়িতে বা ট্রেনে আমি’ত একা নই,
আরো কত লোকইত যাবে
কোনো ভয় নেই।
পথঘাট সব চিনি,
তুমি ভাবনা কোরো না
লাল রঙের মাদ্রাজি শাড়ি জুড়িয়ে
বেণী দুলিয়ে আসব – ঠিক আসব।
কিন্তু দুর্ভাগ্য,
সেই তারিখে সকালে নয়, দুপুরে নয়
সন্ধ্যায় নয়
গভীর রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে
পৈশাচিক উল্লাসে মত্ত কয়েকজন
নীলাঞ্জনাকে রেখে গেল হোটেলের সন্মুখে
হ্যারিকেনের আলোয় তার ক্ষতবিক্ষত মুখ
দেখে আঁতকে উঠলাম
কারা এমন সর্বনাশ করলিরে –
ভষ্ম হয়ে যা তারা
বাজ পড়ুক তাদের মাথায়!
অবিরাম কাঁদতে লাগলো নীলাঞ্জনা।
যারা তাকে এনেছিল
অন্ধকারে তারা তেমনি করে পালিয়ে গেল।
এটুকু বলা হতে না হতেই
চৈত্রের আকাশ অন্ধকার করে ঘনিয়ে এলো মেঘ,
হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়া উঠলো হু হু করে
অন্ধকার আকাশের বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে
চমকে উঠলো বিদ্যুৎ!
সঙ্গে সঙ্গে –
কড় কড় কড়াৎ করে প্রচন্ড গর্জনে
কাছেই কোথাও বাজ পড়লো।
আমি দেখলাম,
বিশ্বাস কর তোমরা,
আমি যেন দেখলাম
লালটুকটুকে মাদ্রাজি পরে নীলাঞ্জনা
চৈত্রের আকাশের এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত
ছুটে বেড়াচ্ছে মশাল জ্বালিয়ে।
তারপর –
আমি সেই যে চলে এসেছি
আর যাইনি নীলাঞ্জনার সামনে
১৯৮২ সাল – তারপরে কেটে গেল ৩৯ টি বছর
নীলাঞ্জনা, তুমি কি বেঁচে আছ!
যদি বেঁচে থাকো – ঠিকানা দিও
তোমার সাথে দেখা করতে লজ্জা করে – তবুও দেখা করবো
তুমি যে আমার বোন বা ভগ্নী!