১৯৭০ আর ১৯৮০ -এর দশকে হিন্দি ছায়াছবির নায়কদের কথা উঠতেই অমিতাভ বচ্চনের পাশাপাশি রাজেশ খান্না নামটি উল্লেখিত হবেই।
একসময় রাজেশ খান্নাকে বলা হত রূপবান তারকা। তাঁর মুখখানা ছিল অনেকটা মঙ্গোল ধাঁচের, শরীরটা ছিল নাতিদীর্ঘ টানটান – সেই সঙ্গে ছিল ওঁর উড়ন চুল। এরই সঙ্গে ছিল ভারী ঠোঁটের মিঠে হাসি। অনেকেই বলেন, এই সৌন্দর্যকে ব্যাকরণসন্মত সৌন্দর্য বলা চলে না কিন্তু মনমজানো রূপ বলা চলে।
রাজেশ খান্না যখন নায়ক ছিলেন তখন তাঁকে অনেকেই দিলীপ কুমার ধরনের সুপারস্টার বলতেন। কিন্তু দিলীপ কুমারের কাছে অনেক কিছু শেখার আছে রাজেশের। মানে জটিল পরিস্থিতি থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে আনার ব্যাপারটা আর কি।
কোনো কোনো ছবিতে দেখা গেছে ওঁকে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে। আর তা দেখে চলচ্চিত্র বিজ্ঞজন ওঁর রূপ নিয়ে বলেছেন, ‘এহেন মনমৌজি রাজেশের কিন্তু ট্রাম্প কার্ড হল ওঁর ম্যানারিজম। সেই ঘাড় একদিকে হেলিয়ে রেখে হাঁটা, চৌকো পুরুষালি চিবুকে ভাঁজ ফেলে হাসি, একদিকের কাঁধ থেকে অবহেলায় ঝুলিয়ে রাখা শাল, গাছের বা থামের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছুঁড়ে দেওয়া সরু চোখের কটাক্ষ। ভাবা যায়? এতেই মেয়ে মহল একেবারেই মত্ত। রাজেশের সৌন্দর্য রাফ অ্যান্ড টাফ নয়, পৌরুষ ব্যঞ্জক দামালপনা ছিল না তাতে। এতে ছিল প্রেমদিওয়ানা, আশিকানা আমেজ। হাবেভাবে ছিল সিরিয়াসনেস। বৈষ্ণব পদাবলীর ধাঁচে বলতে গেলে ওঁর সৌন্দর্যের মূল মাত্রা রভস। কামনার মন্দিরতায় রাজেশ খান্না মাপমতো ব্লেন্ড করতে পারতেন আন্তরিক আবেগ। তাই দামী পানীয়ের মতো রিমঝিম নেশা ধরা রাজেশের রূপ। কড়া জ্বলুনি নয়, সে নেশা রেখে যায় দীর্ঘ স্থায়ী আবেশ’।
ডিমপল কাপাডিয়া ওঁকে দেখে এতটা মুগ্ধ হল যে, অবশেষে ওঁরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় ১৯৭৩ সালে। টুংকিল ও রিংকি ওঁদের দুই মেয়ে। দুর্ভাগ্য, ১৯৮৪ সালে ডিমপল কাপাডিয়ার সঙ্গে রাজেশের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে।
অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি চলচ্চিত্র নির্মাতা ও রাজনীতিবিদও ছিলেন ।
রাজেশ খান্নার আসল নাম যতীন অরোরা। তাঁর জন্ম ১৯৪২ সালের ২৯ ডিসেম্বর পাঞ্জাবের অমৃতসরে।
শৈশবে তিনি বম্বের গিরগাঁও এলাকায় বসবাস করেছেন। পড়াশোনা করেন বম্বের সেন্ট সেবাস্তিয়ান গোয়া হাইস্কুলে। ম্যাট্রিক পাশ করার
পরে তিনি পুনের ওয়াদিয়া
কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও স্নাতক ডিগ্রী সম্পন্ন করেন। তবে এর আগেই স্কুলে পড়াকালীন সময়ে মঞ্চ নাটকে অভিনয় শুরু করেন তিনি।
