ফ্রান্স বিশ্বের অন্যতম সেরা পর্যটন আকর্ষণ। শিল্প ও সাহিত্যের নগরী হিসাবে প্যারিসের খ্যাতি সুবিদিত। ফ্রান্সের প্রধান পর্যটন আকর্ষণসমূহ নিয়ে লিখেছেন দুই বাংলার অন্যতম সেরা ভ্রমণ লেখক লিয়াকত হোসেন খোকন
Table of Contents
ফরাসী দেশই হল ‘ফ্রান্স’। এর আরেক নাম ‘রিপাবলিক ফ্রাংকইস’। ফ্রান্সের রাজধানীর নাম প্যারিস।
প্যারিস শিল্প -বাণিজ্য ও ইট -পাথরের নগরী। আবার এই প্যারিসকে বলা হয় স্থাপত্যশিল্পের নগরী।
এই নগরীর রাস্তার ধারে বড় বড় বাড়িতে, সেইন নদীর ওপর ব্রিজের গায়ে, কনকর্ড স্কোয়ারে, নটরডেম চার্চের গায়ে রয়েছে নানা ভঙ্গিমায় বিভিন্ন ধরনের ভাস্কর্য। কেবল মানুষের ভাস্কর্য নয়, পশু – পাখিও নানা ভঙ্গিতে শোভা পাচ্ছে এবং এগুলো দেখলে মনে হবে যেন প্রত্যেকটি জীবন্ত।
স্থাপত্যশিল্পের নগরী এ প্যারিসে ইউরোপের অন্য শহরের তুলনায় অনেক বেশি লোক বসবাস করে।
প্যারিসে গাড়ির সংখ্যাও অনেক বেশি এজন্য এ নগরীর রাস্তাঘাটে জ্যামও হয় বেশি। জ্যাম হয়েছে তাতে কী, এজন্য কেউ ধৈর্য হারায় না। কেউ কাউকে ওভারটেক করে না। কোন হর্ণও বাজে না তখন। নিঃশব্দে গাড়িগুলো পরস্পরের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে এগিয়ে চলে।
প্যারিসে যারা ভ্রমণে আসেন তারা আইফেল টাওয়ার না দেখে ফেরেন না। এ টাওয়ারটির উচ্চতা এক হাজার তেষট্টি ফুট। এর ওপর উঠে নিচে তাকালে দেখা যায় সেইন নদী। শুধু তাই নয়, প্যারিস শহরও দেখা যায় এক নজরে। টাওয়ারের ওপর থেকে সেইন নদীকে ছোট একটা খালের মতো আর মানুষগুলোকে পিঁপড়ার মতো মনে হবে।
১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে এই আইফেল টাওয়ার তৈরি হয়। এখানে আইফেল টাওয়ারের মডেলও কিনতে পাওয়া যায়।
প্যারিসে রয়েছে ল্যুভর মিউজিয়াম। এই মিউজিয়ামে রয়েছে ৩০ হাজার ছবি, প্রচুর ভাস্কর্য। ভাস্কর্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো – মাইকেল অ্যাঞ্জেলো, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি প্রমুখ শিল্পীর সৃষ্ট সব ভাস্কর্য দেখলে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়। মনে হবে প্রতিটি ভাস্কর্য যেন জীবন্ত, এদেরও বুঝি প্রাণ আছে। মাইকেল অ্যাঞ্জোলোর আঁকা অপূর্ব সব পেইন্টিংও দেখার মতো। এসব বিরাট পেইন্টিংয়ের ঔজ্জ্বল্য এতদিন পরও এতটুকু মলিন হয়নি। ছবিতে যিশুর জীবনের নানা ঘটনা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
পৃথিবী বিখ্যাত মোনালিসার আসল ছবিও রয়েছে ল্যুভর মিউজিয়ামে। এটি এঁকেছিলেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি। ছবিটি যাতে চুরি না হয়ে যায় তার জন্য এখানে সার্বক্ষণিক ৪ জন গার্ড রয়েছেন।
দুই হাজার বছরেরও বেশি ঐতিহ্যের অধিকারী প্যারিস নগরী বিশ্বের অন্যতম বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। প্যারিসের লা দেফঁস ইউরোপের বৃহত্তম পরিকল্পিত বাণিজ্যিক এলাকা।
ভ্রমণ নিয়ে আরও পড়ুন: মরক্কোর প্রাচীন কীর্তিময় ৭টি শহর যা দেখলে আপনিও বিমোহিত হবেন
প্যারিসের নোত্র দাম গির্জা, শঁজেলিজে সড়ক, আর্ক দ্য ত্রিয়োমখ, বাজিলিক দ্যু সাক্রে ক্যর, পন্তেওঁ, গ্রঁদ আর্শ, পালে গার্নিয়ে লেজাভালিদ, ল্যুভ্র জাদুঘর ইত্যাদিও দেখার মতো।
প্যারিস ছাড়াও ফ্রান্সের উল্লেখযোগ্য শহর হলো – নানটেস, লিয়ঁ, মার্সেলস, ট্রামবার্গ, বোর্দো, ভার্সাই।
ফ্রান্সের রোন নদী পাহাড় পথ বেয়ে নেমে গেছে সমুদ্রের দিকে। সেই সমুদ্রের পানির থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করার ব্যবস্থা হয়েছে। ফলে সস্তায় ফ্রান্সের সর্বত্র বিদ্যুৎ পাওয়া যায়।
ফ্রান্সের দর্শনীয় স্থান –
লিয়ঁ –
