তিব্বত: দূর্গম প্রকৃতির রহস্যময় এক দেশ

তিব্বতী বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস ও বিবর্তনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই ধর্ম শুধুমাত্র তিব্বতি সংস্কৃতি নয়, মঙ্গোল ও মাঞ্চু জাতির গৌরবোজ্জ্বল সংস্কৃতি গড়ে তুলতে সহায়ক হয়ে ওঠে। ভারত ও চীনের মতো দু’টি সুপ্রাচীন সভ্যতার মধ্যবর্তী স্থানে তিব্বতি সভ্যতার বিস্তার ঘটে। লিখেছেন দুই বাংলার অন্যতম সেরা ভ্রমণ লেখক লিয়াকত হোসেন খোকন

Table of Contents

তিব্বত মালভূমির পূর্বে অবস্থিত পর্বতশ্রেণী তিব্বত ও চীনের মধ্যেকার সীমান্ত হিসেবে দীর্ঘকাল অবস্থান করছে। অপরদিকে হিমালয়ের সুউচ্চ পর্বতশ্রেণী ভারত ও নেপালের রাজ্যগুলি থেকে তিব্বতকে পৃথক করে রেখেছে।

এই দুই সভ্যতার মধ্যে মূলত ভারত থেকে শান্তরক্ষিত, কমলশীল, বিমল মিত্র, অতীশ দীপঙ্করের মতো বহু বিখ্যাত মহাজ্ঞানী ব্যক্তি, বৌদ্ধ পণ্ডিত এবং পদ্মসম্ভবের মতো বিখ্যাত তান্ত্রিক তিব্বতের দুর্গম পথে যাত্রা করে তিব্বতি শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় তন্ত্রসমৃদ্ধ তিব্বতি বৌদ্ধ ধর্মের সূচনা রও প্রসার করলে তিব্বতে একটি ধর্ম ও তন্ত্রকেন্দ্রিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠে।

তিব্বত একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য হিসেবে গড়ে ওঠে আনুমানিক ৬০০ খৃষ্টাব্দ থেকে। তখন তিব্বত শাসন করতে শুরু করেন গ্লাম রি স্রোং বতসন নামে একজন গোষ্ঠীপতি। তিনিই সকল গোষ্ঠীকে পরাজিত করে সমগ্র মধ্য তিব্বত নিজের অধিকারে নিয়ে আসেন। তাঁর নেতৃত্বেই তিব্বত মালভূমির বিভিন্ন গোষ্ঠী একত্রিত হয়। ৬২৯ খৃষ্টাব্দে বিদ্রোহীদের দ্বারা বিষক্রিয়ার মাধ্যমে গ্লাম রি স্রোংকে হত্যা করা হলে, তার পুত্র স্রোং বতসন স্গাম পো এই বিদ্রোহ দমন করে একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য হিসেবে দেশকে গড়ে তোলেন।

তিব্বত বর্তমানে গণচীনের একটি স্বশাসিত অঞ্চল। মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত এ অঞ্চলটি তিব্বতিয় জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল।

তিব্বতিয় মালভূমির গড় উচ্চতা ১৬ হাজার ফুট। এ কারণে এই অঞ্চলকে পৃথিবীর ছাদও বলা হয়।

প্রবাসী অনেক তিব্বতিয় এই অঞ্চলকে গণচীনের একটি অংশ হিসেবে মানতে সম্মত নন। ১৯৫৯ খৃষ্টাব্দে গণচীনের বিরুদ্ধে তিব্বতিদের স্বাধিকারের আন্দোলন ব্যর্থ হয়। তখন দলাই লামার নেতৃত্বে অসংখ্য তিব্বতি ভারত সরকারের আশ্রয় গ্রহণপূর্বক হিমাচল প্রদেশের ধর্মশালায় বসবাস আরম্ভ করেন। সেখানেই ভূতপূর্ব স্বাধীন তিব্বতের নির্বাসিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।

দালাইলামা

তিব্বত রহস্যময় এক দেশ। এ দেশের মানুষেরা প্রকৃতির মতোই শান্ত। শান্তিপ্রিয় তিব্বতিরা নিজেদের দেশ সম্পর্কে বাইরের দুনিয়াকে বেশি কিছু জানাতে পছন্দ করেন না। তিব্বতের রহস্যময়তার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ এর অত্যন্ত দুর্গম প্রকৃতি। হিমালয়ের উত্তরে বরফের চাদরে মোড়া তিব্বত শত শত বছর ধরে নিজেকে বহির্বিশ্ব থেকে আড়াল করে রেখেছে।

তিব্বতের রাজধানীর নাম লাসা। লাসা শব্দটির আক্ষরিক অর্থ দেবতাদের আবাস। প্রাচীন তিব্বতি দলিলপত্র অনুযায়ী এই স্থানের আদি নাম ছিল রাসা

আর রাসা শব্দের অর্থ হল দরবার বা ছাগলের আবাস।

সমুদ্র সমতল হতে লাসার উচ্চতা ৩,৬৫০ মিটার বা ১২,০০০ ফুট। যা বিশ্বের উচ্চতম শহরগুলির মধ্যে পড়ে। এখানে প্রায় তিন লক্ষের অধিক লোক বাস করে। তিব্বতের রাজধানী লাসাকে নিষিদ্ধ শহরও বলা হয়ে থাকে।

