শকুন। Vulture নামে পরিচিত ইংরেজীতে। এখন তেমন একটা দেখা না গেলেও এক সময় বাংলাদেশের সর্বত্র এদের দেখা মিলত। বাংলার জনজীবনে শকুন মিশে আছে নানা ভাবে। শকুনের দোয়ায় গরু মরে না প্রবাদ বাক্য কিংবা শকুন শব্দটাই একটা অর্থ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রবীণরা মনে করেন, পাখিকুলের মধ্যে শকুন সবচেয়ে দীর্ঘজীবী। তার গড় আয়ু কমপক্ষে এক শ’ বছর। ১৫ বছর আগেও শকুন আকাশে উড়তে দেখা যেত কিন্তু এখন আর তা চোখে পড়ে না।
শকুন হারিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ পশু চিকিৎসা ক্ষেত্রে ডাইক্লোফেনের ব্যবহার।
শকুন বিলুপ্তির পেছনে রাসায়নিকই একমাত্র কারণ নয়। কীটনাশক ও সারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে পানির দূষণ, খাদ্য সংকট, কবিরাজি ওষুধ তৈরিতে শকুনের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ব্যবহার, ইউরিক অ্যাসিডের প্রভাবে বিভিন্ন রোগ ও বাসস্থানের অভাবকেও দায়ী করছে আইইউসিএন।
শকুন এক প্রকার পাখি। এটি মৃত প্রাণীর মাংস খেয়ে থাকে। সাধারণত এরা অসুস্থ ও মৃতপ্রায় প্রাণীর চারদিকে উড়তে থাকে এবং প্রাণীটির মরার জন্য অপেক্ষা করে। সবসময় বদদোয়া করে, কখন প্রাণীটি মরবে, কখন গোস্তো খাবে।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টির অধিকারী শিকারী পাখিবিশেষ এই শকুন।
পশুপাখি ও জীবজন্তু না থাকলে প্রকৃতির নানা বিপর্যয় ঘটবে। বন্যা, খরা, ঝড় ইত্যাদির কবলে পড়ে মানুষজনসহ সব প্রাণীকুল ও বৃক্ষলতা বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। তাই এদের ধ্বংস করতে নেই। এদের যত্ন ও সংরক্ষণে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে সচেতন হতে হবে।
কালিফোর্নিয়ায় টার্কি শকুন বাস করে নিম্ন বন অঞ্চল এবং স্টেপ অঞ্চলে। এই অঞ্চলে শকুন ছোট গুহায় বা পাহাড়ের ধারে বাসা বাঁধে।
ভারতীয় শকুন বিশ্বের অতি প্রাচীন শকুনের একটি প্রজাতি, যা প্রধানত ভারত, পাকিস্তান ও নেপালে দেখা যায়।
শকুনের বংশবৃদ্ধি ও সংরক্ষণের জন্য ভারতের তিনটি জায়গায় তৈরি হয় শকুন প্রজননকেন্দ্র। এ তিনটি কেন্দ্রের অবস্থান হচ্ছে – হরিয়ানা রাজ্যের পিঞ্জরে, পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ির কাছে রাজাভাতখাওয়ায় এবং আসামের রানিতে।
টার্কি শকুন গড়ে সোয়া দুই বাই দুই ফুট লম্বা হয়, যার ৬ ফুট ডানা রয়েছে। তাদের বড় আকার সত্ত্বেও, তাদের ওজন প্রায় ৩ পাউন্ড।
মহীরুহ বলে পরিচিত বট, পাকুড়, অশ্বত্থ, ডুমুর প্রভৃতি বিশালকার গাছে সাধারণত লোকচক্ষুর অন্তরালে শকুন বাসা। সাধারণত গুহায়, গাছের কোটরে বা পর্বতের চূড়ায় ১ থেকে ৩টি সাদা বা ফ্যাকাশে ডিম পাড়ে।
আরও পড়ুন: তুষারপাত: ডলার দিয়ে প্রকৃতি কেনা যায় না
