নীল নদ : যেসব বৈশিষ্ট্য অন্য কোথাও নেই শুধু এখানে আছে


নদী বা নদের পানি নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশে -মহাদেশে চলে আসছে বিরোধ, সংঘাত, সংঘর্ষ – এমনকি যুদ্ধ পর্যন্ত গড়িয়েছে। নীল নদের কথাই বলা যাক, নীল নদের পানি নিয়ে বহু যুগ ধরে পূর্ব আফ্রিকা এবং আফ্রিকার শৃঙ্গভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে চলছে বিরোধ। বিশেষ করে ইথিওপিয়া দেশটি তাদের দেশের মধ্যে বাঁধ দিয়ে মিশরের  সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি করে রেখেছে। এছাড়া নীল নদের পানি না পাওয়া নিয়ে উগান্ডা, সুদান, কেনিয়া সহ আরও কয়েকটি দেশ তাদের পানি সম্পদের ওপর মিশরীয় আধিপত্য নিয়ে অভিযোগ করে আসছে বহু বছর ধরে।

নীল নদের পানি না পাওয়া দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়েও তাদের ন্যায্য দাবী আজ পর্যন্ত পানি আদায় করতে পারেনি। তবে মিশর এককভাবে নীল নদের পানি ব্যবহার করে আসছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। যা কি-না জলসম্পদ নিয়ে আফ্রিকা মহাদেশের নীল নদের উপর নির্ভরশীল দেশগুলো বিশেষ করে যে সকল দেশগুলো পানি পাচ্ছে না তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকান্ডে বাধাগ্রস্ত করে যাচ্ছে। যে জন্য নীল নদের পানি নিয়ে বিরোধ চলছে এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের। এ বিরোধ কোনো দিন মিটমাট হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

পৃথিবীর দীর্ঘতম নদী ‘নীল নদ’ – নীল নদ নিয়ে আছে কত কল্পকাহিনি। এই নদের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যা পৃথিবীর অন্য কোন নদ -নদীর নেই। নীল নদের উৎপত্তিস্থল থেকে শেষ প্রান্তের প্রশস্তা ঠিক একই রকম। নদীর জলধারা প্রবাহিত হয়েছে বড় বড় পাথর ও বালুময় প্রান্তরের উপর দিয়ে। নীল নদের মধ্যে নেই কোন শ্যাওলা ও ময়লা আবর্জনার স্তূপ। এই নদের তীর দখল করে কেউ বাড়িঘরও নির্মাণ করে না। কেউ এই নদে ময়লা আবর্জনা ফেলার কথা ভাবতে পারে না। মিশরের এই নীল নদকে মিশরীয়রা নিজেদের প্রাণ সম ভালবাসা দিতে জানে। যে জন্য নীল নদের পানি সাদা ধবধবে।

মজার ব্যাপার, নীল নদের অভ্যন্তরে থাকা কোন পাথর বা কংকর সবুজ বা কালো রং – এর কোনটাই হয় না। পাথর যেমন ঠিক তেমনই রং ধারণ করে আছে অনাদিকাল ধরে। মিশরীয়রা প্রকৃতিকে ভালবাসা দিতে জানে ব’লেই নীল নদের প্রশস্তা ও দীর্ঘতা বিন্দুমাত্র কমেনি। যেমন ছিল তেমনটিই রয়ে গেছে নীল নদ। নীল নদের শাখা নদীগুলির পানি যখন কমে যায়, এ নদের পানি তখন বেড়ে যায়। আবার অন্যান্য নদীর পানি বৃদ্ধি পেলে তখন আবার নীল নদের পানি কমে যায়।

নীল নদের পানিকে বলা হয়, নীলাভ – এই নীলাভ নীলের সাথে সঙ্গমের নীচে একমাত্র প্রধান উপনদী হল আতবারাহ নদী, যা কি-না লোহিত নীল নামেও পরিচিত। সমুদ্রের দিকে প্রায় অর্ধেক পথ, এটি তানা হ্রদের উত্তরে ইথিওপিয়াতে উৎপন্ন হয়েছে। আতবারাহ নদীটি প্রায় ৫০০ মাইল দীর্ঘ। ইথিওপিয়ায় বৃষ্টিপাত হলেই কেবল আতবারাহ নদী প্রবাহিত হয়ে থাকে। অন্যান্য মৌসুমে নদীটি শুকিয়ে থাকে।

