শান্ত, স্নিগ্ধ পুকুর পারে হরেক রকমের ফুল, ফল আর সবজি গাছের সমাহার। দক্ষিনা মৃদু সমীরনে পুকুরের পানিতে ঢেউ খেলে যায়। মাচায় দোলা দেয় লাউ, কুমড়া কিংবা শিম গাছের পাতা। গ্রাম বাংলায় খুবই পরিচিত দৃশ্য। শহরে এসব দৃশ্য অনেক কসরৎ করেও দেখা যায় না। কিন্তু বিদেশে? যেখানে বছরের ৯ মাসই থাকে ঠান্ডার চাদরে ঢাকা?
প্রখর সূর্যের আলো খুঁজে পাওয়া যেখানে অমাবস্যার চাঁদ! তবুও কেউ দমে যান না। দেশীয় সব্জি চাষের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। অনেকেই সফলতাও লাভ করেন।
পশ্চিমা দেশগুলোতে গ্রীষ্মের মিষ্টি গরমে উপমহাদেশের অভিবাসীরা বিভিন্ন রকমের সব্জি চাষ করেন। এর মধ্যে বাঙ্গালীরা লাউয়ের আবাদে সদা সচেষ্ট। যেখানে বাঙ্গালী, সেখানেই লাউ। সাধের লাউ!
শীত-গরমের তারতম্যে ঘরের আঙিনায় অবশ্য লাউ চাষ অবশ্য সব জায়গায় সম্ভব হয়না। যেখানে শীতের প্রকোপ বেশি সেখানে লাউ চাষ সাধ্যের বাইরে। তবে যুক্তরাজ্যের স্কটল্যান্ডে বসৎবাড়ীর সুইমিংপুলে দেশীয় শাঁক-সব্জির চাষ করে সেই অসাধ্য সাধন করেছেন একজন বাংলাদেশী ব্যবসায়ী। তিনি ব্রাম্মণবাড়িয়া জেলার মুহাম্মদ মহি উদ্দিন। সাগরপারকে জানালেন সেই গল্প।আসুন জেনে নিই স্কটল্যান্ডের ডান্ডিতে মহি উদ্দিনের সুইমিংপুলে সবজিবাগান এর গল্প।
স্কটল্যান্ডের একটি অন্যতম প্রসিদ্ধ স্থান ডান্ডি। বৃটিশ শাসনামলে ডান্ডির সাথে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক যোগাযোগ ছিল। সমুদ্র পথে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য পাট জাহাজ বোঝাই করে পাঠানো হত ডান্ডিতে। আবার বাংলাদেশের অন্যতম বন্দরনগরী নারায়নগন্জ পরিচিত ছিল বাংলাদেশের ডান্ডি হিসাবে।
২৩ বছর আগে স্কটল্যান্ডের ডান্ডিতে ওয়ার্ক পারমিট ভিসা নিয়ে বাংলাদেশ থেকে আসেন মহিউদ্দিন। একসময় চাকরী ছেড়ে শুরু করেন রেষ্টুরেন্ট ব্যবসা। পরিশ্রম আর আন্তরিকতা দিয়ে দ্রুত সফলতা লাভ করেন তিনি। একজন সফল ব্যবসায়ী হিসাবে তিনি ইতিমধ্যেই প্রতিষ্টা লাভ করেছেন ডান্ডিতে।
মহিউদ্দিন জানালেন, চলতি বছরের করোনা মহামারীর লকডাউনের সময়ে কিছু করার ছিল না। হাতে অফুরন্ত সময়।
স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে বাসার এক পাশে থাকা সুইমিংপুলের অব্যবহৃত জায়গায় কিছু ফল ও সবজির চারা লাগানোর চিন্তা আসে মাথায়। সেই ভাবনা থেকেই সুইমিংপুলের চারপাশে টবের মধ্যে চারা লাগানো শুরু করি।
কিছুদিন পরিচর্যার পর চারাগুলো দ্রুত বাড়তে থেকে। লাউ, শিম, কুমড়ার লতার জন্য সুইমিং পুলের উপরে নেটের মত জিনিস লাগিয়ে মাচার মত ব্যবস্থা করে দেন মহি উদ্দিন। এক সময় লতানো লাউ গাছে প্রচুর ফলন আসে। আশেপাশের প্রতিবেশীসহ ডান্ডি শহরে থাকা প্রায় ৪০টি পরিবারে উপহার হিসাবে লাউ নিয়ে হাজির হন মহিউদ্দিন। বেশ পরিতৃপ্তি নিয়েই জানালেন এ কথা।
