যুগোস্লাভিয়া: ইউরোপ মহাদেশ থেকে হারিয়ে যাওয়া একটি দেশ


যুগোস্লাভিয়া নামের দেশটি ইউরোপ মহাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত ছিল। আজ আর যুগোস্লাভিয়া নামে কোনো দেশ নেই – কেননা, যুগোস্লাভিয়া ভেঙে বেশ কয়েকটি দেশের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে ১৯৯০ এর দশকে। মার্শাল টিটো নামটি আজও অনেকের স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে।

মার্শাল টিটোর পুরো নাম জোসিপ ব্রজ টিটো। তিনি সাবেক যুগোস্লাভিয়ার অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিত্ব। একাধারে তিনি যুগোস্লাভিয়ার প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর এক দশকের মধ্যে গৃহযুদ্ধে রূপান্তরিত হয়ে যুগোস্লাভিয়া দেশটি ভেঙে কয়েকটি দেশে আত্মপ্রকাশ করে।

১৯১৮ খৃষ্টাব্দের ১ ডিসেম্বর তারিখে দক্ষিণ ইউরোপের সার্বিয়া রাজ্য, মন্টিনিগ্র রাজ্য ও হলি রোমান সাম্রাজ্যের ক্রট স্লোভানিয়া অংশ মিলে গঠন করা নতুন রাষ্ট্র যুগোস্লাভিয়া। এর রাজধানী করা হয় বেলগ্রেড ও পোদগোরিচায়।

যুগোস্লাভিয়া নামের অর্থ দক্ষিণ স্লাভদের দেশ। পূর্ব ইউরোপের বাসিন্দাদের বেশির ভাগই নৃতাত্ত্বিক দিক দিয়ে বৃহত্তর স্লাভ জাতির অংশ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির কাছে পরাজিত যুগোস্লাভিয়া যুদ্ধের পরে মার্শাল টিটোর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকে পড়ে।

নাৎসি জার্মানি যুগোস্লাভিয়ার ওপর ১৯৪১ খৃষ্টাব্দে হামলা করে। যুগোস্লাভিয়ার সর্বোচ্চ সামরিক নেতাগণ জার্মানির কাছে পরাজয় বরণ করেন।

যুগোস্লাভিয়ার রাজা তাঁর সরকারি দপ্তর বিদেশে স্থাপন করেন।

যুগোস্লাভিয়ার ওপর তখন জার্মানি সামরিক দখল কায়েম করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুগোস্লাভিয়ার অনেক ভূখণ্ড দখল করে নেয় বুলগেরিয়া, হলি রোমান সাম্রাজ্য হাঙ্গেরি ও ইতালি।

map 62826 1280 min
যুগোস্লাভিয়া

এদিকে যুগোস্লাভিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির মার্শাল টিটোর দিকনির্দেশনায় দৃঢ়ভাবে বিদেশি আগ্রাসনকারীদেরকে প্রতিরোধ করে। যুগোস্লাভিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি যুগোস্লাভিয়া জাতীয় মুক্তি মোর্চা গঠন করে প্রতিরোধের পর প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

১৯৪৩ খৃষ্টাব্দে মার্শাল টিটোর নেতৃত্বে যুগোস্লাভিয়া জাতীয় মোর্চা প্রতিষ্ঠা করে অস্থায়ী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করে।

যুগোস্লাভিয়ার জাতীয় বাহিনী ৭ বার আক্রমণ প্রতিরোধ করে জার্মান বাহিনীকে। অবশেষে ১৯৪৪ খৃষ্টাব্দের যুদ্ধে সারাদেশের অধিকাংশ এলাকা মুক্ত করা হয়। পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের বাহিনী আর যুগোস্লাভিয়ার যৌথ বাহিনী সম্মিলিত ভাবে যুগোস্লাভিয়াকে মুক্ত করার যুদ্ধ শুরু করে। একে একে রাজধানী বেলগ্রেড ও পোদগোরিচা মুক্ত হয়।

