পশ্চিমবঙ্গ হাজীপুর নামক ছোটো গ্রামের ছেলে অরুন । এবছর হাই সেকেন্ডারি পরীক্ষা দিয়ে ঘরে বসে আছে । বাড়ির আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো নয় । পাড়ায় বাবার ছোট এক মুদির দোকান । বয়স্ক বাবার মতোই দোকানের অবস্থা ও জীর্ণ । ছোট থেকে অরুনের পড়াশোনা , ঘুরে বেড়ানোর প্রতি ঝোঁক । অরুনের স্বপ্ন অনেক দূর পড়াশুনা করে , ভালো উপার্জন করে গ্রামের মানুষদের জন্য কিছু করবে ।
এই গ্রামে শিক্ষা ব্যবস্থা , চিকিৎসা ব্যবস্থা , যোগাযোগ ব্যবস্থা সব দিক থেকেই পিছিয়ে । অরুন এবার শহরে গিয়ে কলেজে ভর্তি হবে । শহরের উঁচু উঁচু বিল্ডিং , পাকা সড়ক , উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা , কলেজ , লাইব্রেরী আরো কত কিছু রোজ তাকে হাতছানি দেয় । এই গন্ডগ্রামে সুযোগ সুবিধার অভাবে বেশির ভাগ টায় শহরের উপর নির্ভর করতে হয় । এদিকে অরুনের বাবার শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ার সাথে ঘরের আর্থিক অবস্থার ক্রমশ অবনতি হতে থাকে । এই অবস্থায় মধ্যবিত্ত ঘরের জোয়ান ছেলের স্বপ্ন দেখে বিলাসিতা করা আর সাজে না । আপাতত কলেজে পড়ার স্বপ্ন স্থগিত রেখে কাজ কর্মের সন্ধানে যেতে হবে । সবে মাত্র হাই সেকেন্ডারি পরীক্ষা দেওয়া ছেলেকে কোন অফিসে কাজ দেবে । কাজ কর্মের সন্ধানে শহরের এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায় তবুও কাজ জোটে না । একদিন শহর থেকে গ্রামে ট্রেনে ফেরার পথে এক মাঝবয়স্ক ভদ্রলোকের সাথে আলাপ হয় অরুনের । ভদ্র লোকটি গল্পগুজব করতে ভালোবাসেন। একথা সেকথার পর অরুন নিজের সমন্ধে বলে , ওর গ্রামের সম্মন্ধে , বাড়ির আর্থিক অবস্থার সম্মন্ধে কথা বলেন ভদ্রলোককে ।
ভদ্রলোকটি কোল মাইনিং কোম্পানির সুপারিনটেনডেন্ট । তিনি অরুনের জন্য একটা কাজ জুটিয়ে দিতে পারবেন । তবে সেটা তার গ্রাম থেকে অনেকটা দূর । খাওয়া থাকার ব্যবস্থা কোম্পানি থেকেই পাবে। অরুন ওই ভদ্র লোকটির কাছে একদিন সময় চেয়ে নিল বাড়িতে জানানোর জন্য , পরের দিন এসে ভদ্রলোককে জানবে , সেই সাথে অরুন ভদ্র লোকটির আসা যাওয়া সময় জেনে নিল। পরের দিন বাড়ির মতামত নিয়ে ভদ্রলোকের সাথে বন্দোবস্ত করে অরুন চলে গেল কয়লাখনির অঞ্চল রাণীগঞ্জে ।
অরুনের কাজের তেমন কোনো অভিজ্ঞতা না থাকায় তাকে শুধু শ্রমিক এবং কুলিমজুরদের হাজিরার তালিকা দেখতে হতো , এইটুকুই ছিল তার কাজ । এখানে কাজকর্ম করে , উপার্জনের কিছু টাকা হাতে রেখে বাড়িতে পাঠিয়ে দিব্যি চলে যায় অরুনের । প্রায় সুপারিনটেনডেন্ট সাহেবের সাথে অরুণের সন্ধ্যায় চায়ের আড্ডা বসে । ভদ্রলোক এই কোম্পানির সাথে যুক্ত তার পিতামহের আমল থেকে , তারা বংশ পরম্পরায় এই কোম্পানির সাথে যুক্ত । তাই কোম্পানির সমস্ত ওঠাপড়া ভদ্রলোকের অবহিত ।