যেহেতু সুইমিংপুলের পুরোটা জুড়েই লাউয়ের ফলন হয়েছে, সেগুলো সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখা দেয় আরেক বিপত্তি। গভীর পানিতে দাঁড়িয়ে মাচা থেকে লাউ সংগ্রহ করাটা দুরূহ। সেই কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে তারা কিনে আনেন রাবারের তৈরি নৌকা। সেই নৌকা বেয়ে মাচার নিচে পৌঁছে পেঁড়ে আনেন লাউ। এতে পুরো দেশীয় আমেজ আসে বলে জানান মহি উদ্দিন দম্পতি।
লাউ ছাড়াও সুইমিংপুলের মাচায় আরও আছে বিভিন্ন রকমের বিলেতি কুমড়া, আংগুর,টমেটো, শিম, কাচা মরিচ, বোম্বাই মরিচ, পুঁই শাক, বেগুনসহ বিভিন্ন রকমের দেশী-বিদেশী সবজি। অনেকটা গ্রীণ হাউজের আদলে তৈরি এই সুইমিংপুল বাগানের মনোরম দৃশ্য থেকে বিমোহিত হতে হয়।
সুইমিংপুলের বাইরে বাড়ির আঙিনায় ফলনশীল বৃক্ষের মধ্যে রয়েছে লেডি আপেল, চেরি আপেল, সবুজ আপেল, প্লাম, নাশপাতি এবং আলুবোখারার গাছ।
সবগুলোতেই প্রচুর ফলন হয়েছে। একপাশে জলপাই গাছে মুকুল এসেছে। মহিউদ্দিন জানালেন, ভাগ্যক্রমে জলপাই গাছও এখানকার আবহাওয়ায় উতরে গেছে। আশা করছি এবছরই ফলন হবে।
মহিউদ্দিন ও তার স্ত্রী দুইজনেই বৃক্ষপ্রেমী। বসৎবাড়ীর প্রতিটি কর্নারে রেখেছেন সতেজ গাছপালা। এর মধ্যে অন্যতম একটি গাছ হল পেয়ারা। বিশেষ কায়দায় তারা বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসেন একটি পেয়ারা গাছের চারা। সেটি ঘরের মধ্যে রেখে দিয়ে নিয়মিত পরিচর্যা করেছেন। বেগম মহিউদ্দিন জানালেন, ইতিমধ্যেই গত বছর দুটি কাজী পেয়ারার ফলন হয়েছে।
আরও পড়ুন: হেটেই নিন লাখ টাকা! সাথে আরও বোনাস!
এ বছরও ফলন আশা করছেন। একটি গাছ থেকে আরও কয়েকটি গাছের চারা তৈরির উদ্দেশ্যে কলম দিয়ে রেখেছেন। বিলেতে বসেও পেয়ারার চাষ করা যায় এটি প্রমান করেছেন ইতিমধ্যেই।
স্ত্রী ও তিন মেয়ে নিয়ে মহিউদ্দিনের সুখের সংসার। বড় মেয়ে ডাক্তারী পড়ছেন স্কটল্যান্ডের আরেক শহর আবারডিনে। বাকিরা পড়ালেখা করছেন ডান্ডিতেই। পরিবারের সবাই তাদের ঘরে থাকা গাছগুলোর নিয়মিত পরিচর্যা করেন। এই কাজ করে তারা আনন্দিত বলেই জানালেন।
ঘরের ছাদে, আঙিনায় কিংবা বারান্দায় সবজি চাষের গল্প অনেক আছে। কিন্তু বিদেশের বিরুদ্ধ আবহাওয়ায় সুইমিংপুলের পাশে টবে সব্জি চাষ মোটামুটি পরিশ্রমসাধ্য কাজ। এর সাথে নিয়মিতভাবে সময় দেয়া কিংবা খরচের ব্যাপারও আছে। কিন্তু সকল কাঁটা ধন্য করে মহিউদ্দিন দম্পতি সেটা সম্ভব করেছেন। সবচেয়ে বড় কথা প্রকৃত বৃক্ষপ্রেমী হতে চাইলে বিশ্বের যেকোন স্থানে থেকেই সেটা সম্ভব এই কথাটি সপরিবারে প্রমাণ করলেন মহিউদ্দিন দম্পতি।
Darun idea sir …