যুক্তরাজ্যে ট্রেন ভ্রমণ: জেনে নিন টিকেটে ডিসকাউন্ট পাবার কিছু কৌশল (2022)


যুক্তরাজ্যে ট্রেনে ভ্রমণ অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এই অভিযোগ ইউরোপীয়ান পর্যটকসহ বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসা মানুষের। তবুও মুদ্রাস্ফীতির কারনে এখানে প্রতিবছরই বাড়ছে টিকেটের দাম। যেহেতু যুক্তরাজ্য একটি পর্যটন বান্ধব দেশ, এখানে প্রতিবছর বেড়াতে আসেন লক্ষ লক্ষ পর্যটক। ট্রেনের যাত্রীদের একটি বড় অংশও তাই ট্যুরিষ্টরা যার মধ্যে বাংলা ভাষীরাও আছেন। তদুপরি বিলেতে বসবাস করছেন প্রায় অর্ধমিলিয়ন ব্রিটিশ বাংলাদেশী।

এই লেখায় তাদের জন্য কিছু পরিক্ষীত কৌশল উল্লেখ করব যার মাধ্যমে একজন যাত্রী ট্রেনের একজন যাত্রী জানতে পারবেন সাশ্রয়ী টিকেট পাবার কিছু কৌশল

(১) আগে থেকেই ভ্রমণের পরিকল্পনা করুন:

জরুরী প্রয়োজন ছাড়া অন্যান্য ভ্রমণে আমরা কোথাও যাবার কয়েকদিন আগে থেকেই চিন্তাভাবনা করি। কিন্তু টিকেট করতে গড়িমসি করার কারনে শেষ মুহুর্তে এসে তড়িগড়ি করি। এরকম কিছু আপনার ক্ষেত্রে হয়ে থাকলে তা পরিত্যাগ করুন। কমপক্ষে চার সপ্তাহ আগে যদি আপনি ট্রেনের টিকেট বুকিং দিয়ে রাখেন তাহলে সেখানে অবশ্যই প্রায় অর্ধেক কিংবা এক তৃতীয়াংশ দামে কিনে নিতে পারবেন। টিকেটে আপনার বাঁচবে প্রায় অর্ধেক থেকে দুই তৃতীয়াংশ। তবে মনে রাখবেন অগ্রিম কেনা টিকেটে কোন কারনে যেতে না পারলে টাকা ফেরত পাবেন না। কারন এগুলো অফেরতযোগ্য। যদিও টিকেটের তারিখ পরিবর্তনের সুযোগ আছে। সেক্ষেত্রে নতুন টিকেটের সাথে মূল্যের তারতম্যের অংশঠুকু আপনাকে প্রদান করতে হবে।

(২) ট্রেন টিকেট স্প্লিটার কি? কীভাবে ট্রেন টিকেট স্প্লিটার ব্যবহার করবেন?

ট্রেনে ভ্রমণের ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থাটি যুক্তরাজ্যে অত্যন্ত কার্যকর। টিকেট স্প্লিট হচ্ছে আপনার প্রারম্ভিক ষ্টেশন থেকে গন্তব্য ষ্টেশন পর্যন্ত ভেঙ্গে ভেঙ্গে টিকেট করা।

কীভাবে ট্রেন টিকেট স্প্লিটার ব্যবহার করবেন?

 ধরা যাক আপনি লন্ডন থেকে যাচ্ছেন টনটন (সমারসেট)। ষ্ট্যান্ডার্ড টিকেটের  মূল্য ১০৫ পাউন্ড। সেই টিকেট যদি আপনি দুইভাগে ভেঙ্গে করেন লন্ডন টু পিউজি (মধ্যবর্তী ষ্টেশন), পিউজি টু সমারসেট তাহলে আপনার খরচ পড়বে ৪২ পাউন্ডের একটু বেশি। অর্থাৎ এখানে আপনার সাশ্রয় ৬২ পাউন্ডের বেশি। 

এই পদ্ধতিতে ভ্রমণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আপনি একই ট্রেনে যাত্রা করবেন। শুধুমাত্র সিট পরিবর্তন করতে হয়। তবে ক্ষেত্রবিশেষে ট্রেন পরিবর্তন করা লাগতে পারে। বিস্তারিত টিকেটে লেখা থাকবে।

ট্রেন
ট্রেন, যুক্তরাজ্যে, লন্ডন, স্কটল্যান্ড, ডিসকাউন্ট,

রেল কার্ড কি? কীভাবে রেল কার্ড নিবেন?

যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন ট্রেনে চলাচলে বিভিন্ন রকম ডিসকাউন্টের জন্য আলাদা রেল কার্ড আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বয়স্ক ও শারিরীক প্রতিবন্ধীদের জন্য, বয়স গ্রুপ ১৬-২৫ এবং ২৫-৩০, টু টুগেদার, নেটওয়ার্ক কার্ড, সিনিয়র কার্ড,ভেটেরান কার্ড, সামরিক বাহিনী কার্ড, ষ্টুডেন্ট রেল কার্ড, বিভিন্ন আঞ্চলিক রেল কার্ড এবং ফ্যামিলি ও ফ্রেন্ডস রেল কার্ড। এর মধ্য বহুল ব্যবহৃত কয়েকটি কার্ড সম্বন্ধে কিছু উল্লেখযোগ্য তথ্য হল:

(১) ফ্যামিলি এন্ড ফ্রেন্ডস রেল কার্ড ডিসকাউন্ট

এই কার্ডে দুইজন অধিকারী (যেমন: স্বামী-স্ত্রী) থাকতে পারবেন। বড়দের টিকেটে ৩০% এবং ছোটদের টিকেটে ৬০% ডিসকাউন্ট পাওয়া যায়। এই সুবিধা ষ্ট্যান্ডার্ড এবং এডভান্স টিকেটেও পাবেন। মোবাইল অ্যাপে ব্যবহার করতে পারবেন তাই কার্ড ব্যবহারের কিংবা হারানোর ভয় নেই। কার্ডের দুইজন স্বত্বাধিকারী থাকলেও একাকী ভ্রমণে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক যাত্রীর সাথে কমপক্ষে একজন শিশ্ত থাকা বাধ্যতামুলক। নাহলে পুরো টিকেটের টাকা পরিশোধ করতে হবে। ৫-১৫ বছর বয়সের বাচ্চারা এই কার্ডে ডিসকাউন্টের সুবিধা পাবে। এক যাত্রায় সর্বোচ্চ ৪ জন প্রাপ্ত বয়স্ক এবং ৪ জন শিশ্ত এই কার্ড ব্যবহার করতে পারবেন। ফ্যামিলি এন্ড ফ্রেন্ডস কার্ডের বার্ষিক চার্য্য ৩০ পাউন্ড।

(২)  টু টুগেদার রেল কার্ড ডিসকাউন্ট

নামেই বলে দিচ্ছে দুইজনের জন্য ডিসকাউন্ট মিলবে এই রেল কার্ডে। যেকোন দুইজন যাত্রী একত্রে যাত্রাকালে এই কার্ড ব্যবহার করতে পারবেন। মিলবে ৩০% ডিসকাউন্ট অগ্রিম এবং ষ্ট্যান্ডার্ড টিকেটে। এই কার্ডের বার্ষিক ফি ৩০ পাউন্ড।

আরও পড়ুন- লন্ডনের বিখ্যাত পর্তোবেলো রোড মার্কেট

(৩) নেটওয়ার্ক কার্ড ডিসকাউন্ট

একাকী ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে সাশ্রয়ী এই রেল কার্ড। অফ পিক কিংবা যেকোন সময় ভ্রমণে ষ্ট্যান্ডার্ড কিংবা এডভান্স টিকেটে পাবেন ৩০ ভাগ ডিসকাউন্ট। লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড টিকেটেও অফপিক টাইমে যাতায়াতে ডিসকাউন্ট পাওয়া যায়। তবে ওভারগ্রাউন্ড ট্রেনের টিকেট লন্ডনের বাইরে থেকে কিনলে এবং একই সাথে আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেনের জন্য বুকিং দিলে যেকোন সময় জোন ১-৯ যাতায়াতের ডিসকাউন্ট মিলবে। নেটওয়ার্ক কার্ড থাকলে যাত্রীর সাথে থাকা একই যাত্রায় সর্বোচ্চ ৪ জন প্রাপ্ত বয়স্ক ৩০ভাগ ছাঁড়ে এবং ৪ জন শিশু ৬০ ভাগ কমে টিকেট কিনতে পারবেন। বার্ষিক ফি ৩০ পাউন্ড। এই কার্ডের একমাত্র অসুবিধা হল এর পরিধি অত্যন্ত ছোট। লন্ডনের আশেপাশের কিছু জায়গায় এই কার্ড ব্যবহার করা যায়। তাই টিকেট কেনার আগে অবশ্যই দেখে নিন আপনার যাত্রায় নেটওয়ার্ক কার্ডে ডিসকাউন্ট পাবেন কিনা।

(৪) ষ্টুডেন্ট রেল কার্ড ডিসকাউন্ট

এই রেল কার্ডটি ষ্টুডেন্ট রেল কার্ড কিংবা ১৬-২৫ রেলকার্ড হিসাবে পরিচিত। তবে নিয়মিত শিক্ষার্থী হলে যেকোন বয়সের যে কেউ এই এই কার্ড পাবেন। সেক্ষেত্রে আবেদনপত্রের নির্দিষ্ট একটি সেকশন স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সত্যায়িত করে নিতে হবে। এই কার্ড লন্ডনের আন্ডারগ্রাউন্ডেও ব্যবহার করা যায়। বার্ষিক ফি ৩০ পাউন্ড।

(৫) গ্রুপ টিকেট কী? কতভাগ ডিসকাউন্ট পাওয়া যাবে?

