স্পেন: ইউরোপের যে দেশটি শিল্প ও সংস্কৃতির সূতিকাগার


স্পেনের প্রস্তর নির্মিত দুর্গপ্রাসাদ, হিমাবৃত পর্বতমালা, বিশালকার সৌধ এবং আধুনিক পরিশীলিতভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নগরগুলির জন্য পৃথিবীর বহু দেশ থেকে দলে দলে পর্যটকরা স্পেন ভ্রমণে যান। লিখেছেন দুই বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় ভ্রমণ লেখক লিয়াকত হোসেন খোকন

Table of Contents

স্পেনের প্রতিটি নগরী অত্যাধুনিক। এ দেশের আন্দালুসিয়া অঞ্চলের রাজধানী সেবিইয়া তার সঙ্গীতের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যবাহী জীবনযাপনের জন্য বিখ্যাত। কাতালোনিয়ার রাজধানী বার্সালোনা তার ধর্মনিরপেক্ষ স্থাপত্য ও নৌপরিবহন শিল্পের জন্য সুবিদিত। আর স্পেনের জাতীয় রাজধানী মাদ্রিদের আঁকাবাঁকা সরু পথ, জাদুঘর, গ্রন্থাগার সত্যিই দেখার মতো। তাছাড়া মাদ্রিদের জীবনধারা সক্রিয় থাকে ২৪ ঘন্টা ধরে। মাদ্রিদ স্পেনের বৃহত্তম নগরী এবং বহু শতাব্দী ধরে এ দেশটির আর্থিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।

স্পেনের আছে নিজস্ব সাংস্কৃতিক ও শিল্পকলাগত ঐতিহ্য। ঐতিহাসিক ভাবে স্পেনের মূল সাংস্কৃতিক অবদান দুইটি ক্ষেত্রে অধিক পরিলক্ষিত হয়, এ দু’টি হল – চিত্রকর্ম ও সাহিত্য।

স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদ শহরে পকেটমাররা বেশ সংঘবদ্ধ। পরিকল্পনা করেই এরা পকেট মারে। একবার রাস্তা পারাপারের জন্য কিছু পথচারীর সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছেন এক বিদেশি লোক। হঠাৎ অনুভব করলেন, কেউ যেন তার পা জড়িয়ে ধরেছে। ভাবলেন এখানে কে পা ধরবে, কেনই বা ধরবে। কয়েক মুহূর্ত ভাবতে না ভাবতেই দেখা গেল পেছন থেকে কে যেন আক্রমণ করছে। তারপরই পেছনের পকেটে কারও সন্ধানী আঙুল অনুভব করলেন। তখন চিৎকার দিয়ে উঠলেন এবং দেখলেন তার পা ছেড়ে দিয়েছে।

এদিকে একজন লোক ও তার সঙ্গী সবার আগে রাস্তা পার হয়ে গেছে ওপারে। ততক্ষণে রাস্তার সবুজ সংকেত জ্বলে উঠেছে। সেই সময়ে একজন লোক বলল, ভাই, আমি দেখলাম লোকটা একটা সিকি গোছের ছোট মুদ্রা মাটিতে ফেলে দিল। সেটা তোলার ভঙ্গিতে আপনার পা ধরেছিল, তখনই আপনার চিৎকারে বুঝলাম, পকেট কাটার আয়োজন হচ্ছিল। ভদ্রলোক পকেটে হাত দিয়ে দেখেন তার মানিব্যাগ নেই। চুরি হয়ে গেছে। স্পেনীশ এক লোক পকেট মেরে দিয়েছে।

মাদ্রিদ

আসলে স্পেনের মাদ্রিদ শহরে পকেটমাররা এমনভাবে পকেট কাটে, তা কেউ বুঝতেই পারে না। আরও মজার ব্যাপার, পথচারীরা পকেটমারদের দেখিয়ে উত্তেজিত হয়ে নানা কথা বলে স্পেনীশ ভাষায়। কেউবা সমবেদনাও জানায়। কিন্তু কেউই পকেটমারদের ধাওয়া করে না। আর পাঁচটা বড় শহরে যেমন হয় মাদ্রিদও তেমনই।