এই যুদ্ধে মোট ১৫ হাজার জার্মান সেনা সদস্য মারা যায়। এছাড়া ৯ হাজার জার্মান সেনাকে আটক করা হয়।

১৯৪৫ খৃষ্টাব্দে যুগোস্লাভিয়া গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের অস্থায়ী সরকার স্থাপন করা হয়। তবে যুগোস্লাভিয়া থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনা সদস্যরা না যাওয়াতে দেশটি পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে থাকল।

যুগোস্লাভিয়া থেকে স্বাধীন হয়ে যাওয়া রাষ্ট্রগুলি হলো – ক্রোয়েশিয়া, উত্তর মেসিডোনিয়া, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, স্লোভেনিয়া, মন্টেনিগ্রো, সার্বিয়া এবং কসোভো। আজ আর যুগোস্লাভিয়া নামে কোনো দেশ নেই – কেননা, যুগোস্লাভিয়া ভেঙে বেশ কয়েকটি দেশের আত্মপ্রকাশ ঘটে।

১৯৯০ এর দশকের প্রথম দিকে একে একে চারটি যুদ্ধের মাধ্যমে ক্রোয়েশিয়া, স্লোভেনিয়া, উত্তর মেসিডোনিয়া, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা নামে পাঁচটি দেশ আত্মপ্রকাশ করে।

সার্বিয়া ও মন্টেনিগ্রো নিয়ে ফেডারেল রিপাবলিক অব যুগোস্লাভিয়া নাম নিয়ে কিছুকাল টিকে থাকলেও ২০০৬ খৃষ্টাব্দে যুগোস্লাভিয়া ভেঙ্গে মন্টেনিগ্রো ও সার্বিয়া স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে যায়। ফলে ইতিহাসে বিলীন হয়ে যায় যুগোস্লাভিয়া নামের সেই দেশটি।

আবার পরবর্তীতে মন্টেনিগ্রো ও সার্বিয়া থেকে আরেকটি দেশের জন্ম হয়। দেশটির নাম হল কসোভো। কসোভো স্বাধীনতা লাভ করে ২০১২ খৃষ্টাব্দে।

যুগোস্লাভিয়া থেকে স্বাধীন হয়ে যাওয়া রাষ্ট্রগুলি হলো – ক্রোয়েশিয়া, উত্তর মেসিডোনিয়া, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, স্লোভেনিয়া, মন্টেনিগ্রো, সার্বিয়া এবং কসোভো। আজ আর যুগোস্লাভিয়া নামে কোনো দেশ নেই – কেননা, যুগোস্লাভিয়া ভেঙে বেশ কয়েকটি দেশের আত্মপ্রকাশ ঘটে।

আরও পড়ুন: মঙ্গোলীয়দের পর রাশিয়া: ইউক্রেনের বিধ্বস্ত হওয়ার করুণ নিয়তি

সার্বিয়া

সার্বিয়া দক্ষিণ -পূর্ব ইউরোপের একটি দেশ। এটি পানোনীয় সমভূমির দক্ষিণাংশে, বলকান উপদ্বীপের মধ্যভাগে অবস্থিত।

সার্বয়ার উত্তরে হাঙ্গেরি, পূর্বে রুমানিয়া বা রোমানিয়া ও বুলগেরিয়া, দক্ষিণে আলবেনিয়া ও উত্তর মেসিডোনিয়া এবং এ দেশটির পশ্চিমে মন্টিনেগ্রো, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া আর হার্জেগোভিনা অবস্থিত।

সার্বিয়ার রাজধানী বসেছে বেলগ্রেডে।
সার্বিয়া দেশটি স্বাধীনতার আগে উসমানীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল।
এ দেশের ভাষা – সার্বীয়। এছাড়া এ দেশে হাঙ্গেরিয়, ক্রোয়েশিয়ান, স্নোভাক, রোমানিয়ান, রুসিন, আলবেনিয়ান আঞ্চলিক ভাষা স্বীকৃত।
এ দেশের মুদ্রার নাম – সার্বিয়ান দিনার।
সার্বিয়ার আয়তন মোট ৮৮,৩৬১ বর্গকিলোমিটার।
জনসংখ্যা মোট প্রায় ৭১ লক্ষ।
এ দেশের মানুষ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী।