১৯৬৬ সালে ‘আখরী খাত’ ছবিতে তিনি প্রথম অভিনয় করেন। ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তিনি প্রতিটি ছবিতে অন্যান্য অভিনেতাদের চাইতে
অভিনয় করে সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পেতেন।
আরও পড়ুন: দিলীপ কুমারের দাদাবাড়িতে
রাজেশ খান্না ১৯৯২ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত নয়াদিল্লি আসনের লোকসভার সংসদ সদস্য ছিলেন।
তিনি পরলোক গমন করেন ২০১২ সালের ১৮ জুলাই মুম্বাইতে।
রাজেশ খান্না অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবি হল –
১৯৬৬ সালে – আখরী খাত ; ১৯৬৭ সালে – রাজ, বাহারো কি স্বপ্নে, আউরাত ; ১৯৬৯ সালে – ডলি, আরাধনা, দো রাস্তে, বন্ধন, খামোশি, দি ট্রেন, ইত্তেফাক ; ১৯৭০ সালে – সাচ্চা ঝুটা, সফর, কাটি পতঙ্গ, আন মিলো সাজানা, আনন্দ ; ১৯৭১ সালে – আন্দাজ, মর্দা, ছোটি বহু, হাতি মেরে সাথী, মেহবুব কি মেহেন্দি, বদনাম ফারিস্তে, অমর প্রেম ; ১৯৭২ সালে – দুশমন, আপনা দেশ, দিল দৌলত দুনিয়া, জরু কা গুলাম, মেরে জীবন সাথী, শেহজাদা, মালিক, অনুরাগ ; ১৯৭৩ সালে – রাজা রাণী, নিমক হারাম, আবিষ্কার, দাগ ; ১৯৭৪ সালে – আপ কি কসম, প্রেম নগর, রুটি, আজনবি, আজিনা ; ১৯৭৫ সালে – প্রেম কাহানী, আক্রমণ ; ১৯৭৬ সালে – মহা চোর, বুন্দালবাজ, ঠগ, মেহেবুবা ; ১৯৭৭ সালে – আশিক হু বাহারো কা, অনুরোধ, টিংকু, কর্ম ; ১৯৭৮ সালে – ভোলা ভালা, প্রেম বন্ধন ; ১৯৭৯ সালে – অমরদীপ ; ১৯৮০ সালে – বন্দিশ, ফির ওহি রাত, অঞ্চল, রেড রোজ ; ১৯৮১ সালে – কুদরত, ফিফটি ফিফটি, অশান্তি, দর্দ ; ১৯৮২ সালে – দিল -এ নাদান, রাজপুত, সুরাগ, জানোয়ার, ধরম কান্তা, ডিসকো ড্যান্সার – ইত্যাদি।
রাজেশ খান্না সর্বমোট ১৬৩টির মতো ছায়াছবিতে অভিনয় করেছেন। তিনি বেশ কয়েকবার ফিল্মফেয়ার পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পেয়ে ছিলেন।
রাজেশ খান্না অভিনীত স্মরণীয় ছবি – আরাধনা
মুক্তির তারিখ ঃ ৭ ই নভেম্বর, ১৯৬৯।
আরাধনা ছবির প্রযোজনা ও পরিচালনায় ঃ শ্রী শক্তি সামন্ত। সুরসৃষ্টি ঃ শচীন দেব বর্মণ।
সহকারী সুরকার ঃ রাহুল দেব বর্মণ। গীত রচনা ঃ আনন্দ বক্সী।
অভিনয় করেন –
রাজেশ খান্না, শর্মিলা ঠাকুর,
সুজিত কুমার, ফরিদা জালাল, মনোমোহন, সুভাষ গাই,
মদনপুরী, অনিতা দত্ত, অশোক কুমার, দুলারী,
অভি ভট্টাচার্য্য এবং আরও অনেকে।
আরাধনা ছবির উল্লেখযোগ্য গান ঃ
১. রুপ তেরা মাস্তানা — কণ্ঠশিল্পী ঃ কিশোর কুমার।
২. বাঘো ম্যায় বাহার হ্যায় — কণ্ঠশিল্পী ঃ লতা মঙ্গেশকর ও মোহাম্মদ রফি।