নীলাভ নীল নদ ইথিওপিয়ার পার্বত্য অঞ্চলের তানা হ্রদ থেকে উৎপন্ন হয়েছে। নীলাভ নীল খার্তুমে প্রায় ১৪০০ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে চলে গেছে। এরই এক জায়গায় এসে নীলাভ নীল এবং শ্বেত নীল মিলিত হয়ে নীল নদ গঠন করেছে। নীল নদ দ্বারা প্রবাহিত পলির ৯৯ শতাংশ ও ৯৬ শতাংশ পরিবাহিত পলি ইথিওপিয়াতে উৎপন্ন হয়েছে। তবে এর ৪৯ শতাংশ পানি নীল নদ থেকে এসেছে।

egypt 7175473 1280

প্রাচীন মিশরীয় ভাষায়, নীল নদকে বলা হয় হ্যাপি। আর এর অর্থ হলো নদী। কপটিক ভাষায় বলা হয় পিয়ারো, আর এর অর্থও হল নদী। মিশরীয় আরবিতে নীল নদকে বলা হয় আন -নীল। বাইবেলের হিব্রুতে, এটিকে বলা হয়েছে, হা -শিহোর। হোসিওড তার থিয়োগনিতে নীলাসকে পোটামোই অর্থাৎ নদীর দেবতা, অকেয়ানোস এবং তেথুসের পুত্র হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

ভিক্টোরিয়া হ্রদ ও ভূমধ্যসাগরের অঞ্চলের মধ্যে প্রায় ৬,৬৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য সহ, নীল নদ পৃথিবীর দীর্ঘতম নদীগুলোর মধ্যে একটি। নীল নদের দু’টি উপনদ রয়েছে, এ দু’টি হল – শ্বেত নীল নদ ও নীলাভ নীল নদের। এর মধ্যে শ্বেত নীল নদ দীর্ঘতর। শ্বেত নীল নদ আফ্রিকার মধ্যভাগের হ্রদ অঞ্চল হতে উৎপন্ন হয়েছে। এর সর্বদক্ষিণের উৎস হল দক্ষিণ রুয়ান্ডাতে। এটি এখান থেকে উত্তর দিকে তানজানিয়া, ভিক্টোরিয়া হ্রদ, উগান্ডা ও দক্ষিণ সুদানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। আর নীলাভ নীল নদ ইথিওপিয়ার তানা হ্রদ থেকে উৎপন্ন হয়ে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে সুদানে প্রবেশ করেছে। এই উপ নদী দু’টি সুদানের রাজধানী খার্তুমের নিকট মিলিত হয়েছে।

নীল নদ যেসব দেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, সেই দেশসমূহ হল – ইথিওপিয়া, সুদান, মিশর, উগান্ডা, গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, কেনিয়া, তানজানিয়া, রুয়ান্ডা, বুরুন্ডি, দক্ষিণ সুদান, ইরিত্রিয়া।

নীল নদের তীরে গড়ে উঠেছে কায়রো, জিনজা, জুবা, খার্তুম প্রভৃতি নগর।

নীল নদের দৈর্ঘ্য ৬,৮৫৩ কিলোমিটার অর্থাৎ ৪,২৫৮ মাইল। নদের প্রস্থ ২ মাইল বা ২.৮ কিলোমিটার। নীল নদের উত্তরাংশ সুদানে শুরু হয়ে মিশরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, এর প্রায় পুরোটাই মরুভূমির মধ্য দিয়ে চলে গেছে।