মাদ্রিদ শহরে বড় রাস্তার দু’ধারে ঐশ্বর্যের পসরা, মসৃণ রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছুটছে দ্রুত গতিতে, সবাই যেন ব্যস্ত। পাতাল রেলও আছে মাদ্রিদে। তবে মাদ্রিদ শহরে পকেটমারদের এতই উৎপাত যে, পাসপোর্ট, ডলার, মূল্যবান কাগজপত্র সঙ্গে না রাখাই ভালো। মাদ্রিদ শহরে ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটে অহরহ। মাদ্রিদ এমনই এক শহর যেখানে বের হলেও মূল্যবান সামগ্রী হোটেলে ফেলে যেতে সাহস হবে না। রাস্তাঘাটেও আছে আবার পকেটমার ও ছিনতাইকারী।

মাদ্রিদে পার্ক ও উদ্যান রয়েছে অনেক। উল্লেখযোগ্য পার্ক হলো – বৈটিবো পার্ক। বিশাল এই পার্কের একাংশে প্রতি রবিবার দুপুরে প্রায় মেলা বসে যায়। ছোট দোকানপাট, ফেরিওয়ালা, শৌখিন নাচগানের দল মেলাকে মাতিয়র রাখে। আর আসেন চিত্র শিল্পীরা। তারা ছবি আঁকেন। বিক্রিও হয় কিছু কিছু। সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকে এভাবে। মাদ্রিদে দেখবার মতো মিউজিয়ামের সংখ্যা কুড়িটিরও বেশি। তারমধ্যে পুরনো রাজবাড়ী পালাসো রিয়াল উল্লেখযোগ্য। এখানে সবকিছু দেখবার মতো। সোফিয়া মিউজিয়ামটিও দেখার মতো। প্রাসাদটি অষ্টাদশ শতাব্দীর। পিকাসো, দালি ও মিরোর শিল্পকীর্তি রয়েছে এই মিউজিয়ামে। পিকাসোর বিশ্বখ্যাত গুয়ের্নিকা এখানেই রয়েছে।

স্পেনের আন্দালুসিয়ায় গেলে দেখবেন মুসলমানদের বহু কীর্তি। মুসলমানদের তৈরি মসজিদ ও বিশাল বিশাল অট্টালিকা রয়েছে এখানে।

স্পেনের কর্ডোভা শহর গুয়াদালকুইভি নদীর তীরে অবস্থিত। এর আশেপাশে রয়েছে ছোট ছোট পাহাড়। একদা এক হাজার মসজিদ, দু’শ স্নানাগার ছিল কর্ডোভায়। কর্ডোভার প্রধান দর্শনীয় স্থান হলো – মস্কক্যাথিড্রাল এবং মসজিদ -গীর্জা। এখানে ক্যাথিড্রাল আর মসজিদের পার্শ্বেই ইহুদিদের এলাকা। এখানে দু’তলা -তিনতলা ছোট ছোট বাড়ি। সরু রাস্তা, তারই মধ্যে আরও ছোট পার্ক।

স্পেনের গ্রানাডা শহরে আরব প্রভাব এখনও অটুট। শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতি মনোরম। নাতিউচ্চ পাহাড়ের গা নেমে শহরটা যেন ঢালের মতো নেমে এসেছে পাহাড়ের গা বেয়ে ঘন বসতি অঞ্চলে। এখানে পাহাড়ের মাথায় বড় বড় গাছ, নিচে প্রসারিত গ্রানাডা শহর। এই শহরে রয়েছে দশটি মিউজিয়াম, যা গ্রানাডা আর স্পেনের ইতিহাসকে সযত্নে লালন করছে।

একদা উত্তর আফ্রিকা থেকে আগত মুসলমান বার্বার জাতির লোকেরা প্রায় ৮০০ বছর ধরে স্পেনে শাসন করে। তখন তারা এখানে সূক্ষ্ম স্থাপত্য, গীতিকবিতা এবং জ্ঞান বিজ্ঞানে ব্যাপক অবদান রেখে যায়। তা তৎকালীন অন্ধকার অসভ্য -বর্বর ইউরোপীয়দের মধ্যে জ্ঞানের বিস্তার করেছিল। তখন সেই ইসলামি শাসনামলে স্পেনে স্থাপিত প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান ও বিজ্ঞানের কেন্দ্র ছিল যা পুরো বিশ্বকে নেতৃত্ব দিত।

স্পেনের জিপসিরা কান্তে হোন্দো নামের একধরনের ফ্লামেংকো ঘরানার গা ছমছম করা সঙ্গীতের উদ্ভাবন করে – যা ছিল অসম্ভব জনপ্রিয়।

