জেনারেল ওসমানী : সহকারীর স্মৃতিচারণে বেরিয়ে এল কিছু অজানা তথ্য


মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক বঙ্গবীর জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী মন্ত্রীসভায় থাকাকালীন তাঁর সহকারী ব্যক্তিগত সচিব ছিলেন শাহনূর চৌধুরী। বর্তমানে তিনি যুক্তরাজ্যের এডিনবরা শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। সেখানে স্থানীয় বাঙ্গালী কমিউনিটি সংঘটনে তিনি নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রেখেছেন। যুক্তরাজ্যের স্থানীয় সরকারের সাথে  কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। এখন বিভিন্ন দাতব্য সংস্থার হয়ে কাজ করছেন। স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবরায় এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বদরুল হোসেন বাবু

Table of Contents

প্রশ্ন: জেনারেল ওসমানীর সহকারী ব্যক্তিগত সচিব হিসাবে আপনি কখন নিয়োগ পান?

শাহনূর চৌধুরী: জেনারেল ওসমানী সাহেব ১৯৭০ সালে আওয়ামীলীগ থেকে পাকিস্থান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তারপর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ  এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর আরও কয়েক মাস তিনি অবৈতনিকভাবে C in C’র দায়িত্ব পালন করেন। এরপর নিয়মিত সামরিক বাহিনীর কাছে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। তখন শফিউল্লাহ সাহেব চীফ অব ষ্টাফ নিয়োগপ্রাপ্ত হন। জেনারেল ওসমানী সাহেব ১৯৭২ সালে বেসামরিক বিমানমন্ত্রী পরে ডাক ও তার যোগাযোগ মন্ত্রণালয় তাঁর হাতে দেয়া হয়। ১৯৭৩ সালের মার্চে আবার নির্বাচন হলে তিনি সিলেটের বালাগন্জ-ফেঞ্চুগন্জ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর তিনি দুইটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকাকালীন ১৯৭৩ সালের মার্চ থেকে আমাকে তাঁর সহকারী ব্যক্তিগত সচিব হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়। উনি বিশাল বাড়ীতে একা থাকতেন। যতদূর মনে পড়ে ৮-৯ বেডরুমের বাড়ী ছিল। আমাকে বললেন তুমি এখানেই থাক। আমিও সেখানেই থাকতে শুরু করি। এরপর থেকে বলতে পারেন আমি সার্বক্ষনিক উনার সাথেই ছিলাম। ওসমানী ছিলেন বেসামরিক বিমান চলাচল এবং ডাক, তার ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে।

জেনারেল_ওসমানী_সহকারী_শাহনূর_চৌধুরী
শাহনূর চৌধুরী ও বদরুল হোসেন বাবু

প্রশ্ন: মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ব্যক্তিজীবনে ওসমানীকে কীভাবে দেখেছেন?

উনি অনেক বড় মনের মানুষ ছিলেন। একটি উদারন দেই। উনার বাড়ীতে যে লোকই আসত বলতেন খাবার দাও। সে সময় প্রায় প্রতিদিনই বাড়িতে উপস্থিত থাকতেন প্রায় ২০-২৫ জন লোক। উনার পাচক ছিলেন আর্মি থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত। তিনি একদিন আমাকে এসে বললেন স্যার, খাওয়াব কি দিয়ে। জাহাঙ্গীর (কেয়ার টেকার) মাংস নিয়ে এসেছে দুই কেজি। এত লোককে তো খাওয়ানো যাবে না। আমি কি গায়ের মাংস কেটে তাদের খাওয়াব?

