রাখী গুলজার যেভাবে মাতিয়ে ছিলেন বোম্বে তা এখন ইতিহাস। নাম তাঁর ‘রাখী মজুমদার’। তবে তাঁকে সবাই ‘রাখি গুলজার’ নামেই চেনেন – জানেন। তাঁর খ্যাতি ‘রাখি গুলজার’ নামেই। বাঙালি মেয়ে রাখীর অভিনয় জীবন শুরু হয়েছিল কিন্তু কলকাতার বাংলা ছবি দিয়েই সেই ‘বধূবরণ’ – এর মাধ্যমে। লিখেছেন লিয়াকত হোসেন খোকন।
১৯৬৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই বধূবরণ ছবিতে তাঁর সহ শিল্পীরা ছিলেন – প্রদীপ কুমার, ভারতী দেবী, বিকাশ রায়, অজয় বিশ্বাস, গীতালী রায়, অভি ভট্টাচার্য প্রমুখ। ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন দিলীপ নাগ।
এই ছবির পরে ‘বাঘিনী’ ছবিতে করে রাতারাতি রাখী হয়ে গেলেন স্টার………..ডাক এলো বোম্বে থেকে। বঙ্গনায়িকা হিসেবে রাখী অভিনয় করেছিলেন একের পর এক হিন্দি ছবি – রেশমা অউর শেরা, শর্মিলী, লাল পথ্বর, ইয়ার মেরা, জানোয়ার অউর ইনসান, বেইমান, আঁখো আঁখো মে, হীরা পান্না, ব্ল্যাকমেল, বনারসিবাবু, দাগ -ইত্যাদিতে।
তারপরই গুলজারের সঙ্গে বিয়ে হলো রাখীর। তখন চলচ্চিত্র থেকে সরে দাঁড়ালেন রাখী গুলজার। বিয়ের প্রায় দেড় বছর পরে ওঁদের কন্যা সন্তান হলো,
নাম রাখলেন – ‘মেঘনা’ ওরফে ‘বসকি’। ঘরে বসে বসে পাঁচটি বছর কাটানোর পর স্বামীর বাধা না মেনে আবার ফিল্ম জগতে যোগ দিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন রাখী । আর তখনই স্বামীর সঙ্গে দেখা দিল মতভেদ, হয়ে গেলেন আলাদা ………. ।
এদিকে রাখি গুলজার আবারও হিন্দি ছবির জগতে একের পর এক -তপস্যা, কভি কভি, কসমে ওয়াদে, ত্রিশূল, মুকাদ্দার কা সিকন্দর, জুর্মানা, বরসত কি এক রাত, কালা পথ্বর, শ্রদ্ধাঞ্জলি, বসেরা, বেমিশাল, শক্তি, পরমা, বাজিগর , করন অর্জুন -ইত্যাদি ছবিতে অভিনয় করলেন।
১৯৭৬ সালের পর থেকে নায়ক হিসেবে তাঁর নামের পাশে দেখা দিয়েছিলেন দেব আনন্দ, শশী কাপুর, রাজেশ খান্না, ধর্মেন্দ্র, বিনোদ খান্না, বিনোদ মেহরা, অমিতাভ বচ্চনের মতো সুপারস্টাররা।
১৯৭০ এর দশকের শেষদিকে প্রশ্ন উঠেছিল, মীনা কুমারী যেখানে শেষ করেছিলেন, রাখী কি সেখান থেকেই শুরু করেছেন?
দুসরা আদমী, ত্রিশূল আর তৃষ্ণা ছবি তিনটিতে রাখীর অভিনয় দেখলে এ কথাটাই সেদিন মনে হতো। বিশেষকরে তৃষ্ণা ছবিতে তো রাখী গুলজার একাই গোটা ছবিটা টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন।
অথচ সে ছবিতে তাঁর সঙ্গে ছিলেন সঞ্জীব কুমারের মতো খ্যাতনামা অভিনেতা। তৃষ্ণা ছবির প্রতিটি দৃশ্যে রাখী অসাধারণ অভিনয়ের ছাপ রেখে ছিলেন।
রাখী যখন নায়িকা ছিলেন, সেই সময়ে সুপারস্টার হিরোইনের থেকে তিনি কিছুটা আলাদা ছিলেন। মেকআপ সেরে ঠিক সময়ে সেটে হাজির হওয়া রাখীর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল। নিজের শরীরকে কষ্ট দিয়ে ডবল বা ট্রিপল শিফটে কাজ করতে রাখী কখনোই রাজী থাকতেন না। পেছনে একটাই কারণ ছিল, তাঁর মেয়ে বসকীকে একটু বেশি সময় দেওয়া।
একসময়ে পত্রপত্রিকায় প্রকাশ হলো, মীনা কুমারীর পরে রাখী গুলজার হলেন ট্র্যাজেডি কুইন। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করে তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘আমি ট্র্যাজেডি কুইন নই’।
সেদিন এই রাখি কমার্শিয়াল ছবির পাশাপাশি সমান্তরাল ছবিতেও সমান দাপটের সঙ্গে অভিনয় করে প্রমান করে দিয়েছিলেন তাঁর অভিনয় প্রতিভা। তাঁর চেহারার মধ্যে খানিকটা মঙ্গোলিয়ান সৌন্দর্য থাকলেও বাঙালিয়ানা ভাব লক্ষনীয়। বেড়াল চোখ, গোল মুখ আর এরই মাঝে রয়েছে মুক্তছড়া হাসি……….