সেই দিন কুয়াশার ন্যায় চিমনির ধোঁয়ায় চাদরে আচ্ছন্ন শীতের সন্ধ্যায় , চায়ের পেয়ালায় এক চুমুক দিয়ে ভদ্রলোক নিজেই বলে গেলেন – সালটা তখন ১৭৭৪ , জন সুমার এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সুয়েটোনিয়াস গ্যান্ট হিটলী বর্তমানে সালানপুর উন্নয়ন ব্লক সেই দিন কুয়াশার ন্যায় চিমনির ধোঁয়ায় চাদরে আচ্ছন্ন শীতের সন্ধ্যায় , চায়ের পেয়ালায় এক চুমুক দিয়ে ভদ্রলোক নিজেই বলে গেলেন – সালটা তখন ১৭৭৪ , জন সুমার এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সুয়েটোনিয়াস গ্যান্ট হিটলী বর্তমানে সালানপুর উন্নয়ন ব্লক , ইথোরার নিকটে ভূগর্ভস্থ কয়লা খুঁজে পেয়েছিলেন । এজেন্সি হাউস আলেকজান্ডার এবং কো. এর পরিচালনায় ১৮২০ থেকে নিয়মিত কয়লা খোঁড়া শুরু হতে থাকে । বাঙালি শিল্প বিমুখ চিরাচরিত এই প্রথা ভেঙে ভারতীয় শিল্প-বাণিজ্যের অগ্রণী পুরুষ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর রাণীগঞ্জ অঞ্চলের মধ্যবর্তী দামোদর নদের তীরে নারান কুড়ি গ্রামে জমি অধিগ্রহণ করে খনন কার্য বিশাল কুয়োখাদ বানিয়ে ভূগর্ভস্থ কয়লা উত্তোলন করা শুরু করেন ।
আরও পড়ুন: ভ্রমণ:ইংল্যান্ডের লেক ডিস্ট্রিক্টের অপরূপ নিসর্গে এক ভারতীয় দম্পতি
১৮৩৫ সালে ব্রিটিশ শিল্পপতি উইলিয়াম কার সাথে যৌথ উদ্যোগে দ্বারকানাথ ঠাকুর কার অ্যান্ড টেগোর কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৪৩ এ উইলিয়াম প্রিন্সেপের আদেশানুসারে , কার অ্যান্ড টেগোর কোম্পানি গিলমোর হমব্রে অ্যান্ড কোম্পানির সাথে যুক্ত হয়ে বেঙ্গল কোল কোম্পানি গঠন করে, কয়লা খনির কাজকর্ম শুরু করে। প্রথম দিকে স্বাভাবিক ভাবেই চাহিদা কম থাকায় উৎপাদন কম থাকে তারপর ধীরে ধীরে বাস্প ইঞ্জিন (১৮৫৩ সাল) এর প্রবর্তনের ফলে চাহিদার সাথে সাথে উৎপাদন বৃদ্ধি পেতে শুরু করে , প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ কালীন এর চাহিদা এবং উৎপাদন উভয়েই অধিক বৃদ্ধি পায় । তারপর কালের অতিক্রমের সাথে সাথে অনেক ওঠাপড়া জড়িত। সমগ্র ভারতবর্ষের মধ্যে রাণীগঞ্জই একমাত্র সর্বোচ্চ গুণমানের ৩৩৯ কোটি মেট্রিক টন কাঁচা কয়লা উৎপাদন করে বার্ষিক $১০৮ কোটি আয় করে। অরুনের মত সুপারিনটেনডেন্ট ভদ্রলোকও ঘুরতে ভালোবাসেন । একদিন সন্ধ্যায় ভদ্রলোক এসে বললেন অরুনকে এসে বললো রোববার তো ছুটি , কি প্ল্যান ? অরুন বললো কি আর কিছুই না । তখন