যদি ৩জনের অধিক প্রাপ্ত বয়স্ক যাত্রী একত্রে ভ্রমণ করেন তাহলে গ্রুপ টিকেট কিনলে সর্বোচ্চ ৩৪ ভাগ ডিসকাউন্ট পাবেন। অনলাইনে টিকেট কিনলে আপনাকে গ্রুপ টিকেটের অপশন বাছাই করে নিতে হবে। গ্রুপ টিকেটের সুবিধা হল এর জন্য কোন রেল কার্ডের প্রয়োজন নেই। বেশিরভাগ ট্রেনেই আছে গ্রুপ টিকেটের ব্যবস্থা। 

ট্রেন মিস করলে কী করবেন?

যেকোন কারনেই আপনার ট্রেন মিস হতে পারে। যদি সেই কারণটি যুক্তিসঙ্গত হয় তাহলে সংশ্লিষ্ট ট্রেন ষ্টেশনের টিকেট কাউন্টারে জানান। তাদেরকে সুন্দর এবং অমায়িকভাবে বুঝিয়ে বলুন কী কারনে আপনি সময়মত এসে পৌঁছাতে পারেননি। আপনার কারনটি গ্রহণযোগ্য হলে আপনি পরবর্তী ট্রেনের জন্য আরেকটি ফ্রি টিকেট পাবেন। কয়েকটি গ্রহণযোগ্য কারণের মধ্য উল্লেখযোগ্য হল যদি কোন কারনে কানেক্টিং বাস বা ট্রেনে বিলম্ব হয়ে থাকে। লন্ডনের বাস বা আন্ডারগ্রাউন্ড সার্ভিসে যদি কোন রকম ব্যাঘাত ঘটে এবং সেকারনে বিলম্ব হয় তাহলে আপনি পরের ট্রেনের জন্য টিকেট পাবেন। যদি টিকেট না পান তাহলে আপনি টিকেটের টাকা ফেরত কিংবা ক্ষতিপূরণ চাইতে পারবেন।

আরও পড়ুন- লন্ডন বাস: ভ্রমণে যে ৫টি উপায়ে পাবেন ডিসকাউন্ট টিকেট

ট্রেন দেরী করলে কী করবেন?

যুক্তরাজ্যের ট্রেনের সময়সূচী কঠোরভাবে মেনে চলা হয়। যদি আপনার যাত্রায় গন্তব্যে পৌঁছাতে ৩০ মিনিটের বেশি বিলম্ব হয় তাহলে আপনি টিকেটের অর্ধেক মূল্য ফেরত পাবেন। আর যদি এক ঘন্টার অধিক দেরী হয় তাহলে আপনি টিকেটের পুরো টাকা ফেরত পাবেন। সাথে বিলম্বের সময় অনুযায়ী হিসাবে ভবিষ্যত যাত্রায় ব্যবহারের জন্য টিকেটের কুপন বা ভাউচার হিসাবে বিভিন্ন অংকের ক্ষতিপূরণ পাবেন।

ট্রেনে দেরীর ক্ষতিপূরণ কীভাবে পাবেন?

যদি আপনার ট্রেন দেরীতে গন্তব্যে পৌঁছায় তবে কিভাবে মূল্য ফেরতের জন্য আবেদন করবেন তা ট্রেনেই বলে দেয়া হবে। যদি আপনি সরাসরি সেই ট্রেনের ওয়েবসাইট থেকে টিকেট নিয়ে থাকেন তাহলে সংশ্লিষ্ট ট্রেনের ওয়েবসাইটে গিয়ে একটি সহজ ফরম পূরণ করতে হবে। সাথে টিকেটের ছবি আপলোড দিতে হবে।

যদি আপনি তৃতীয় পক্ষের ওয়েবসাইট থেকে (যেমন: দ্য ট্রেন লাইন) টিকেট কিনে থাকেন তাহলে সেই ওয়েবসাইটে গিয়ে আপনাকে একটি ফরম পূরণ করতে হবে। কনফার্মেশন পাওয়া সাপেক্ষে তারা আপনার ব্যাংক একাউন্টে টিকেটের মূল্য ফেরত প্রদান করবে।

শেষ কথা: যুক্তরাজ্যের সবকয়টি ট্রেনে আলাদা কাষ্টমার সার্ভিস আছে। ট্রেন সংক্রান্ত যেকোন বিষয় নিয়ে তাদের কাস্টমার সার্ভিসে ফোন দিতে পারেন। অথবা নিকটবর্তী ষ্টেশনের টিকেট কাউন্টারে আপনার প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারেন। যাত্রীর সুবিধা অসুবিধা খুবই গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়।