হাওয়াই দ্বীপপুন্জ পর্যটনের স্বর্গ হিসেবেই বিবেচিত সারা বিশ্বের অবস্থাপন্ন পর্যটকদের কাছে। এই দ্বীপপুন্জের রয়েছে আলাদা বিশেষত্ব। লিখেছেন দুই বাংলার অন্যতম সেরা পর্যটন লেখক লিয়াকত হোসেন খোকন।
Table of Contents
- প্রশান্ত মহাসাগরের কোলে ছোট -বড় মিলিয়ে ৬টি দ্বীপ নিয়ে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ। নীল সমুদ্র আর সবুজ পাহাড়ের মিলনক্ষেত্র হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের প্রতিটি দ্বীপই আশ্চর্য সুন্দর।
- ওয়াহু সবচেয়ে জনবসতিপূর্ণ দ্বীপ। হাওয়াইয়ের রাজধানী হনলুলু এই দ্বীপেই ।
- ‘আলোহা’ হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শব্দ। এর নানান অর্থ – অভিবাদন, ভালোবাসা, স্নেহ, আতিথিয়েতা, শান্তি অথবা বিদায়।
প্রশান্ত মহাসাগরের কোলে ছোট -বড় মিলিয়ে ৬টি দ্বীপ নিয়ে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ। নীল সমুদ্র আর সবুজ পাহাড়ের মিলনক্ষেত্র হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের প্রতিটি দ্বীপই আশ্চর্য সুন্দর।
বড় দ্বীপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উত্তরের দ্বীপ কাওয়াই। এ দ্বীপের অপর নাম আইল্যান্ড অব ডিসকভারি। কাওয়াইয়ের দক্ষিণ -পূর্বে ওয়াহু।
ওয়াহু সবচেয়ে জনবসতিপূর্ণ দ্বীপ। হাওয়াইয়ের রাজধানী হনলুলু এই দ্বীপেই ।
ওয়াহুর দক্ষিণ -পূর্বে মাওই দ্বীপ। এই দ্বীপটিকে বলা হয় ম্যাজিক আইল। মাওইয়ের দক্ষিণ -পূর্বে বিগ আইল্যান্ডকে বলা হয় ‘আইল্যান্ড অব অ্যাডভেঞ্চার’। এছাড়াও দু’টি ছোট দ্বীপের নাম ‘মেলোকাই’ এবং ‘লানাই’।
কাওয়াই ছোট দ্বীপ বলে এখানে পরিষেবা তেমন উন্নত নয়। তাই গাড়ি ভাড়া করেই খানের বিচ বা সমুদ্র সৈকত রিসোর্টের দিকে যেতে হয়। এখানে সমুদ্র সৈকতে এসে বেশ কিছু পর্যটক সার্ফিং করেন সমুদ্রে। সার্ফিং অর্থাৎ একটি পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে থেকে সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজের শরীরের ভারসাম্য রাখার খেলা।
‘আলোহা’ হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শব্দ। এর নানান অর্থ – অভিবাদন, ভালোবাসা, স্নেহ, আতিথিয়েতা, শান্তি অথবা বিদায়।
হাওয়াইকে বুঝতে গেলে তাদের এই ‘আলোহা’ স্পিরিট বোঝা দরকার। এটা বুঝা যায় হাওয়াইয়ান বিমানে উঠলে। বিমানের স্টাফ প্রতিটি যাত্রীকে ভীষণ আতিথিয়েতা দেখান।