বেলগ্রেড একসময় যুগোস্লাভিয়ার রাজধানী ছিল। বর্তমানে বেলগ্রেড সার্বিয়ার রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। এটি দক্ষিণ -পূর্ব ইউরোপের বৃহত্তম নগরী। পূর্ব ইউরোপে ইস্তাম্বুল, এথেন্স এবং বুখারেস্টের পর বেলগ্রেড চতুর্থ বৃহত্তম শহর। বেলগ্রেড শহরের প্রশাসনিক সীমার মধ্যে প্রায় ১.৭ মিলিয়ন মানুষ বসবাস করে। বেলগ্রেড শহরটি প্রতিষ্ঠিত হয় ২৬৯ খৃষ্টপূর্বে।

বেলগ্রেড শহরের জনসংখ্যা মোট প্রায় ১৬ লক্ষ।

বেলগ্রেড ইউরোপ এবং বিশ্বের প্রাচীনতম শহরগুলোর মধ্যে একটি। ইউরোপের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রাগৈতিহাসিক সংস্কৃতি, ভিনকা সংস্কৃতি, ষষ্ঠ সহস্রাব্দ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বেলগ্রেড এলাকায় বিকশিত হয়েছিল। প্রাচীনকালে থ্রাকো -ড্যাসিয়ানরা এই অঞ্চলে বসবাস করত।

বেলগ্রেড বিশ্বের পাঁচটি সবচেয়ে সৃজনশীল শহরের মধ্যে একটি। বেলগ্রেড বিভিন্ন ফেস্টিভ্যালের জন্য বিখ্যাত। যেমন – ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল, সামার ফেস্টিভ্যাল, মিউজিক ফেস্টিভ্যাল, বুক ফেয়ার ফেস্টিভ্যাল -ইত্যাদি।

মেসিডোনিয়া

মেসিডোনিয়া বিভিন্ন নামে পরিচিত, যেমন মাকেদোনিয়া বা মাকেদনিয়া। দক্ষিণ -পূর্ব ইউরোপের একটি ঐতিহাসিক অঞ্চল এই মেসিডোনিয়া।

বর্তমানে মেসিডোনিয়ার তিনটি প্রধান অঞ্চল এবং দু’টি ছোট অঞ্চল ৬টি রাষ্ট্রে অবস্থিত।

মেসিডোনিয়ার প্রধান তিনটি অঞ্চল হলো –
এজীয় মেসিডোনিয়া – মেসিডোনিয়ার প্রাক্তন এ রাজ্যটি বর্তমানে গ্রীসের বৃহত্তম অঞ্চল।
ভার্দার মেসিডোনিয়া – এটি হলো উত্তর মেসিডোনিয়া, যা কিনা প্রাক্তন যুগোস্লাভিয়া মেসিডোনিয়া প্রজাতন্ত্র।
পিরিন মেসিডোনিয়া – এটি বর্তমানে পশ্চিমাঞ্চলিক বুলগেরিয়ার ব্লাগয়েভগ্রাদ অঙ্গরাজ্য।

উত্তর মেসিডোনিয়া সরকারি ভাবে উত্তর মেসিডোনিয়া প্রজাতন্ত্র নামে পরিচিত। উত্তর মেসিডোনিয়া হল দক্ষিণ -পূর্ব ইউরোপে বলকান উপদ্বীপে অবস্থিত একটি রাষ্ট্র। এটি পূর্বে যুগোস্লাভিয়ার অন্তর্গত ছিল।

উত্তর মেসিডোনিয়া ১৯৯১ খৃষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রের নামকরণ নিয়ে এটি গ্রিসের মেসিডোনিয়া অঞ্চলের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। তাই প্রজাতন্ত্রী মেসিডোনিয়া যখন জাতিসংঘের অন্তর্গত হয় সদস্য রাষ্ট্রে তখন থেকে প্রাক্তন ইউগোস্লাভ মেসিডোনিয়া প্রজাতন্ত্র নামেও পরিচিত হয়ে ওঠে।