উপকারী পাখির তালিকায় শকুনের স্থান আছে। পরিবেশবিদরা শকুনকে পরিচ্ছন্নতা কর্মী বলে মানেন। শকুন মৃত প্রাণীর মাংস খেয়ে হজম করে এবং এর মৃত প্রাণীর দেহ থেকে যে রোগজীবাণু ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকে, সেটা অনেকটাই কমে যায়। অর্থাৎ শকুন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে থাকে।
এশীয় রাজ শকুনের রয়েছে লাল রঙের মাথা। এটি এতটাই প্রাণবন্ত যে, এর উজ্জ্বল রঙগুলি প্রেমের প্রদর্শনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই পাখিগুলিকে একে অপরকে চিনতে সাহায্য করতে পারে।
সেই লম্বা গলা ও বড় সড় শরীরের ঝাড়ুদার পাখি আজ বিল। এখনকার প্রজন্ম দেখতে পাচ্ছে না পাখিকে। চিড়িয়াখানায় গিয়েই বোধহয় দেখতে হয় তাকে। কাজেই শকুন ও ভাগাড় বিলুপ্ত হলেও রয়ে গেছে সেই প্রবাদ।
একটা কথা প্রায়ই বলতে শোনা যায়, শকুনের চোখ ভাগাড়ের দিকে। পরিবেশ রক্ষায় এই পাখিটি আকাশের যত উঁচুতেই চক্কর কাটুক খাবারের সন্ধানে নজর থেকে যায় ভাগাড়ের দিকেই। অর্থাৎ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্থির রেখেই তার যাবতীয় কাজ। এখন বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে সেই শকুন ও ভাগাড় দুটোই বিলুপ্ত প্রায়।
সময়ের সঙ্গে বদলেছে অনেক কিছুই, জায়গা বহু মূল্যবান হয়ে উঠছে। তাইতো এখন আর বিস্তীর্ণ কবরস্থান -শ্মশান ভূমি নজরে আসে না। বহু কবরস্থানে একই জায়গায় তিন মাস পর পর পুনরায় মৃত মানুষের দেহ মাটি চাপা দেওয়া হচ্ছে। আবার বহু শ্মশানেই নির্দিষ্ট একটা চুল্লিতে শবদাহ চলছে। অন্য দিকে শহর -গ্রামের চিত্র বদলে যাচ্ছে দ্রুত। শহরের আয়তন বাড়ছে, তাই উজাড় হয়ে যাচ্ছে ফসলের ক্ষেত, বনজঙ্গল, বিল -জলাশয়। একসময় গ্রামে কৃষি কাজের পাশাপাশি পশুপালন ছিল আর্থিক উন্নতির অন্যতম ক্ষেত্র।
গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই পোষা হত গরু, ছাগল, ভেড়া, শূকর ইত্যাদি গৃহপালিত পশু। তাই কবরস্থান আর শ্মশানের পাশাপাশি থাকত মৃত পশুর সৎকারের জন্য নির্দিষ্ট কোন জায়গাও, অর্থাৎ ভাগাড়। মৃত পশুকে ফেলে রাখা হত সেখানে।
তারপর কিছু সময়ের অপেক্ষা, ততক্ষণে খবর পেয়ে গেছে শকুনের দল, আকাশে চক্কর কাটছে, কিন্তু নামতে পারছে না। আরও একজনের আসার কথা। ভাগাড়ে মৃত পশু অর্থাৎ গরু মরার খবর পেয়ে গেছেন সেই তিনিও। যিনি মৃত সেই পশুর চামড়াটা ছাড়িয়ে নেবেন। যতক্ষণ না এই পর্বটা শেষ হচ্ছে শকুনের দল নামতে পারছে না। চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যে আস্ত মৃত পশুটাকে খেয়ে সাবাড় করে দিত শকুন। পড়ে থাকতো কিছু হাড়গোড়, সেগুলো ও নিয়ে যেত কেউ একজন সেখান থেকে। ফলত পরিস্কার হয়ে যেত ভাগাড়।
ছেলেবেলায় গ্রামে আর মফস্বল শহরের আশেপাশে দেখা যেত সে সব দৃশ্য। তারপর উঁচু কোনও তালগাছে বিশ্রাম নিতে দেখা যেত শকুনের দলকে। আবার একসময় উড়ে যেত দূরে কোথাও।