ঢালু পাহাড়ের সড়ক ধরে ফ্রান্সের লিয়ঁ শহরে যাওয়া যায়। লিয়ঁ গুরুত্বপূর্ণ শহর। তাঁতশিল্পের মস্ত ঘাঁটি, যাকে বলা হয়, ফ্রান্সের ম্যানচেস্টার। ফ্রান্সের অন্যান্য বড় শহরের মধ্যে এই শহরটি উত্তর সাগর ও ভূমধ্যসাগরকে সংযোগকারী প্রাচীন রোন উপত্যকায় অবস্থিত।
মার্সেলস –
এটি বিরাট বন্দর ও বড় শহর। এখানে আশ্চর্য আধুনিক স্থাপত্যের ছড়াছড়ি। এখানে করপুসিয়েরের তৈরি দি মার্কেট একটা প্রকাণ্ড বাড়ি। সব জিনিস পাওয়া যায় তার মধ্যে, যেমন – সিনেমা, ডাক্তারখানা, হোটেল, বাজার ইত্যাদি।
মার্সেই –
মার্সেই শহরটি ভূমধ্যসাগরের উপকূলে অবস্থিত একটি বহুজাতিক সমুদ্র বন্দর। গ্রিক ও কার্থেজীয় বণিকেরা খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে এ শহরের পত্তন করে।
নঁত –
এ শহরটি আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে অবস্থিত একটি গভীর পানির পোতাশ্রয় ও শিল্পকেন্দ্র হিসেবে খ্যাত।
গারন –
ফ্রান্সের এ শহরটি গারন নদীর তীরে অবস্থিত। দক্ষিণ -পশ্চিম ফ্রান্সের প্রধান শহর এই গারন।
মার্তিনিক –
ক্যারিবিয়ান দ্বীপ মার্তিনিকে এক মিউজিয়ামে নেপোলিয়ন আর জোসেফিনের ছবি রয়েছে। মার্তিনিক স্থানটি হল নেপোলিয়নের শ্বশুরবাড়ি। নেপোলিয়নের রানী হলেন জোসেফিন। আর এই জোসেফিনের জন্ম ক্যারিবিয়ান দ্বীপ মার্তিনিকে।
গল্পে আছে, একবার জোসেফিনকে দেখে এক জ্যোতিষি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তার প্রথম বিয়ে সুখের হবে না এবং বিধবা হবেন। আবার বিয়ে হবে, তবে অল্পসময়ের জন্য ফ্রান্সের মহারাণী হবেন। এ কথা শুনে জোসেফিনের বাবা বিশ্বাস করতে পারলেন না। ১৭৭৯ খ্রিস্টাব্দে জোসেফিনের বিয়ে হল সামরিক বাহিনীর এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে। চলে এলেন প্যারিসে – দুই ছেলেমেয়ের মা হলেন।
এদিকে ফরাসী বিপ্লবে জোসেফিন স্বামীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে সেই সময় নেপোলিয়ন বোনাপার্টের সঙ্গে দেখা। তারপর তো দু’জনার মধ্যে গভীর প্রেম। বিয়ে হলো ওদের। নেপোলিয়নের চেয়ে ছয় বছরের বড় জোসেফিনের চেহারায় ছিল দ্বীপের সূর্যের ঔজ্জ্বল্য। সম্রাট নেপোলিয়নকে উত্তরাধিকার দিতে পারেননি জোসেফিন। তাই ওদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেল কয়েকবছর পরেই। অতঃপর নেপোলিয়ন অষ্ট্রিয়ার রাজকুমারীকে বিয়ে করলেন। কিন্তু নেপোলিয়ন ভুলতে পারেননি জোসেফিনকে। নেপোলিয়নের শ্বশুরবাড়ি মার্তিনিকে এরও আগে ১৫০২ খ্রিস্টাব্দে কলম্বাস এসেছিলেন। পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর দ্বীপ লিখেছিলেন তার রোজনামচার খাতায়। পান্না সবুজ বন আর সুগন্ধি ফুলের শোভা সহজেই মন জয় করে নিয়েছিল কলম্বাসের।
লেসোজি –
ফ্রান্সের এক অজপাড়া গাঁ লেসোজি। এই ছোট্ট গ্রামে রয়েছে এক প্রাগৈতিহাসিক ভান্ডার। পাহাড় ঘেরা লেসোজিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রচুর গুহা।
ফ্রান্স হল পশ্চিম ইউরোপে অবস্থিত একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এই ফ্রান্স দেশটি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে পশ্চিমা বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাতিগুলির একটি রাষ্ট্র। আটলান্টিক মহাসাগর, ভূমধ্যসাগর, আল্পস পর্বতমালা ও পিরিনীয় পর্বতমালা -বেষ্টিত ফ্রান্স বহুদিন ধরে উত্তর ও দক্ষিণ ইউরোপের মাঝে ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক ও ভাষিক সংযোগসূত্র হিসেবে ভূমিকা পালন করে আসছে। আয়তনের দিক থেকে ফ্রান্স ইউরোপের তৃতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র।
ফ্রান্সের প্যারিস মধ্যযুগ থেকেই পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিশ্বখ্যাত হয়ে আছে।