জিন কোথায় থাকে


জিন কোথায় থাকে এই প্রশ্ন নিয়ে প্রায়ই নানা সংশয়ের সৃষ্টি হয়। বিদেশ ভ্রমণে গিয়েও এর ব্যত্যয় হল না। বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা।

ভারতের দিল্লির এক কবরস্থানে ঢুকতেই আকাশটা যেন মেঘে ঢেকে গেল। কিছুদূর যেতেই ষোল বছরের একটি ছেলে এগিয়ে এসে বললো, ‘যেখানেই যান না কেন, গম্বুজের ভেতরে যাবেন না, এরই সংলগ্নে পাশাপাশি দু’টি কবর রয়েছে – সেদিকেও যাবেন না।’

উদ্দেশ্যটা জানতে চাইলে ছেলেটি বলতে শুরু করল, জানেন কিনা জানিনা, সামনে আগালেই হাঁটার সময় অচেনা অদৃশ্য অশরীরির পায়ের আওয়াজ কানে ভেসে আসবে। এই তো ক’দিন আগে এক ভদ্রলোক ব্যাকপ্যাক রেখে ক্যামেরা হাতে আলো -আঁধারির মাঝে গম্বুজের ভেতর ঢুকল। কী যেন খুঁজতে লাগল। এখানে সাধারণত দিনের বেলাতেও কেউ আসে না। মাকড়সার জালের ফাঁদ ছিড়ে একটু ভাল করে পর্যবেক্ষণ করতেই দেখা গেল লোকটি আচমকাই কিছু একটা দেখে আঁতকে উঠেছে। কানে ভেসে এল কুহকী ফিসফিস। তারপর হঠাৎই গালে হাত দিয়ে, চোখ উল্টে পড়ে গেল বিদেশি সেই লোকটি। শুধু মুখ দিয়ে একটা শব্দ অস্ফুটে শোনা গেল, ভূ… ভূত!

এরপর লোকটি জ্ঞান হারায়। তিনি গম্বুজের অন্দরে ছবি তুলতে গিয়ে অশরীরির হাতে থাপ্পড় খেয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেছিলেন।

জিন কোথায় থাকে

ছেলেটি এই কথাগুলি শুনেই হঠাৎ পাশে ও পিছনে তাকিয়ে দেখি, আমার চোখের আড়াল হয়ে গেছে ছেলেটি । তখন ভাবতে বিলম্ব হয়নি যে, এতক্ষণ আমার সঙ্গে যে ছিল, এ কথাগুলি যে শুনালো – সে-ও একটা ভূত নয়তো জ্বিন। তবে সুদর্শন বলে, এ-ও বুঝলাম, সে জ্বিন হবেই হবে।

প্রাচীন এই কবরস্থানে রাতের আঁধারে হেঁটে বেড়ায় ইতিহাসের কল্পকথার অশরীরী চরিত্ররা। অথচ এই স্থানটি ভারতের রাজধানী দিল্লিতে। যেখানে জনস্রোতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই সেখানে এমন আজব কান্ড। এ কথাগুলি ভাবতে ভাবতে লোকজন যেখানে আছে, সেখানে এসে দাঁড়ালাম।

এলাকাটি দিল্লির কুতুব মিনার যেখানে – সেখানেই এই কবরস্থান। এলাকার নাম মেহরৌলি। এই মেহরৌলি এলাকাতেই এ রকম ঘটনা ঘটছে। জামালি -কামালি মসজিদ, সেখানে রয়েছে জোড়া কবর। কবর দু’টি হল জামাল ও কামালের। মৃত্যুর পরেও ফুরিয়ে যায়নি তাঁদের প্রেম। বরং, মৃত্যুর পরে সবার আড়ালে তাঁদের নিভৃতির আয়োজন করে দিতে এই জোড়া সমাধি পাহারা দেয় ভূতেরা। আবার কখনও বা জ্বিনেরা।

ভারতে যখন লোদী বংশের রাজত্ব চলছে, সেই সময়ে এই জামালি ভারতে আসেন। তিনি ছিলেন কবি – পুরো নাম শেখ ফজলুল্লাহ। কিন্তু, সে নামে কেউই ডাকত না। ডাকনাম জামাল -ই পেয়েছিল সবার স্বীকৃতি। তিনি শেখ শামসুদ্দিনের শিষ্য ছিলেন, যিনি আরেকজন সুফি কবি ছিলেন। জামালের কবিতার মাধুর্যে আকৃষ্ট হয়েছিল সিকান্দার লোদীও। পরবর্তী সময়ে মোগলরা ভারত জয়ের পর জামালকে দরবারে স্থান দিয়েছিল। ১৫৩৫ খৃষ্টাব্দে জামালের মৃত্যুর পরে তাঁর মরদেহ সম্রাট হুমায়ুনের দ্বারা নির্মিত মসজিদের পাশে সমাধিতে সমাহিত করা হয়েছিল।