উত্তর মেসিডোনিয়া প্রজাতন্ত্রের রাজধানী স্কপিয়েতে। এটি উত্তর মেসিডোনিয়ার বৃহত্তম নগরী ও জনবহুল শহর।

মেসিডোনিয়ার সরকারি ভাষা মেসিডোনিয় ও আলবেনিয়। এছাড়া এ দেশে অফিসিয়াল আঞ্চলিক ভাষা হলো – তুর্কী, রোমানি, সার্বীয়, বসনীয়, আরমানীয়।

দেশের নৃগোষ্ঠী হলো – মেসিডোনিয়, আলবেনীয়, তুর্কী, রোমানি, সার্ব, বোসনিয়াক, আরমানীয়।

জাতীয়তাবাদ – মেসিডোনীয়।

দেশটি যুগোস্লাভিয়া থেকে স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৯৩ খৃষ্টাব্দের ৮ এপ্রিল।

উত্তর মেসিডোনিয়ার আয়তন ২৫,৭১৩ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা – ২২,০০,৭২১ জন।

মেসিডোনিয়া প্রত্নতাত্ত্বিক ও শাস্ত্রীয় গ্রিসের সীমান্তবর্তী একটি প্রাচীন রাজ্য এবং পরবর্তীকালে হেলেনীয় গ্রিসের প্রভাবশালী রাজ্যে পরিণত হয়েছিল।

রাজ্যটি রাজকীয় আর্জিদ রাজবংশ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ও প্রারম্ভিক সময়ে শাসিত হয়। এর পরে এই রাজ্যটি অ্যান্টিপ্যাট্রিভ ও অ্যান্টিগনিড রাজবংশ দ্বারা শাসিত হয়।

প্রাচীন মেসিডোনিয়দের আদি নিবাস, গ্রীস উপদ্বীপের উত্তর -পূর্ব অংশে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। এর পশ্চিমে এপিরাস, উত্তরে পাওনিয়া, পূর্বে থ্রেস এবং দক্ষিণে থেসালির দ্বারা সীমাবদ্ধ ছিল।

৮০৮ থেকে ৩৩৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত মেসিডোনিয়ার

রাজধানী ছিল আইগাইতে।

৩৩৯ থেকে ১৬৮ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজধানী ছিল পেলাতে।

তখন প্রচলিত ভাষা ছিল – প্রাচীন মেসিডোনিয়, অ্যান্টিক, কোইন গ্রিক।

ধর্ম ছিল – গ্রিক বহুবাদ ও হেলেনীয় ধর্ম।

সরকারের ধরণ ছিল – রাজতন্ত্র।

এ দেশগুলোর অর্থনীতি হলো – কৃষি সম্পদ, খনিজ সম্পদ, বনজ সম্পদ, মৎস্য সম্পদ, শিল্প ও বাণিজ্য।

আরও পড়ুন: মঙ্গোলিয়া: দুর্ধর্ষ মোঙ্গল সম্রাট চেঙ্গিস খান জন্মেছিলেন যে দেশে

বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা –

আজকের বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় সেই প্যালিওলিথিক যুগ থেকে মানুষ বসবাস করে আসছে। তবে নিওলিথিক যুগে বুটমির, কাকাঞ্জ এবং ভুচেডোল সংস্কৃতির সময়কালে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় স্থায়ীভাবে মানব বসতি স্থাপন হয়েছিল।

প্রথম ইন্দো -ইউরোপীয়দের আগমনের পর, এই অঞ্চলটি বেশ কয়েকটি ইলিরিয়ান ও কেল্টিক সভ্যতার দ্বারা বেশ জমজমাট ছিল। তখন তো বেশ জনবহুল হয়ে ওঠে এ অঞ্চল।

দক্ষিণ স্লাভিক মানুষের যারা আজ বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় জনবসতি করেছে তাদের পূর্বপুরুষরা ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শতকের মধ্যে এসেছিলেন। ১২শ শতকে বসনিয়ায় ব্যানেট অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৪শ শতকের মধ্যে এটি বসনিয়া রাজ্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়।