৩. চান্দা হ্যায় তু মেরা সুরুজ — কণ্ঠশিল্পী ঃ লতা মঙ্গেশকর।
৪. মেরা স্বপ্নো কি রাণী — কণ্ঠশিল্পী ঃ কিশোর কুমার।
৫. গুন গুনা রাহে হ্যায় ভ্রমর — কণ্ঠশিল্পী ঃ আশা ভোঁসলে ও মোহাম্মদ রফি।
৬. কোরা কাগজ থা ইয়ে মন মেরা — কণ্ঠশিল্পী ঃ লতা মঙ্গেশকর ও কিশোর কুমার।
৭. সফল হোগি তেরা আরাধনা — কণ্ঠশিল্পী ঃ শচীন দেব বর্মণ।
কাহিনী –
ভারতীয় বিমান বাহিনীর বৈমানিক অরুণ বর্মা একটি জীপে একজন নারীকে উদ্দেশ্য করে গান গাইছেন।
জীপে অরুণের সঙ্গে তার সহকর্মী বৈমানিক মদন বর্মাও রয়েছেন।
অরুণ বর্মা যাকে উদ্দেশ্য করে গানটি করছিলেন সেই মেয়েটির বাবা একজন চিকিৎসক।
মেয়েটির নাম বন্দনা — বন্দনার সঙ্গে প্রেম করতে গিয়ে অরুণ বন্দনার সঙ্গে দৈহিক মিলন করেন।
এরপর অরুণ দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে মৃত্যু বরণ করেন।
দৈহিক মিলনের কারণে বন্দনা গর্ভবতী হয়ে পড়েন।
অরুণের সঙ্গে তার দৈহিক মিলনের কারণে যে বন্দনা আজ গর্ভবতী — সে কথা অরুণের পরিবারকে জানানো হয়। কিন্তু অরুণের পরিবার বন্দনাকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান।
হঠাৎ বন্দনার বাবা মারা যান — আর বন্দনার একটি পুত্র সন্তান জন্মলাভ করে।
এবং সন্তানহীন এক দম্পতি ঐ ছেলেটির দত্তক নেয়।
ঐ ছেলেটার জীবনের অংশ হওয়ার জন্য বন্দনা উক্ত পরিবারে কর্মচারী হিসেবে কাজ নেন।
উক্ত পরিবারের কর্ত্রীর ভাই শ্যাম এমনিতেই যৌবন যন্ত্রণায় ভুগছিলেন — বন্দনাকে দেখে তার দেহ ভোগ করার জন্য চেষ্টা করতে থাকে। জোর করে বন্দনার দেহ ভোগ করার সময় সূর্য শ্যামকে খুন করে ফেলে, পুলিশ এলে বন্দনা জানান , তিনিই শ্যামকে খুন করেছেন।
বন্দনার জেল হয়ে যায়।
অনেক বছর পরে বন্দনা জেল থেকে ছাড়া পেলেন।
জেলার বন্দনাকে পছন্দ করে তাকে তার বাসায় নিয়ে যান এবং তার মেয়ে রেণুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।
জেলারের বাড়িতে বসবাস করতে থাকেন বন্দনা।
বন্দনা একদিন দেখতে পান, রেণুর প্রেমিককে — তার প্রেমিকের নাম সূর্য। সূর্যকে দেখতে অবিকল সেই বৈমানিক অরুণ বর্মার মতই। সূর্য বন্দনাকে দেখে একদিন জিজ্ঞেস করে, আপনাকে যেন কোথায় দেখেছি – দেখেছি বলে মনে পড়ে।
কিন্তু সূর্যকে চিনতে পেরেও বন্দনা তার পরিচয় দিলেন না।
সূর্য পরে একসময় রেণুর বাসায় বৈমানিক অরুণ বর্মা ও বন্দনার একত্রে একটি ছবি দেখে বুঝতে পারে, বন্দনাই তাঁর মাতা।
ছবিতে অরুণ বর্মা ও সূর্য বর্মার অর্থাৎ দ্বৈত ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন — রাজেশ খান্না।
বন্দনার ভূমিকায় ছিলেন — শর্মিলা ঠাকুর।