হাওয়াই দ্বীপের কাওয়াই দ্বীপের লিহু বিমানবন্দরে নামার পরে আরেক ধরনের আতিথিয়েতা দেখানো হয়। হাওয়াইয়ানদের অতিথি আপ্যায়ন বা আলোহা স্পিরিট অনুযায়ী একটি প্রাচীন প্রথা হল, দ্বীপে আগমনের পর অতিথিকে মালা পরিয়ে অভ্যর্থনা করা। স্থানীয় ভাষায় একে বলে ‘লেই’।
লিহু বিমানবন্দর থেকে বেরুনোমাত্র একজন স্থানীয় মহিলা অর্কিডের মালা পরিয়ে যাত্রী বা ট্যুরিস্টদের অভ্যর্থনা করে বলেন, ‘ওয়েলকাম টু প্যারাডাইস’।
হাওয়াই দ্বীপের কাওয়াই দ্বীপের আনাহোলা শহরে রয়েছে কিলাউইয়া লাইট হাউস। এই লাইট হাউসে বাতিঘর সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকে। সমুদ্রতল থেকে ১০০ ফুট উঁচুতে দ্বীপের একেবারে উত্তর প্রান্তে এই লাইট হাউস। এখান থেকে নানা ধরনের সামুদ্রিক প্রাণী এবং পরিযায়ী পাখি দেখা যায়। এখানে সামনেই নীল সমুদ্র পাথুরে জমিতে ক্রমাগত আছাড় খেয়ে সাদা ফেনায় পরিণত করছে। সারা দিন ধরে চলে এই রঙ বদলের খেলা।
লাইট হাউসের একটু দূরেই কিয়ালিয়া সমুদ্র সৈকত, ডংকি সমুদ্র সৈকত ও অ্যালিওয়ামানু সমুদ্র সৈকত। এগুলো সবই কুহিয়ো হাইওয়েরের পাশে। প্রিন্সসেভিলে ভ্যালি লুকআউট পয়েন্টে রয়েছে আলাদা বৈচিত্র্য। আনাহোলা শহরের কাছেই এ জায়গা।
এ উপত্যকায় নানা ধরনের চাষবাস হয়। অনেক ওপর থেকে ক্ষেতগুলোকে নানান আভার সবুজে বোনা শতরঞ্জির মতো দেখায়। মাঝে মাঝে উপত্যকার উজ্জ্বল সবুজ রঙে চোখ যেন ধাঁধিয়ে যায়। অদ্ভুত ব্যাপার, একটা সবুজের সঙ্গে আরেকটা সবুজের কোন মিল নেই এখানে।
আনাহোলার আরেক বৈশিষ্ট্য এখানকার এক বিখ্যাত খাবার। খাবারটির নাম ‘হাউপিয়া’। তবে এটি সহজে পাওয়া যায় না। হঠাৎ কোন কোন দোকানে মেলে হাউপিয়া। চিন ইয়ং ভিলেজের এক স্ন্যাক্সের দোকানে বেশি মিলিলেও বেশিক্ষণ থাকে না। ক্রেতারা সঙ্গে সঙ্গে কিনে নিয়ে যান।
আরও পড়ুন: আমেরিকার ৬টি শহরে ভ্রমণের ইতিবৃত্ত
হাউপিয়া খাদ্যদ্রব্যটি এক পুডিংজাতীয় ডেজার্ট। নারকেলের দুধ আর নারকেলের গুঁড়ো দিয়ে বানানো এই খাবারের স্বাদ অসাধারণ। আনাহোলা শহরের উত্তর – পশ্চিম দিকে একলেনের ব্রিজ। এ ব্রিজের পরেই বিস্তৃত টেরো গাছের ক্ষেত। এখানকার স্থানীয় চাষি পরিবারগুলো বেশির ভাগই এই কচুজাতীয় গাছের চাষ করে থাকে। যে কোন বিশেষ অনুষ্ঠানে এই কচুই হল অন্যতম প্রধান খাবার। এখানকার অধিবাসীদের একটি বিখ্যাত ধর্মীয় অনুষ্ঠান হল ‘লুয়াউ’। এ অনুষ্ঠানে এরা আগুন নিয়ে খেলা করে, দেবতার উদ্দেশ্যে প্রণাম জানায় এবং হুলানৃত্যের মাধ্যম উৎসব পালন করে।