 আমি ওসমানীর কাছে সেই প্রসঙ্গ ওঠাতেই তিনি মাথা নাড়লেন। বললেন দুপুরের সময় যারা এসেছে তাদের তো না খাইয়ে আমি বিদায় করতে পারব না। বাজেট সীমিত। তিনি বললেন, বাজার থেকে ডাল-সবজি এগুলো নিয়ে আসেন। এসব দিয়েই খাওয়ান।

সেসময় খাদ্যমন্ত্রী ছিলেন ব্যারিষ্টার আমীরুল ইসলাম। তার সচিবের কাছে আমাদের আবেদনটি পৌঁছালাম। বিষয়টি একসময় ওসমানী জানতে পারলেন। এটা জেনে তিনি রেগে গিয়েছিলেন। তিনি টেলিফোনে বলে দিলেন আমরা যে কয়জন আছি সে কয়টি রেশন কার্ড দিতে। এর চেয়ে একটিও যাতে বেশি না দেয়া হয়। পরে রেশন কার্ড নিয়ে আমরা যখন খাবার আয়োজন করতাম তা দিয়ে সবার সংকুলান হত না। কারন ৩-৪ জনের চাল দিয়ে তো ২০-২৫ জনকে খাওয়ানো সম্ভব না। পরে আমরা খোলা বাজার থেকে বেশি দামে চাল-ডাল কিনে আনতাম। টাকা ওসমানী নিজের উপার্জন থেকে দিতেন।

প্রশ্ন: ওসমানী পদত্যাগ করার পর কী করেছিলেন?

শাহনূর চৌধুরী: যেদিন বাকশাল বিল সংসদে পাশ হয় সেদিনই ওসমানী সংসদ সদস্যপদ এবং মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। খুব সম্ভবত সাড়ে তিনটা বাজে তখন। প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টিতে ভিজেই সরকারী গাড়ী ব্যবহার না করে রিকশা ডেকে বাসায় চলে আসেন ওসমানী।

তারপর ফোন দিলেন তাঁর আত্মীয় মুসলেহ উর রহমান ওসমানী (এম আর ওসমানী) সাহেবের কাছে। তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের ডিজি ছিলেন তখন। থাকতেন ইস্কাটন রোডে অবস্থিত সাগরিকায়। যেখানে সেক্রেটারী লেভেলের অফিসাররা থাকতেন। জেনারেল ওসমানী তাকে ফোন করে বললেন, আমার তো থাকার জায়গা নেই। চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। এম. আর. ওসমানী বললেন, গাড়ী পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনি চলে আসেন।

ছোট গাড়ি দিয়ে প্রায় ২০ বার আনা নেওয়া করে ওসমানীর যাবতীয় ব্যক্তিগত মালামাল স্থানান্তর করা হয়। মন্ত্রীসভা থেকে ইস্তফা দিয়ে তিনি একদিনও সরকারী বাসায় অবস্থান করেননি। এটা অত্যন্ত অস্বাভাবিক ঘটনা। যিনি ছিলেন দুইটি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য। কেউ তাকে পদত্যাগ করার জন্য বলেননি। সরকারী বাড়ী ছেড়ে দিতে বলেননি। তারপরও অত্যন্ত দ্রুত তিনি সব ছেড়ে দেন। নির্লোভ কাকে বলে এটা তার একটি বড় উদাহরণ। এরকম ছোট ছোট ঘটনা দিয়েই আপনারা ওসমানী কেমন লোক ছিলেন তার মূল্যায়ন করতে পারবেন।

প্রশ্ন: ওসমানী মেজর জিয়াউর রহমানের সাথে নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন। অবসরে থেকেও তিনি সেই নির্বাচনের ব্যয় নির্বাহ করেছিলেন কিভাবে?

শাহনূর চৌধুরী: উনি ইলেকশন করেছিলেন নাগরিক ঐক্য তথা আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে। বলতে পারেন আওয়ামীলীগের প্রার্থী। তখন উনারও টাকা নাই, দলেরও নাই। বড় বড় ব্যবসায়ীরা টাকা দিবেন এরকম ব্যবস্থাও তখন ছিলনা। শেষ পর্যন্ত উনার গ্রামের বাড়ীতে পৈত্রিকসূত্রে পাওয়া কিছু জমি ছিল। সেই জমিগুলো বিক্রি করেছিলেন। যদিও তখনকার সময়ে জায়গা জমির দাম অত্যন্ত কম ছিল। তাই বাড়ির ভিটে রেখে বাকি সব জমি উনি বিক্রি করে দিয়েছিলেন। তখন আমি তাকে বলেছিলাম জমিগুলো থেকে যে কয়মন ধান পেতেন এখন থেকে তাও পাবেন না। তিনি বলেছিলেন যা হওয়ার হবে। তখন তার একমাত্র আয়ের উৎস ছিল পেনশন থেকে পাওয়া পনেরশ কিংবা আড়াই হাজার টাকা (সঠিক অংক আমার মনে নেই)। তিনি বলেছিলেন আমার পেনশনের টাকাই যথেষ্ট। আমি আর কতঠুকু ভাত খাই!