সুপারিনটেনডেন্ট ভদ্রলোক বললেন তাহলে রোববার ভোরবেলায় তৈরী থেকো , তোমাকে লাল পাহাড়ীর দেশ পুরুলিয়া ভ্রমণ করিয়ে নিয়ে আসব। আগের থেকে গাড়ি ভাড়া করে রাখব , ভোরে বেরিয়ে পড়ব বড়ন্তী লেক , গড় পঞ্চকোট , আর জয়চণ্ডী পাহাড়ের মেলা ফেরার পথে বড়ন্তীর সূর্যাস্ত দেখে ফিরব । বহুদিন বাড়ি ছেড়ে এই অজানা দেশে অরুনের মন হাঁপিয়ে উঠেছিল। ভদ্রলোকের সাথে বেড়াতে যাওয়ার কথা শুনে অরুনের তরতাজা প্রাণে হঠাৎ করে দ্রুত রক্তের স্রোত বয়ে গিয়ে মনটা নেচে উঠল ।
সেদিন রাত্রে উত্তেজনার বশে ভালো করে ঘুম হলো না যদি ভোরে উঠতে না পারে , সেই উত্তেজনা আর কৌতূহল লাল পাহাড়ীর দেশ ! বশে প্রায় না ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিল সারা রাত । বড়ন্তী লেক
ভদ্রলোকের কথা মত সপ্তাহান্তে ভোর ৫ টায় গাড়ি করে দুজনে রওনা দিল পশ্চিমবঙ্গ লাল পাহাড়ীর দেশ পুরুলিয়ায় । শীতের ভোরের কুয়াশা মাখা দিগন্ত জুড়ে শিশু সূর্যের নরম আলো সামনে রেখে মনোরম প্রাকৃতিক মনোরম শোভা দেখতে দেখে রাঙ্গামাটির পথ দিয়ে তাদের গাড়ি এগিয়ে চলল।
দুপাশালি শাল, পিয়াল, পলাশ, আকাশমণি, মহুয়া গাছের ঘন জঙ্গলে ঘেরা লালমাটির পথ । গাছের ডালে পাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে সূর্য । মাঝে মধ্যে কাঁচা পাকা সড়ক ,রাস্তার দুপাশে ছোটো বড় খেজুর গাছ , আগাছা , পাতার গায়ে শিশিরের জমে থাকা শিশির নরম সূর্যের আলোয় ঝকমক করে উঠছে আর সাথে চারিদিক জুড়ে খেজুর রসের মাতাল করা গন্ধ । রাস্তার দুপাশে বিস্তৃত চাষ জমি। নীল আকাশ আর সবুজ গাছ মিলে কে যেন দিগন্ত টেনে দিয়েছে আর সামনে পাহাড়ের মাথার চূড়া ।
ভদ্রলোক যদিও গল্প করতে ভালোবাসে তবুও ভদ্রলোক গাড়িতে বসে একটি কথাও বললেন না শুধু গাড়ির গ্লাস উইন্ডো দিয়ে রাস্তার দিয়ে চেয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছিলেন । আর অরুন ; অরুন তো গাঁয়ের ছেলে গ্রামগঞ্জের মাটি , গাছপালা, পথঘাট টাটকা বাতাস , গ্রামের স্নিগ্ধতা , পাখির কাকলি এইসব শুনেই বড় হয়েছে ।
অরুনের দিব্যি লাগছিল সব দেখতে । দুজনেই পিছনে রাস্তা ফেলে সামনের প্রাকৃতিক শোভা দেখছিল গাড়িতে বসে। শহুরে সভ্যতার বাইরে ছোট্ট আদিবাসী গ্রাম । পিছনে রাস্তা ফেলে যতই গাড়ির এগিয়ে চলা সামনে দিগন্ত দূরে বিস্তৃত পাহাড়ের হাতছানি । মুরাডি লেকের অপর পাড়ে উপর অবস্থিত ছোটো ছোট জঙ্গলময় টিলা গুলি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এর অন্য মাত্রা যোগ করেছে । গাড়িতে ড্রাইভার বলল এই বড়ন্তী লেকে , শুধু সূর্যাস্তের পার্থিব মায়াবী অপরূপ অসাধারন দৃশ্য দেখতে দূরদূরান্ত থেকে এখানে পর্যটকরা আসে। ভারত ভ্রমণে সাময়িকের জন্য এক অন্য জগতে হারিয়ে যাওয়া যায় ।