১৫শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা অঞ্চল দু’টি অটোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে সংযুক্ত করা। সেই অটোমান সাম্রাজ্যের শাসনের অধীনে এ অঞ্চল ১৯ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত ছিল।

অটোমানরা এই অঞ্চলে ইসলাম ধর্ম প্রচার করেছিল। যে জন্য তখন অনেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। তাছাড়া সেই সময়ে এ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির অনেকটাই পরিবর্তন ঘটেছিল।

১৯শ শতকের শেষ থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত, দেশটি অস্ট্রো -হাঙ্গেরিয়ান রাজতন্ত্রের সাথে যুক্ত ছিল। আন্তঃ যুদ্ধের সময়, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা ছিল যুগোস্লাভিয়া রাজ্যের অংশ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, নবগঠিত সমাজতান্ত্রিক ফেডারেল রিপাবলিক অব যুগোস্লাভিয়াতে এটিকে পূর্ণ প্রজাতন্ত্রের মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল।
১৯৯২ খৃষ্টাব্দে যুগোস্লাভিয়া ভেঙে যাওয়ার পর, বসনিয়া প্রজাতন্ত্র স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এরপরে বসনিয়ান যুদ্ধ শুরু হয়, পরপরই বসনীয় মুসলমান, ক্রোয়েশীয় ও সার্বীয় জাতির লোকদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে।
যেটি ১৯৯৫ খৃষ্টাব্দের শেষ পর্যন্ত চলে। ১৯৯৫ খৃষ্টাব্দের যুদ্ধের শেষে সার্বীয়রা দেশের ৪৯ ভাগ এলাকা দখলে সক্ষম হয় এবং এর নাম দেয় সার্ব প্রজাতন্ত্র। বসনীয় ও ক্রোয়েশীয়রা দেশের বাকি অংশের নিয়ন্ত্রণ নেয় যার নাম দেওয়া হয় বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা ফেডারেশন।

ডেটন চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।

বর্তমানে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা দেশটি তিনটি প্রধান জাতি গোষ্ঠীর আবাসস্থল। এ দেশটির সংবিধান জনগণ মনোনীত সংবিধান। বসনিয়াকরা তিনটি গোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে বড় গোষ্ঠী। এরপর সার্বরা দ্বিতীয় বৃহত্তম গোষ্ঠী এবং ক্রোয়াটররা তৃতীয় বৃহত্তম গোষ্ঠী। তবে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার সকলকে জাতিধর্ম নির্বিশেষে বসনিয়ান বলা হয়। সংখ্যালঘু শ্রেণির যারা সংবিধানের অধীনে অন্যান্য হিসাবে যাদেরকে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছে ইহুদি, রোমানিয়ান, আলবেনিয়ান, মন্টেনিগ্রিন, ইউক্রেনীয় এবং তুর্কী।

বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার একটি দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা রয়েছে। তাছাড়া তিনটি প্রধান জাতিগোষ্ঠীর প্রত্যেকের একজন করে সদস্য নিয়ে গঠিত তিন সদস্যের রাষ্ট্রপতি পদ রয়েছে।

এ দেশের কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত। কারণ দেশটি মূলত বিকেন্দ্রীকৃত। এটি দুটি স্বায়ত্তশাসিত সত্বা নিয়ে গঠিত – ফেডারেশন অফ বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা এবং রিপাবলিক শ্রপস্কা।

বর্তমানে দেশটির বসনীয়, ক্রোয়েশীয় ও সার্বীয় জাতির লোকদের মধ্যে প্রবল বিভাজন ও বিদ্বেষ রয়েছে। এটি নিরসনের জন্য বহুবার আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।

বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা একটি উন্নয়নশীল দেশ এবং মানব উন্নয়নে ৭৩তম স্থানে রয়েছে।

বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা দেশটির অর্থনীতি শিল্প ও কৃষি দ্বারা প্রভাবিত। এছাড়া পর্যটন এবং পরিষেবা খাত দ্বারা অনুসরণ করা হয়।