প্রশ্ন: জনসাধারণের সাথে তার সংশ্লিষ্টতা কী রকম ছিল?

শাহনূর চৌধুরী: মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে ওসমানী খুবই সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। চলাফেরা করতেন বাসে-ট্রেনে। যদিও তিনি মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ছিলেন। একটি শোনা গল্প বলছি। একবার ঢাকা থেকে সিলেটগামী বাসে ওসমানী বসে আছেন। বাস ছাড়ার অপেক্ষায়। একজন যাত্রী এসে তাকে বললেন, আপনাকে দেখতে তো জেনারেল ওসমানীর মত মনে হয়! এ কথায় কিছুটা অপ্রস্তূত হয়ে যান ওসমানী। উত্তরে তিনি শুধু মাথা নেড়েছিলেন। এই হচ্ছে উনার জীবন ধারনের পদ্ধতি। উনার পুঁজি ছিল সততা। উনার পুঁজি ছিল গণতন্ত্র। এসবের জন্য জাতি উনাকে আজীবন স্মরণ রাখবে। আল্লাহ তায়ালা উনাকে নিশ্চয়ই বেহেশত দান করবেন।

প্রশ্ন: জাতীয় পর্যায়ে ওসমানী অনেকটা বিস্মৃত বলেই অনেকে মনে করেন। যদিও ওসমানীর নামে বিমান বন্দর, ষ্টেডিয়াম এবং জাদুঘর আছে। ওসমানীর স্মৃতিকে আরেকটু বেশি মূল্যায়ন করা যায় কী?

শাহনূর চৌধুরী: আমি ওসমানী সাহেবের প্রাক্তন এপিএস হিসাবে বলছি আমাদের জাতীয় পর্যায়ে যতঠুকু করা দরকার আমরা তা করছি না। জেনারেল ওসমানী সাহেবের অনেক অবদান। আমি বঙ্গবন্ধুর সাথে উনার তুলনা করব না। নি:সন্দেহে তিনি জাতির পিতা। নি:সন্দেহে বঙ্গবন্ধু ছাড়া এই দেশ হত না। কিন্তু সামরিক দিক থেকে মুক্তিযুদ্ধ’কে সংঘটিত করার জন্য ওসমানীর নেতৃত্ব অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। আওয়ামীলীগেরও কেউ    করবে না। জাস্ট ছোট একটা জিনিস-যদি সরকারীভাবে তাঁর জন্মদিবস, মৃত্যু দিবস পালন করা যায়। আমাদের তো জাতীয় ছুটি অনেকগুলো দিনই আছে। তার সাথে আরও একদিন না হয় জেনারেল ওসমানীর জন্ম কিংবা মৃত্য়ুর দিনে ছুটি দেয়া যায়। এতে কোন ক্ষতি হবে না বরং আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের ছেলেমেয়ে, নাতিনাতনীরা জানতে পারবে ওসমানী কে ছিলেন। উনার সেনাপতিত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে। উনি একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। তারা যদি ওসমানীকে ভুলে যায় তাহলে তা আমাদের দুর্ভাগ্য হবে। আমরা চাই সরকারীভাবে ঘোষণা করা হোক যে সরকার ওসমানীর জন্মদিবস পালন করবে। সেটা একশ টাকার কেক কেটে হোক আর যেভাবেই হোক। এটা হবে আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। আর ওসমানী সাহেবকে এভাবেই স্মরণ করা হবে উত্তম।

প্রশ্ন: আমাদের সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

শাহনূর চৌধুরী: আমি অত্যন্ত খুশী, আনন্দিত এবং গর্বিত ওসমানীর স্মৃতিচারণ করতে পেরে।

বদরুল হোসেন বাবু: ফ্রি-ল্যান্স লেখক ও ব্লগার। সম্পাদক: সাগরপার