মিশরের সভ্যতা প্রাচীনকাল থেকেই নীল নদের উপর নির্ভরশীল। মিশরের জনসংখ্যার অধিকাংশ এবং বেশির ভাগ শহরের অবস্থান আসওয়ানের উত্তরে নীল নদের উপত্যকায়। প্রাচীন মিশরের প্রায় সকল সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাও এর তীরেই অবস্থিত। বিশাল ব -দ্বীপ সৃষ্টি করে নীল নদ ভূমধ্যসাগরে গিয়ে মিশেছে। 

আরও পড়ুন: বরফ ঢাকা দুর্গম পথ হয়ে নুব্রা উপত্যকায়

নীল নদের বিচিত্র রূপ – নীল নদের পলিমাটি নিযেই মিসর দেশ। আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিক ভৌগোলিক হেরাডোটাস বলেছিলেন, ‘মিসর তো একটা দেশ নয়, মিসর যেন একটি নদী। নীল নদের নাম ‘নহর -আন নিল’।

nile 4811801 1280 min

নীল নদের যে বাৎসরিক বন্যা ইজিপ্টের জীবনকাঠি, মরণকাঠি। আর জলভাগের বেশিটা যোগায় এই নদটি। নীল নদের পানির রং নীল -কৃষ্ণ। এটি বয়ে গেছে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত। এ নদ অঞ্চলে বৃষ্টিপাত খুবই অল্প। উষর বন্ধুর মরুপ্রান্তরের মাঝখান দিয়ে একটি জলস্রোত বয়ে চলেছে, যার দু’পাশে সবুজের ছোপ, তৃণভূমি, চাষ -আবাদ, গ্রাম জনপদ। আবার এই সবুজের প্রান্তর পার হলেই দু’পারে ধূধূ মরুভূমি,

বালির পাহাড় মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। খার্তুম থেকে উত্তর সুদানের দু’হাজার কিলোমিটার পথ মাড়িয়ে নীল নদ প্রবেশ করেছে ওয়ার্দি হালফাতে –

যেখানে আসোয়ান হাই ড্যাম হওয়ার আগে নীলের পঞ্চম ক্যাটারাক্টটি ছিল। এখন এই ক্যাটারাক্ট লেক নাসেরের গভীরে মিলে গেছে। ক্যাটারাক্ট ইংরেজি শব্দ। এর মানে হলো, যেখানে জলপ্রবাহ পাথর কেটে উঁচু থেকে নিচে নেমে আসছে। যে জন্য নৌকা, জাহাজ কিংবা অন্য কোনো জলযান এই বাধা অতিক্রম করতে পারে না। ক্যাটারাক্টের দুস্তর বাধার জন্যই সেই ফারাওদের আমল থেকে নেপোলিয়ানের বাহিনী পর্যন্ত কেউ নীল নদ হয়ে আসোয়ানের দক্ষিণে যেতে পারেনি। এ অগম্য বাধা প্রথমে দূর করেন ১৯ শতকের প্রথম দিকে অটোমান খেদিভ মোহাম্মদ আলীর ছেলে ইব্রাহিম। অপরিমিত লোকবল নিয়ে তিনি তার নৌকাগুলো ক্যাটারাক্টের পাশ দিয়ে টেনে -হিঁচড়ে নাব্য অংশে নিয়ে আসেন। পৃথিবীর ইতিহাসে সুবিখ্যাত এই নদটির উৎসের সন্ধান পাওয়া যায় এরপর থেকেই।

প্রাচীন বিশ্বের বিস্ময়গুলোর মধ্যে টিকে আছে কেবল পিরামিড – এর অনেক নীল নদের তীরে তীরে রয়েছে। নীল নদের তীরের পিরামিডগুলো দেখে যে কারো মনে প্রথমেই যে প্রশ্ন জাগবে, তা হলো – এত আগে অনুন্নত প্রযুক্তির যুগে এত বড় বড় স্থাপনা কীভাবে বানাল মিশরীয়রা। নীল নদে জলযানে বসে পিরামিডগুলো দেখে যে কেউ অভিভূত হয়ে পড়েন। একদিকে পিরামিড আর এই নীল নদ যে কোনো পর্যটকের চোখে গোলক ধাঁধা লাগিয়ে দেয়।