বসনিয়াকে বলা হত, বোসোনা। আর এই বোসোনার অর্থ হল ছোট ভূমি।

বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা দেশটি ইউরোপ মহাদেশের দক্ষিণ -পূর্ব অংশে বলকান উপদ্বীপে অবস্থিত।

বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা দেশটির রাজধানী সারায়েভোতে।

এ দেশের সরকারি ভাষা বসনিয়ান, ক্রোয়েশিয়ান ও সার্বিয়ান।

দেশটির আয়তন ৫১,১২৯ বর্গকিলোমিটার।

জনসংখ্যা ৩,৯০০,২০০ জন।

কসোভো –

কসোভো নামটি এসেছে সার্ব শব্দ ‘কোস’ থেকে। এর অর্থ কালো পাখি। মূলত কসোভো পোলজে নাম থেকে সংক্ষিপ্ত করে দেশটির এরূপ নামকরণ করা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে ‘কালো পাখির বিচরণ ক্ষেত্র’।

কসোভোয় অটোমান সাম্রাজ্যের এবং বলকান রাষ্ট্র সমূহের জোটের মধ্যে কসোভোর যুদ্ধ হয়েছিল। আলবেনীয় ভাষায় কসোভোর পশ্চিম অংশকে বলা হয় রাফশি আই ডুকাগজিনিত। আবার এর অর্থ হল ডুকাগজিনের মালভূমি।

উসমানীয় শাসনামলে ১৮৭৭ খৃষ্টাব্দে কসোভোকে প্রদেশে রূপান্তরিত করেছিল। তাছাড়া কসোভো নামটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে উসমানীয় সাম্রাজ্যের শাসনামল থেকে

প্রাচীনকালে এই অঞ্চলটি দার্দানিয়ার অংশ ছিল। আবার দার্দানিয়া অঞ্চলটি মোয়েশিয়া নামক রোমান প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

মধ্যযুগে কসোভো অঞ্চলটি বুলগেরিয়ান সাম্রাজ্য, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য এবং পরবর্তীতে সার্বিয়ান মধ্যযুগীয় রাজ্যগুলির অংশ হয়ে ওঠে।

কসোভোর যুদ্ধের ঠিক ৭০ বছর পরে কসোভো প্রদেশ অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ হয়। ১৯১৩ খৃষ্টাব্দে কসোভো ভিলায়েত সার্বিয়ার রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯১৮ খৃষ্টাব্দে যুগোস্লাভিয়া রাষ্ট্র গঠিত হলে তখন কসোভো যুগোস্লাভিয়ার অংশে পরিণত হয়।

জোসিপ ব্রোজ টিটোর নির্দেশে ১৯৬৩ খৃষ্টাব্দে কসোভো স্বায়ত্তশাসন লাভ করে। যুগোস্লাভিয়ার ১৯৭৪ খৃষ্টাব্দের সংবিধানের ফলে এই স্বায়ত্তশাসনের পরিধি উল্লেখযোগ্য ভাবে প্রসারিত হয়েছিল। তবে ১৯৯৩ খৃষ্টাব্দে কসোভোর স্বায়ত্তশাসন ক্ষমতা প্রত্যাহার করা হয়।

২০০৮ খৃষ্টাব্দে কসোভোর জনপ্রতিনিধিরা একতরফা ভাবে কসোভোর স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে কসোভো প্রজাতন্ত্রের সংবিধান গৃহীত হয়, যা ২০০৮ খৃষ্টাব্দে কার্যকর করা হয়।

প্রাগৈতিহাসিক পরবর্তী সময়ে এ অঞ্চলটিতে স্টারসেভো সংস্কৃতি, ভিনকা সংস্কৃতি, বুরাঞ্জ -হাম