শহরের আয়তন ১৬৮ বর্গকিলোমিটার।

৮২২ খৃষ্টাব্দে চীন ও তিব্বতের মাঝে হয়ে যাওয়া চুক্তিতে প্রথমবারের মতো লাসা নামটি উল্লেখিত দেখা যায়। রাজা সংস্তান গ্যাম্পোকে বলা হয় তিব্বতি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা, তাঁর হাত ধরে এখানে বৌদ্ধ ধর্মের আবির্ভাব হয়।

তিব্বতের দর্শনীয় স্থান –

পোটালা প্রাসাদ। এই প্রাসাদটি মূলত দালাই লামার শীতকালীন আবাস। ১৬৪৫ খৃষ্টাব্দে পঞ্চম দালাই লামা নির্মাণ করান পোটালা প্রাসাদ। পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় একটি জায়গা হলো এই প্রাসাদ। এখানে রয়েছে ১৩ তলা বিশিষ্ট প্রাসাদ – এরমধ্যে প্রায় এক হাজারে কক্ষ, দশ হাজার মঠ এবং ২ লাখ মূর্তি রয়েছে। প্রাসাদটি মার্পো রি বা রেড হিলের চূড়ায় ৩৮৪ ফুট উঁচু এ প্রাসাদ উপত্যকা ভূমি থেকে প্রায় ১ হাজার ফুট উঁচু।

জোখাং মন্দির – রাজা সংস্তান গ্যাম্পো সপ্তম শতকে জোখাং মন্দিরটি নির্মাণ করিয়েছিলেন। এখানে রয়েছে শাক্যমুনি বুদ্ধের মূর্তি, যেটি কিনা রাজকুমারী ওয়েন চেং তেরোশ’ বছর আগে নিয়ে আসেন। তিব্বতের সবচেয়ে পূজনীয় বস্তু এটিই। চার তলা উঁচু সোনায় মোড়া ছাদওয়ালা মন্দিরটি দক্ষিণমুখী ও দেখতে চমৎকার। পুরনো লাসার মাঝখানে অবস্থিত বার্খোর স্কোয়ারে রয়েছে এ মন্দিরটি।

এছাড়া আরও উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান হল –

নরবুলিংখা প্রাসাদ, বার্খোর স্ট্রিট মার্কেট, তিব্বত জাদুঘর।

বার্খোর স্ট্রিট মার্কেটে তিব্বতি নানা হাতের কারুকাজ এখানে কিনতে পাওয়া যায়। সপ্তদশ শতকের মাঝে তিব্বতের বিদেশি পণ্য কেনাবেচার শ্রেষ্ঠ স্থান হয়ে দাঁড়ায় জমজমাট বার্খোর। একদা এ এলাকায় থাকতেন বণিক ও দেশান্তরীগণ।

নরবুলিংখা প্রাসাদটি হলো দালাই লামার গ্রীষ্মকালীন আবাস। ১৭৫৫ খৃষ্টাব্দে সপ্তম দালাই লামা এটি প্রতিষ্ঠা করিয়েছিলেন। এই প্রাসাদের কম্পাউন্ডে রয়েছে চিড়িয়াখানা, বোটানিক্যাল গার্ডেন, ম্যানশন। নরবুলিংখা পর্যটনের বড় একটি কেন্দ্র।

তিব্বতের অধিকাংশ মানুষ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তিব্বতি জনগোষ্ঠী মহাযান মতে তিব্বতি বৌদ্ধ ধর্ম চর্চা করে থাকে।

Share on:

লিয়াকত হােসেন খোকন ১৯৫৩ সালের ১৪ মার্চ পিরোজপুর শহরের রায় বাহাদুর রোডে (আদর্শপাড়া) ‘স্মৃতি ভবনে’ জন্মগ্রহণ করেন । পিতা মৃত আমির হােসেন মিয়া এবং মাতা মৃত্যু আমেনা খাতুন | লেখক ১৯৭৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভের পর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার ইতি টানেন । ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত, সহধর্মিণী শওকত আরা ডলি । ১৯৯৬ সালে তার লেখা বাংলাদেশ ভ্ৰমণ পুস্তিকাটি প্রকাশিত হয় হাক্কানি পাবলিশার্স থেকে । তার দ্বিতীয় গ্ৰন্থ ৬৪ জেলা ভ্ৰমণ অনিন্দ্য প্রকাশ থেকে বের হয় ২০০৭ সালে । ২০০৮ সালে প্রকাশ হয় তাঁর তৃতীয় গ্রন্থ ভারত নেপাল ভূটান ভ্ৰমণ । ১৯৭৩ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের প্রতিটি প্রদেশ তিনি ঘুরে দেখেছেন । বাংলাদেশের সংবাদপত্রে ভ্রমণ বিষয়ক লেখা জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে লিয়াকত হোসেন খোকনের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। এছাড়া দুই বাংলার চলচ্চিত্র বিষয়ে তিনি অন্যতম সেরা লেখক।