স্পেনের প্রথম দিকের আদিবাসীরা মূলত কেল্ট ও আইবেরিয়রা। এক দীর্ঘমেয়াদি ও প্রবল যুদ্ধের পর আইবেরিয় উপদ্বীপ রোমান রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং পরিচিত হয় হিসপিনিয়া নামে। মধ্যযুগের প্রথম দিকে এটি জার্মান শাসনাধীনে গেলেও পরবর্তীকালে মুসলিমরা দেশটি জয় করে। অবশেষে মুসলিম শাসনের অবসানের পর এ দেশ চলে যায় খ্রিষ্টানদের হাতে।

খ্রিস্টানরা শাসনভার নিয়ে স্পেনকে ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করে। ১৬শ শতাব্দী থেকে ১৭শ শতাব্দীর অর্ধভাগ পর্যন্ত স্পেন ছিল পৃথিবীর অন্যতম প্রধান পরাশক্তি।

স্পেনের প্রদেশগুলো সেই পুরনো আমল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে।

বিশেষ করে বাস্ক প্রদেশ ও কাতালোনিয়ার লোকজন নিজেদেরকে স্পেনীয়র পরিবর্তে বাস্কগোত্রীয় ও কাতালোনীয় ভাবতেই বেশি পছন্দ করে। মাদ্রিদ রাজধানী হলেও স্পেনের অর্থনীতি, ব্যবসা বাণিজ্য, শিল্পকলা ও ক্রীড়াক্ষেত্রে কাতালোনিয়ার রাজধানী বার্সেলোনা এর শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী।

palace 1910258 1280 min 1
প্যালেস কাসল, স্পেন।

স্পেনে স্পেনীয় ভাষা ছাড়াও প্রদেশভেদে আরও ৪টি ভাষাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।

এ ভাষাগুলি হলো – কাতালান, গালিসীয়, বাস্ক এবং অক্সিতঁ।

স্পেনের জনসংখ্যা ৮ কোটি ২৮ লাখ। এ দেশের অধিকাংশ মানুষ মুলতঃ কাস্তিলীয় স্পেনীয় জাতের।

স্পেনের শতকরা ৯৬ ভাগ মানুষ ক্যাথলিক খ্রিস্টান।

ফুটবল স্পেনের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা।

ইউরোপ মহাদেশের দক্ষিণ -পশ্চিম কোণে স্পেন দেশটি অবস্থিত। এটি ইবেরীয় উপদ্বীপের প্রায় শতকরা ৮৫ ভাগ অঞ্চল জুড়ে অবস্থিত। উপদ্বীপটির অবশিষ্ট অংশে স্পেনের ক্ষুদ্রতর প্রতিবেশী রাষ্ট্র পর্তুগাল এবং ব্রিটিশ প্রশাসনিক অঞ্চল জিব্রালটার। স্পেনের সর্বমোট আয়তন ৫,০৫,৯৯০ বর্গকিলোমিটার। আয়তনের হিসেবে রাশিয়া, ইউক্রেন ও ফ্রান্সের পরে স্পেন ইউরোপের চতুর্থ বৃহত্তম এবং দক্ষিণ ইউরোপের বৃহত্তম দেশ।

স্পেনের উল্লেখযোগ্য শহরগুলি হলো – মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, বালেন্সিয়া, সেবিইয়া, বিলবাও, মালাগা ইত্যাদি।

স্পেন এক একসময় একেক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। তা হলো – ১৪৬৯ খৃষ্টাব্দে ইউনিয়ন অফ কাস্টাইল আরাগণ সাম্রাজ্য ; ১৪৯৬ খৃষ্টাব্দে হলি রোমান সাম্রাজ্য।

স্পেন হলি রোমান সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীনতা লাভ করে ১৭০০ খৃষ্টাব্দের ১ নভেম্বর।

প্রায় ৩০০ বছর ধরে স্পেনীয় অভিযাত্রী এবং যোদ্ধারা বিশ্বের আনাচে কানাচে ভ্রমণ করে এবং স্পেনীয় রাজার জন্য বিশাল আয়তনের ভূখণ্ড অধিগ্রহণ করে। আমেরিকা মহাদেশ থেকে লুটকৃত ধনসম্পদের জন্য স্পেন ইউরোপের সবচেয়ে ক্ষমতাধর শক্তিতে পরিণত হয়। স্পেনীয় সৈনিক এবং ধর্মযাজকেরা বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অংশবিশেষ ও মেক্সিকো থেকে শুরু করে এবং দক্ষিণ চিলি পর্যন্ত স্পেনের উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। সেই সময়ে তারা আমেরিকার বিভিন্ন দেশে স্পেনীয় ভাষা ও সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিয়েছিল।