যেভাবে উত্তর আমেরিকার রকি পর্বতমালা পর্যটনের কেন্দ্রবিন্দু


রকি পর্বতমালা উত্তর আমেরিকার বিস্তর এলাকা জুড়ে আছে। এর মধ্যে বড় একটা অংশ কানাডায়। রকি পর্বতমালা নিয়ে লিখেছেন দুই বাংলার অন্যতম সেরা ভ্রমণ লেখক লিয়াকত হোসেন খোকন

Table of Contents

আমেরিকা আর কানাডা বসবাস করে বাংলাদেশের বহু লোক। তাদের অনেককেই জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনারা কি রকি পাহাড় দেখেছেন?’ তাদের সাফ জবাব, নাম তো শুনিনি, তবে আমার বোনের ছেলের নাম রকি। তাছাড়া দর্শনীয় স্থান যে দেখবো, সে সময় কোথায়? কর্মস্থল আর গৃহ – এই দুইয়ের মধ্যে আমরা যে বন্দী।’

রকি পর্বতমালা মেক্সিকোর উত্তরপ্রান্ত থেকে শুরু হয়ে যুক্তরাষ্ট্র বা আমেরিকা আর কানাডা পর্যন্ত বিস্তৃত। কানাডার এই পর্বতমালা ব্রিটিশ কলম্বিয়া এবং আলবার্ট রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে আছে।
ভূতাত্ত্বিকদের মতে, আজ থেকে প্রায় দশ কোটি বছর আগে অসংখ্য চূড়া বিশিষ্ট বিশাল এই পর্বতমালা খুবই ধীরগতিতে ভূত্বক ভেদ করে আকাশে মাথা তুলেছিল। এই পর্বতমালার পঞ্চাশটা শৃঙ্গের উচ্চতা দশ হাজার ফুটের বেশি।

বর্তমানে কানাডিয়ান রকিস এক বিরাট পর্যটন আকর্ষণ কেন্দ্র। এখানকার শান্ত পরিবেশে প্রকৃতি ছড়িয়ে রেখেছে বরফাবৃত শৃঙ্গ ঝকঝকে হিমবাহ, ছবির মতো হ্রদ, ছোট -বড় ঝর্ণা এবং সবুজ বনভূমির এক চিত্রকল্প। এখানেই রয়েছে বানফ শহর। এখান থেকে চওড়া পাকা রাস্তা চলে গেছে মাউন্টেনের দিকে। টানেল মাউন্টেনে কোনও টানেল নেই।

একদা কানাডা প্যাসিফিক রেলওয়ে এই পাহাড়ে টানেল কেটে লাইন পাতার কথা ভাবলেও আর্থিক কারণে সেই পরিকল্পনা পরিত্যক্ত হয়েছিল। তবে এই পাহাড়ে টানেল বানানো হবে এই ভাবনা থেকেই এর নাম হয়ে গেল টানেল মাউন্টেন। এখনও তাই চলছে। একটু পাকদণ্ডী হয়ে রাস্তা ক্রমশ ওপরে উঠেছে। এর সামনে রয়েছে মাউন্ট রুন্ডাল এবং সালফার মাউন্টেনের প্রান্তরেখা। আরেকটু উপরে স্প্রে রিভার এবং বো রিভারের সঙ্গমস্থল। তার একটু উপরে ন্যাড়া খোলা জায়গা।

nanewlnd
মানচিত্রে রকি পর্বতমালা। Image copyright: Worldatlas

এখানে দাঁড়িয়ে চোখে পড়ে বানফ শহরের পুরোটা। এছাড়াও দেখা যায় রুন্ডাল পর্বতের ভিত্তি থেকে শিখরে উঠে যাওয়া। আরেকটা মজার ব্যাপার কি, এখানে পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত বানানো রয়েছে পাটাতন রাস্তা। কাঠের শক্ত শক্ত খুঁটির ওপর লাগানো হয়েছে কাঠের পাটাতন। ওপরে সর্বত্রই কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া। প্রতিটি বাঁকেই রয়েছে অবজারভেশন ডেক।

নিচে তাকালে দেখা যায় স্ট্রবেরি, স্প্রুস, ফার ইত্যাদি গাছের নিচে জমাটবাঁধা বরফ এবং তারই ফাঁকে ফাঁকে লতাগুল্ম ও আগাছা জাতীয় ছোট ছোট গাছ। সামনের দিকে একটার পর একটা নাম না জানা পর্বতশৃঙ্গ। একেকটা একেকরকম সুন্দর। কোনওটা পুরোপুরি বরফাবৃত, আবার কোনওটার শৃঙ্গটুকো।

এখানের বো উপত্যকা দিয়ে বয়ে চলেছে ক্ষীণকায় বো নদী, নদীর ওপরের অনেক শিখর যুক্ত সা – ব্যাক রেঞ্জ।

বানফ শহর থেকে যাওয়া যায় জেসপার ন্যাশনাল পার্কের কলম্বিয়া আইসফিল্ডে। যাওয়ার জন্য রয়েছে বাস। ভাড়া নেওয়া হয় পঁচিশ ডলার করে। কলম্বিয়া আইসফিল্ড হল উত্তর মেরুর কাছাকাছি অঞ্চলের বৃহত্তম বরফ ঢাকা অঞ্চল। ৩২৫ বর্গকিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে এর বিস্তৃতি।

এই বরফাচ্ছাদিত অঞ্চলের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা হল উইলকক্স পাস। এখানে দাঁড়িয়ে আইসফিল্ডের ছ’টা বড় হিমবাহের তিনটেই পরিস্কার দেখা যায়। এখানে দাঁড়িয়ে যে কেউ জানতে পারে, যে জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আছে সেটাও কিন্তু বরফের ওপর। আদি –

অনন্তকাল ধরে জমাট বেঁধেছে এই বরফ। এর গভীরতা ৯৮৪ ফুট।

যারা এখানে প্রথম যান তারা তো অবাক হন এই ভেবে যে, বাহ বরফের ওপর তো দাঁড়িয়ে রয়েছি। কোনও কোনও ট্যুরিস্ট এখানে এসে পার্কের সরঞ্জামকে সঙ্গে নিয়ে যান আথাবাস্কা গ্লেসিয়ার বা আথাবাস্কার চূড়ার দিকে, তার খরচ অনেক।

এ পথের অর্ধবৃত্তাকার গিরিখাত ক্রমশ গভীর থেকে গভীরতর হয়ে আছে। শত শত বছরের জলধারার ধাক্কায় চুনাপাথরের দেয়ালের গায়ে তৈরি হয়েছে অনেক ধরনের প্রাকৃতিক ভাস্কর্য।

এখানে ক্যানিয়নের গভীরতা প্রায় ১২৫ ফুট আর এর উপর থেকে অবিরাম ঝরে পড়ছে একটি ছোটখাটো জলপ্রপাতের ধারা। জলের পতনের শক্তিতে নরম পাথর ক্ষয়ে গিয়ে শক্ত পাথরের গায়ে গিয়ে তৈরি হয়েছে আশ্চর্য আঁকিবুঁকি। এখানে আবহাওয়া অন্য রকম, যেন সর্বত্র কুয়াশাময় আচ্ছন্নে ঢাকা থাকে দিনের সারাক্ষণ।