বিস্তৃত আকাশ জুড়ে নিস্তেজ জ্বলন্ত ঘোলাটে সাদা ভাবের লাল কমলা গোলাকৃতি বলয় সূর্য ছোটো গ্রামটিকে আলোকিত করে রাখার মরিয়া চেষ্টায় টিলার উপর ঝুলন্ত সূর্য। বৃদ্ধ সূর্যের সব আলো তেজ নিস্তেজ হয়ে যাবার পর পশ্চিমাকাশে টিলার চূড়ার ওপারে সূর্যের হারিয়ে যাওয়ার অসাধারন দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায় । আমাদের গাড়ি দামোদর নদী ক্রস করে মেজিয়া মোড় থেকে থেকে ডানহাতি শালতোড়া মেজিয়া রোড থেকে শালতোড়া ক্রস করে সাতুরী থকে ডান দিকে সোজা গিয়ে ছোটো ছোট গ্রাম আমবারি , তালবেরিয়া পার করে অবশেষে বড়ন্তী এসে পৌঁছাল ।
বড়ন্তী লেকে এসে তাদের গাড়ি পৌঁছালো তখনও সম্পূর্ণ রোদ ওঠেনি , কুয়াশার চাদরে মোড়া লেক , সাদা নীলের সংমিশ্রণে আকাশ আর লেকের জল মিশে একাকার । শীতের ঠাণ্ডা বাতাস চোখে মুখে এসে লাগছে । অরুন চোখ বন্ধ করে খানিকটা বাতাস এক নিঃশ্বাসে টেনে নিল , খানিকটা ঠাণ্ডা হাওয়া চোখে মুখে লাগিয়ে শীতের সৌন্দর্যকে এক নিঃশ্বাসে ঢোক গিলে উদরস্ত করে নিল। কিছুক্ষন তিনজনেই লেকের ধারে বসে রইল , তারপর ধীরে ধীরে পূব আকাশে গোলাকার লাল সূর্য মুখ তুলে চাইতেই লেকের জলে লালচে আভা দেখা দিল সে এক দারুণ দৃশ্য ।
পশ্চিমবঙ্গ ভ্রমণে আরো কিছুক্ষন তারা লেকের ধারে বসে রইলো তারপর উঠে গিয়ে ওখানে পাশাপাশি অনেক হোটেল আছে , ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়ে সাথে দুপুরের খাবার প্যাক করে তাদের গাড়ি রওনা দিল ।
গড় পঞ্চকোট
পশ্চিমবঙ্গ ভ্রমণে বড়ন্তী লেক থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটারের রাস্তা , শীতের সকালের নরম মিষ্টি রোদ আর ঘন নীল আকাশ , মাঝে সরু রাস্তা আর দুপাশের নিবিড় সবুজের আলিঙ্গনে তাদের গাড়ি এগিয়ে গেল গড় পঞ্চকোট এর উদ্দেশ্যে । গাছের ফাঁক দিয়ে রৌদ্রের ছায়ায় সিক্ত রাস্তা । কালের নিয়মে ফেলে আসা একটুকরো ইতিহাসের নীরব সাক্ষী বহন করছে এই গড় পঞ্চকোট । সাম্রাজ্যের উত্থান পতনের দলিল।
‘গড়’ মানে দুর্গ, ‘পঞ্চ’ মানে পাঁচ এবং ‘কোট’ মানে গোষ্ঠী। পূর্ব ভারতে পাঞ্চেত পাহাড়ের নীচে ৯০ খ্রীষ্টাব্দে চাকলা পঞ্চকোট রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দামোদর শেখর । ঝালদা অঞ্চলের পাঁচ আদিবাসী সর্দারের সাহায্যে রাজত্ব কায়েম করেছিলেন । পোড়ামাটি আর পাথর মিলে ছোট বড় মিলে প্রায় চল্লিশটি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন । বাংলার নবাব আলীবর্দী খাঁর আমলে মারাঠা সেনা প্রভুজী ভোঁসলে গড় আক্রমণ করে । গড় রক্ষা করতে অসমর্থ হলে পরাজিত রাজারা পালিয়ে যায় এবং তাদের সতেরো জন রানী আত্নসন্মান রক্ষার্থে কুয়োয় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন ।