আরও পড়ুন: যুগে যুগে ভৃত্য ও ক্রীতদাস প্রথা

ট্রয় নগরী কোথায় অবস্থিত

যে রাজ্যে গেলে ফিরে আসতে ইচ্ছে হয় না

আর কামাল আদতে পুরুষ না নারী সেটা এখনও পরিস্কার নয়। তিনি নাকি নিভৃত জীবন যাপন করতেন। তবে, সেই নিভৃত জীবন জামালকে ছেড়ে ছেড়ে নাকি ছিল না। কেউ কেউ বলেন, কামাল ছিলেন জামালির শিষ্য। অনেকের মতে, তিনি সুফি কবি ছিলেন। আবার কারও মতে, তিনি একজন সামান্য সেবক ছিলেন। কামালের নিভৃত জীবনযাপনের একমাত্র কারণ হল কবিতা। যেসব কবিতা লিখে বিখ্যাত হয়েছিলেন জামাল, সেসব নাকি তাঁরই লেখা। সবাই একমত যে, জামাল ও কামালের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল, সেটা ফুটে উঠেছিল কবিতা হয়ে।

কারেন চেজ নামে একজন আমেরিকান লেখক তাঁদের উপর ‘জামালি -কামালি, এ টেল অব প্যাশন ইন মোগল ইন্ডিয়া’ নামে একটি বই লিখেছিলেন যেখানে তিনি বলেছেন যে, জামাল -কামাল আসলে সমকামী জুটি। তবে সেটা সেই সময়ের প্রেক্ষিতে মেনে নেওয়া একটু কষ্টসাধ্য।

তবে জামাল ও কামালের কবর দু’টি পাশাপাশি। আজও শোনা যায়, জামাল -কামালের প্রেমকে নিভৃতিতে মুড়ে রাখে জ্বিনরা। দিনের বেলা তারা এই চত্বরে মানুষকে রেয়াত করলেও সন্ধ্যের পর ছেড়ে কথা বলে না। সন্ধ্যা হতেই নাকি সুক্ষ্ম শরীরে আজও মিলিত হন জামাল আর কামালি। তাঁদের মিলনের ভাষা ফুটে ওঠে কবিতার মাধ্যমে। এই অলৌকিক ভালোবাসা যাতে মানুষের অবাঞ্ছিত উপস্থিতিতে ব্যাহত না হয় সেজন্যই অশরীরীদের কড়া নজরদারি থাকে।

জিন কোথায় থাকে

অনেকেই বলেন, সূর্য ডুবে যাওয়ার পরে জামাল – কামালির জোড়া গম্বুজ কোনও দিক থেকেই নিরাপদ নয়। রাত যত বাড়ে, অশরীরীর উপস্থিতি টের পাওয়া যায় এই জোড়া গম্বুজের অন্দরে। কখনও বা শোনা যায় খিলখিল হাসির রব। কুতুব মিনার এলাকার এই কবরস্থানে কেউ সন্ধ্যার পরে আর প্রবেশ করে না। সবাই জেনে গেছে, সন্ধ্যা হলেই ওই এলাকায় জ্বিন ও ভূতের আনাগোনা বেড়ে যায়। ওখানে যাওয়া মানে, গা ছমছমে অনুভূতি জাগাবে, হঠাৎ করে বয়ে আসা দমকা বাতাস দীর্ঘশ্বাসের অনুষঙ্গ বয়ে আনবে। আলো – আঁধারির মসজিদ ও কবরস্থানে সামান্য শব্দও মনে ভয়ভীতি জাগিয়ে দিবে। তখন মন বলবেই, আছে, আছে, কোথাও কিছু আছেই।

আজও মনে মনে ভাবি, জামাল -কামালির মসজিদ ও কবরস্থানে গিয়ে যে ছেলেটির সঙ্গে কথা হয়েছিল, হঠাৎ চোখের আড়ালে চলে যায় সেই সুদর্শন ছেলেটি। সে তো ছিল জ্বিন – শতভাগ নিশ্চিত সেদিন জ্বিনের সঙ্গে কিছু সময় কেটেছিল। জিন কোথায় থাকে সেই সংশয়ের অবসান না হলেও!