সংস্কৃতি এবং বাডেন সংস্কৃতি সক্রিয় ছিল।

কসোভো অঞ্চলে মানুষ প্রায় দশ হাজার বছর ধরে বসবাস করে আসছে।

নিওলিথিক যুগে, কসোভো ভিনকা -তুর্দাস সংস্কৃতি এলাকার অন্তর্ভুক্ত ছিল।

কসোভো ইউরোপ মহাদেশের বলকান অঞ্চলের একটি রাষ্ট্র, যা পূর্বে সার্বিয়ার একটি প্রদেশ ছিল। সার্বিয়া এ দেশটির স্বাধীনতা না মানলেও এ পর্যন্ত জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ১১৫টি রাষ্ট্র কসোভোকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত দিয়েছে।

কসোভো দেশটির আয়তন ১০,৯০৮ বর্গকিলোমিটার।
এ দেশের নৃগোষ্ঠী হলো – আলবেনীয়, সার্বীয়।
জনসংখ্যা ২,৫০০,৫০০ জন।
কসোভোর সীমান্তে মন্টিনিগ্রো, আলবেনিয়া ও ম্যাসিডোনিয়া অবস্থিত।
কসোভোর রাজধানী প্রিস্টিনায়।
কসোভো একটি উচ্চ -মধ্যম আয়ের অর্থনীতি সহ একটি উন্নয়নশীল দেশ।

কসোভোর দর্শনীয় স্থান হল –

প্রিস্টিনা – প্রিস্টিনা হলো কসোভোর রাজধানী। এখানে রয়েছে অসংখ্য কফিশপ, পিকনিক স্পট এবং বার। বারে ঢুকে বিভিন্ন ধরনের আনন্দ ফূর্তি করা যায়।

প্রিজরেন – প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের শহর বলা হয় প্রিজরেনকে। সৌন্দর্যের দিক থেকে প্রিস্টিনার পরে এই শহরের অবস্থান। প্রিজরেন শহরে রয়েছে কালাজা নামে দুর্গ। এই দুর্গ থেকে সূর্যাস্তের দৃশ্য উপভোগ করার জন্য পর্যটকদের ভিড় পড়ে যায়। এই শহরের সিনান পাশা মসজিদটিও দেখার মতো।

পেজা – পাহাড় -পর্বতে ঘেরা অঞ্চল পেজা। পেজা শহরের প্রধান আকর্ষণ পাহাড়, অরণ্য, জলপ্রপাত, ঝর্ণা। এখানে আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায়।

ভিসোকি ডেকানি – ভিসোকি ডেকানিতে চতুর্দশ শতকে আশ্রম নির্মাণ করা হয়। ২০০৪ খৃষ্টাব্দে আশ্রমটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৯৮ -৯৯ খৃষ্টাব্দে কসোভো যুদ্ধের সময় এই আশ্রমটি ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছিল।

গ্রাসানিকা আশ্রম – গ্রাসানিকা আশ্রমটিও ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্ভুক্ত একটি দর্শনীয় স্থান। চতুর্দশ শতকে এটি নির্মাণ করা হয়।

মন্টিনিগ্রো –

মন্টিনিগ্রো দেশটি ইউরোপ মহাদেশের একটি রাষ্ট্র। এটি ইউরোপের বলকান অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে।

মন্টিনিগ্রো প্রজাতন্ত্রের রাজধানী পোডগোরিচাতে।

দেশের সরকারি ভাষা – সার্বীয় ভাষা।

মন্টিনিগ্রো দেশটি পর্যায়ক্রমে যে সব সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল – ৭৮০ খৃষ্টাব্দের আগ পর্যন্ত বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল ; ১৪৫৯ খৃষ্টাব্দে এ দেশটি অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় – যা কিনা ১৮৭৮ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে।

১৮৭৮ খৃষ্টাব্দে অটোমান সাম্রাজ্য হতে স্বাধীনতা লাভ করে মন্টিনিগ্রো রাজ্য গঠিত হয়। তবে ১৯১৮ খৃষ্টাব্দে এ দেশটি যুগোস্লাভিয়া রাষ্ট্রের অধীনে চলে যায়।

পরবর্তীতে বহু বছর ধরে মন্টিনিগ্রো সার্বিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। ২০০৬ খৃষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত এক গণভোটে মন্টিনিগ্রোর জনগণ সিদ্ধান্ত নেয় তারা সার্বিয়ার সাথে সংযুক্ত থাকবে কিনা। পরের দিন ৫৬ শতাংশ লোক মন্টিনিগ্রোর পক্ষে ভোট দিয়ে দেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে।