কাওয়াই দ্বীপের আনাহোলার কাছেই এক পাহাড়ের চূড়া থেকে আরেক পাহাড়ের চূড়ায় দড়ি ধরে পাড়ি দিতে হলে একটা লাফ দিতে হয়। এ জন্য পুরো শরীরটাই বাঁধা থাকে দড়ির সঙ্গে। লাফ দিতে গিয়ে মনে হবে পায়ের নিচে কিছু নেই। আপনিও যেন তখন ভেসে চলবেন পাখির মতো।
হাওয়াই দ্বীপের কাওয়াই দ্বীপে রয়েছে কিলোহানা রেলওয়ে প্লান্টেশন। এখানে এসে এক ঘন্টার জন্য রেলভ্রমণ করা যায়। সেও এক মজার অভিজ্ঞতা। এই ট্রেন কখনও ছোটে আনারসের ক্ষেতের পাশ দিয়ে, কখনও আম, আপেল, কমলালেবুর বাগানের মাঝখান দিয়ে। কখনও ঢুকে পড়ে ঘন অরণ্যের অন্দর মহলে। ফলের বাগানগুলোর পেছনে দূরে দেখা যায় পাহাড়ের সারি। এ এলাকায় স্বাধীনভাবে চরে বেড়ায় হাঁস – মুরগিসহ গবাদিপশু। এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। রেলস্টেশনে ছোট মিউজিয়ামে প্রদর্শিত হচ্ছে প্রাচীনকালে স্থানীয় মানুষদের ব্যবহৃত হাতে তৈরি কৃষি -যন্ত্রপাতি এবং বেতের নানা সামগ্রী।
এক ঘন্টার রেল ভ্রমণ শেষ করে কাছের দ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে গেলে দেখা যাবে পায়জু সমুদ্র সৈকত। এ সৈকতের দুই পাশে গাছগুলো একে অপরের দিকে ঝুঁকে পথের ওপর সবুজ চাঁদোয়া তৈরি করেছে। চাঁদোয়ার সুরঙ্গ পথের সম্মুখভাগে দেখা যায় একটুকরো নীল আকাশ। পায়জু সমুদ্র সৈকতের পানি কাচের মতো স্বচ্ছ। পানির তলায় রংবাহারী প্রবালসহ নানা জাতের সামুদ্রিক প্রাণী দেখা যায়। সমুদ্রের মাঝবরাবর তৈরি হয়েছে সরু বালুকাপথ। সে পথ ধরে সমুদ্রের অনেকটা ভেতরের দিকে চলে যাওয়া যায়।
পায়জু সমুদ্র সৈকতের কাছেই পায়জু বোটানিক্যাল গার্ডেন। কাওয়াইয়ের একটি দর্শনীয় স্থান এটি। দেশ -বিদেশের বহু পুরনো ও বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদের সংগ্রহ আছে এ উদ্যানে ওয়াই আলে আলে পাহাড় রয়েছে এই কাওয়াইয়ে। এ পাহাড়ে ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩৫০ দিনই বৃষ্টি হয় – এখানের আকাশ সবসময় মেঘাচ্ছন্ন থাকে। পাহাড় দেখার জন্য হেলিকপ্টার রয়েছে। হেলিকপ্টারে উঠে পাহাড়ের রূপ দেখতে গিয়ে বৃষ্টির মুখোমুখি হবেন। হেলিকপ্টার ওয়াইমিয়া ক্যানিয়নের কাছে গেলে পাহাড়ের রুক্ষ রূপ দেখে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকবেন। এখানের পাহাড় বেয়ে নেমে এসেছে ওয়াইনিহা, লুমাহাই, হানালাই – এসব অদ্ভুত নদী। কাছ থেকে যদি দেখেন মানাওয়াইওপুনা জলপ্রপাত – তবে তো কথা নেই। যদি পথে পরিচয় হয় কোনো এক রূপসীর সঙ্গে, তবে তার হাতে একশো ডলার তুলে দিলে সে-ই হবে আপনার স্নানের সঙ্গিনী।