আর এই মেয়েটির জন্ম হয়েছিল বাঙলার নদীয়া জেলার রানাঘাটে সেই ১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগষ্ট। আর ওই দিনই ভারত স্বাধীনতা লাভ করেছিল। স্কুল জীবন কেটেছে তাঁর স্থানীয় বালিকা বিদ্যালয়ে। রাখীর পৈতৃক নিবাস ছিল পূর্ব বাংলায়…………. ভারত স্বাধীনতা লাভের আগেই ওঁর বাবা চলে আসেন নদীয়ার রানাঘাটে।
আরও পড়ুন: হৃদয় স্পর্শ করা মহাতারকা অমিতাভ বচ্চন
রাখীর প্রথম বিয়েও সুখের হয়নি…… প্রথম স্বামী অজয় বিশ্বাস ছিলেন সাংবাদিক ও চিত্র পরিচালক। অনেকে মনে করেন, রাখির জীবনটা বুঝি মীনাকুমারীর মতো বেদনাময়……….. । আবার কেউবা বলেন, উঁনি মীনাকুমারীর মতো মদ খেতে শেখেননি বলে আজও রাখিজি সুস্থ – সুন্দর জীবন কাটাচ্ছেন।
চার দশকব্যাপী সুদীর্ঘ চলচ্চিত্র জীবনে রাখী গুলজার নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন। তিনি কয়েকবার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার ও একবার জাতীয় পুরস্কার লাভসহ অনেকগুলো পুরস্কার পেয়েছেন।
রাখী অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবি হল –
১৯৭০ এর দশকে – জীবন মৃত্যু, শর্মিলী, রেশমা আওর শেহেরা, পরস, আনোখি পেহচান, আনবান, বেঈমান, জানোয়ার আওর ইনসান, শাদী কে বাদ, ওয়াফা, হীরাপান্না, দাগ, ব্ল্যাকমেইল, বানারসি বাবু, জোসিলা, পাগলী, কভি কভি, দোসরা আদমী, মোকাদ্দার কা সিকান্দার, চামেলি মেমসাহেব, হামারে তুমহারে -প্রভৃতি।
১৯৮০ এর দশকে রাখী গুলজার অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবি হল – লুটমার, আঁচল, হাম কদম, শান, রকি, লেওয়ারিশ, ধূন, বরষাত কি এক রাত, অনুসন্ধান, বশেরা, শ্রদ্ধাঞ্জলী, শ্রীমাণ শ্রীমতী, তকত, শক্তি, আনন্দ আওর আনন্দ, পরমা, জিন্দেগী জেনে কে লিয়ে, সাহেব, আম্মা, জিন্দাগানী, মোকাদ্দার কি ফয়সালা, গোল্ড মেডেল, মেরে বাদ, রাম লক্ষ্মণ, প্রতীক – প্রভৃতি।
১৯৯০ এর দশকে রাখী গুলজার অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবি হল – জীবন এক সংঘর্ষ, সৌগন্ধ, প্রতিকার, খল নায়ক, দিল কি বাজী, আনাড়ি, বাজিগর, করন অর্জুন, কিসমত, জান, বর্ডার, জীবন যুদ্ধ, বারুদ, সোলজার, বাদশা – প্রভৃতি।
২০০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবি হল – এক রিস্তা, তালাস, দিল কা রিস্তা, শুভ মহরত, নির্বান – ইত্যাদি।
রাখী গুলজারের একটি বায়োগ্রাফি দেখুন এখানে