গড় রক্ষা করতে অসমর্থ হলে পরাজিত রাজারা পালিয়ে যায় এবং তাদের সতেরো জন রানী আত্নসন্মান রক্ষার্থে কুয়োয় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন ।
বর্গীর দল ১৭৪০-৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে লুটপাট চালিয়ে ,গড় পঞ্চকোটকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছিল ।
প্রাচীন স্থাপত্য ভাস্কর্যের নিঃশব্দে সাক্ষ্য বহন করছে এই সিংহ দুয়ার , তোরণ ,নজর মিনার , গম্বুজের ভগ্নস্তূপ গুলি । এককালীন রাজকীয় ঐশ্বর্য জাঁকজমক রাজমহল আজও আগাছা , গাছপালা আর রাশিকৃত ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে ইতিহাস বাঁচিয়ে রাখার মরিয়া চেষ্টায় খোলা আকাশের নীচে দন্ডায়মান। ভারত ভ্রমণে পঞ্চরত্ন মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ , খিলান ও স্তম্ভের গায়ে প্রাচীন কালের টেরাকোটার শিল্পকর্ম এখানকার প্রধান আকর্ষণ ।
পশ্চিমবঙ্গ ভ্রমণে স্থাপত্যের অবশিষ্টাংশ ধ্বংসাবশেষ দেখতে দেখতে এর দেখতে দেখতে ভদ্রলোক অরুণকে এই ইতিহাস বলছিলেন । ওখানেই এক পর্যটকের সামনে তাদের কথাবার্তা চলছিল , গল্পগুজব করতে করতে বলেই দিলেন শহরের কোলাহল থেকে নির্জনে সপ্তাহান্তে একদিনের ছুটিতে এই লাল পাহাড়ীর দেশ পুরুলিয়া ভ্রমণ এর জন্য আদর্শ জায়গা । আমি সুযোগ পেলেই এই পাহাড়ির দেশে আসি। আমার কলকাতায় বাড়ি । এরপর উভয়েই একে অপরের নমস্কার জানিয়ে আমরা গাড়িতে উঠলাম।
জয়চন্ডী পাহাড়
এরপর আমাদের গাড়ি রওনা দিল ২১ কিলোমিটার দূরত্বে জয়চন্ডী পাহাড় । পাশের সঙ্গী ছিল দুপাশের সবুজ গাছগাছালি । লাঞ্চ গাড়িতে বসেই সেরে নিল , আবার লাঞ্চ এর জন্য হোটেলে নামলে সময় নষ্ট হবে তাই আগে থেকে প্যাকিং করা খাবার খেয়ে নিল তিনজনে। সেই সময় মেলা চলছিল , বছর শেষে জমজমাট পর্যটন উৎসব হয় জয়চণ্ডী পাহাড়ে ।
পশ্চিমবঙ্গ ভ্রমণে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা এই উৎসবে যোগ দিতে আসে । বিস্তৃত একর জমি জুড়ে পশ্চিমবঙ্গ পুরুলিয়া’র রঘুনাথপুরে অবস্থিত এই পাহাড় । ট্রেকিং এর ব্যবস্থা আছে ।
দুপাশে বড় বড় এবড়ো খেবড়ো ছড়ানো ছিটানো পাথর , মধ্যে মধ্যে ছোট ছোট গাছপালা আর পাহাড়ের ধাপ কেটে বানানো সিঁড়ি , ৪৯০ টি সিঁড়ি অতিক্রম করে দেবী চণ্ডীর মন্দির । ভারত ভ্রমণে প্রাণ ভরে টাটকা বাতাস নেওয়া যায় ।