যুগোস্লাভিয়া দেশটি ভেঙে যাওয়ার পরে ২০০৬ খৃষ্টাব্দে মন্টিনিগ্রো দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে। এছাড়া যুগোস্লাভিয়ার অন্তর্ভুক্ত কসোভো নামে আরেকটি দেশ স্বাধীনতা লাভ করে ২০১২ খৃষ্টাব্দে।

এ দেশের জাতীয় সঙ্গীত হল – ‘ওহ, মে মাসের উজ্জ্বল ভোর’।

জাতীয়তাবাদ – মন্টিনিগ্রো।

এ দেশে কয়েকটি ভাষা প্রচলিত রয়েছে, যেমন – মন্টিনিগ্রীয়, বসনীয়, আলবেনীয় ও রোমানি।
মন্টিনিগ্রোতে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী লোকের সংখ্যা বেশি। দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম হল ইসলাম।

মন্টিনিগ্রোর উল্লেখযোগ্য স্থান হলো –

উলকিঞ্জ – এটি মন্টিনিগ্রোর দক্ষিণাঞ্চলের একটি প্রাচীন সমুদ্রবন্দর। বর্তমানে উলকিঞ্জতে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন সমুদ্র সৈকত।

বায়োগ্রাডস্কা – এই বায়োগ্রাডস্কাতে রয়েছে ন্যাশনাল পার্ক। এই পার্কের অভ্যন্তরে একটি হ্রদও রয়েছে। এখানের অধিকাংশ গাছগুলো ৫০০ বছরের পুরনো।

স্বেতি স্টিফান দ্বীপ – এই দ্বীপে পঞ্চদশ শতাব্দীতে বসতি গড়ে ওঠে। বর্তমানে স্বেতি স্টিফান দ্বীপে রয়েছে বিলাসবহুল হোটেল ও রিসোর্ট। এই দ্বীপে গেলে আনন্দ ফূর্তি করা যায়।

মাউন্ট লভকেন – মাউন্ট লভকেন নয়নাভিরাম নৈসর্গিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ একটি পাহাড়। পর্যটকরা প্রতিদিনই এই পাহাড়ে বেড়াতে আসেন।

কেটিজি – অটোমানদের আমলে কেটিজি শহরটি গড়ে ওঠে। অটোমান সাম্রাজ্যের সময়ে এখানে বহু অট্টালিকা ও স্থাপত্যকীর্তি নির্মিত হয়েছিল। এ শহরটি ট্যুরিস্টদেরকে ভীষণ ভাবে আকৃষ্ট করে থাকে।

মন্টিনিগ্রোর আরও দর্শনীয় স্থান হলো – অস্ট্রোগ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন অঞ্চল ; পেরাস্ট ; ডারমিটর ন্যাশনাল পার্ক, বুদভা, কটর ইত্যাদি।

মন্টিনিগ্রোর উপকূলের কেন্দ্রে অবস্থিত বুদভা। বুদভা একটি পুরনো শহর। এখানে রয়েছে ৩৫ টি সমুদ্র সৈকত ও নানারকম সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান।

আরও রয়েছে ক্লাব, রেস্তোরাঁ ও বার। নৈসর্গিকতা যারা ভালবাসে তারা সেই টানে বুদভা শহরে ছুটে আসেন।

আদ্রিয়াটিক উপকূলে অবস্থিত কটর শহরটি দ্বাদশ শতকে সেন্ট ট্রাইপুন ক্যাথেড্রাল দ্বারা শাসিত হয়েছিল। যে জন্য এই শহরে সেন্ট ট্রাইপুন আমলের বহু অট্টালিকা এবং স্থাপত্যকীর্তি রয়েছে। ইতিহাস যারা চোখ দিয়ে দেখতে চান তারা এই শহরে একটিবারের জন্য হলেও ঘুরে দেখতে ভুল করেন না।