বিশ্ব বরেণ্য কালজয়ী চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের অমরজয়ী চলচ্চিত্র হীরক রাজার দেশ এর অধিকাংশ শুটিং হয়েছিল এই জয়চণ্ডী পাহাড় ও তার আশেপাশে । বাঙালির আবেগকে বজায় রেখে এর মেলার প্রধান আকর্ষণ গুপী গাইন বাঘা বাইন এর ছৌ নৃত্য । পাহাড় ঘুরে মেলা দেখে আবার সন্ধ্যে নামার আগে বড়ন্তী লেকের সূর্যাস্তের দেখার জন্য রওনা দিলাম ।
পশ্চিমবঙ্গ’র পুরুলিয়া কিংবা বড়ন্তী লেকের অপরূপ সূর্যাস্তের সৌন্দর্য সমন্ধে ড্রাইভার যা বলেছিল , নিজের চোখে ভদ্রলোক ও অরুন দেখলো , এ সৌন্দর্য প্রকাশের কোনো ভাষা হয় না । মনোমুগ্ধকর এই পার্থিব সৌন্দর্য শুধু নিঃশব্দে উপভোগ করা যায় । চোখের ক্যামেরায় যতটা সম্ভব ফ্ল্যাশ বন্দি করে মনের মণিকোঠায় রাখা যায় সেই চেষ্টায় তিনজনে বাকরুদ্ধ হয়ে রইল। তারপর গাড়ি করে আবার কয়লার রাজ্যে রাত্রি নাগাদ ফিরে আসা। সারাদিনের ক্লান্তিতে আসা ঘুম আর চোখের পাতায় লেগে থাকা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বুকে নিয়ে লাল পাহাড়ীর দেশ , রাঙা মাটির দেশ পুরুলিয়া ভ্রমণ করে অরুন ঘুমিয়ে পড়ল।
অল্প সময়ের মধ্যে , সাধ্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ ভ্রমণের জন্য পুরুলিয়া একটি আদর্শ জায়গা । থাকা খাওয়ার জন্য রিসোর্ট , হোটেলের সু-বন্দোবস্ত আছে ।
কীভাবে যাবেন ?
কলকাতা থেকে বড়ন্তী
পশ্চিমবঙ্গ ভ্রমণে সড়ক পথে কলকাতা থেকে দূরত্ব প্রায় ২৫০ কিমি । দুর্গাপুর এক্সপ্রেস ওয়ে হয়ে বর্ধমানের উপর দিয়ে আসানসোল । পাঞ্জাবি মোড় থেকে বাদিক নিয়ে রাণীগঞ্জ হয়ে । রানীগঞ্জ স্টেশন (বাস এবং ট্রেন লাগোয়া ) এর গা দিয়ে মেজিয়া হয়ে পুরুলিয়া ।
রেলপথে কলকাতা থেকে দূরত্ব ২৬৩কিলোমিটার। হাওড়া, শিয়ালদা কলকাতা স্টেশন থেকে ডাইরেক্ট ট্রেনে আসানসোল। আসানসোল থেকে আদ্রা লাইনে পর পর তিনটি স্টেশন পেরোলেই মুরাডি স্টেশন । স্টেশন থেকে ছ’কিলোমিটার দূরত্বে বড়ন্তী । তাছাড়াও আসানসোল স্টেশন থেকে গাড়ি ভাড়া করে ৩৮ কিলোমিটার দূরত্বে বড়ন্তী যাওয়া যায়।
রাত্রিবাসের ঠিকানা
১) বড়ন্তী ওয়াইল্ড লাইফ অ্যান্ড নেচার স্টাডি হাট: দুটো রুম , ভাড়া পার ডে ৬৫০-৯০০ টাকা
চারটে রুম , ভাড়া পার ডে ৮০০ টাকা ।
সুইটের ভাড়া পার ডে ১০০০ টাকা ।
যোগাযোগ: ৯৮৭৪৮৮৭০৪৬, ৯৪৩৩০৭৭৯৫১
২) বড়ন্তী লেক হিল রিসর্ট:
দুটো রুম , ভাড়া পার ডে ৮০০ টাকা
চারটে রুম, পার ডে ভাড়া ১০০০ টাকা
যোগাযোগ: ৯৪৩২২৯৬১৭৮, ৯৫৬৪৯২৫৮৭২
আরও পড়ুন: লন্ডনের বিখ্যাত পর্তোবেলো রোড মার্কেট