যুগে যুগে ভৃত্য ও ক্রীতদাস প্রথা


মানবসভ্যতার ইতিহাস অনুযায়ী, খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ থেকে ৩০০০ সালে মেসোপোটেমিয়ায় প্রথম ক্রীতদাস প্রথা চালু হয়। এর পরবর্তীতে এক হাজার বছর পর থেকে ক্রীতদাস প্রথা মিসর হয়ে ছড়িয়ে পড়ে ভারতীয় উপমহাদেশে।

ভৃত্য কি?

ভৃত্য হলো দাস, ভৃত্য, চাকর, বান্দা, সেবক, কর্মচারী। ভৃত্যের অর্থ আরও হলো – দাস, নফর, গার্হস্থ চাকর, বালক ভৃত্য, দক্ষিণহস্তস্বরূপ সহায়ক ব্যক্তি, দৃঢ় সমর্থক।

চাকর বা ভৃত্য বলতে বুঝায়, যে অন্যের গৃহে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে। সাধারণত চাকর আবাসিক সহায়ক হিসেবে নিযুক্ত হয়। কেউ মুদ্রার বিনিময়ে, কেউ শুধু খাবারের বিনিময়ে কাজ করে থাকে।

একজন চাকর দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক বা বাৎসরিক ভিত্তি অনুযায়ী কাজ করতে পারে।

ভৃত্যের অর্থ আরও হলো – দাস, ক্রীতদাস, অনুগত, অধীন।

ভৃত্য বলতে গোলামও বোঝায় – গোলাম হলো, চাকর, বান্দা, চিরদাস, তাসের গোলাম।

ভৃত্যের স্ত্রী লিঙ্গ হলো – ভৃত্যা।

দাসপ্রথা একটি অনুমোদিত সামাজিক ও আইনানুগ ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় বাজারে মানুষের আনুষ্ঠানিক বেচা -কেনা চলত। ক্রীত ব্যক্তি ক্রেতার ব্যক্তিগত সম্পত্তি রূপে কাজ করতে বাধ্য থাকত।

প্রাচীন ও মধ্যযুগের প্রায় সব শাসন ব্যবস্থাতেই দাস প্রথার প্রচলন ছিল। গবাদিপশুর মত মানুষেরও কেনা -বেচা চলত।

ক্রীতদাস হলো – বান্দা, কিঙ্কর, গোলাম, হতভাগ্য লোক।

মিসরের গ্রেট পিরামিডের মতো সুবিশাল স্থাপত্যও তৈরি করা হয় দাসদের কাজে লাগিয়েই। এর অনেক পরে চীন দেশে এই দাস প্রথাটি খুব করে জেঁকে বসে।

গ্রীসের পলিসপুলিতে ক্রীতদাসেরা ছিল তাদের প্রভুর সম্পত্তি। প্রভু তাঁর অধীনস্থ ক্রীতদাসকে বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করত।

কৃষিক্ষেত্রে, খনি, মাটিকাটা, নির্মাণকার্য ও ক্ষুদ্র ব্যবসায় প্রচুর ক্রীতদাস নিযুক্ত করা হত। তবে কাজ করে ক্রীতদাস যে মজুরি পেত, তা তার প্রভুর হাতেই যেত।

পুরনো কলকাতার ভৃত্য –

কলকাতার মেমসাহেবরা নাচ -গান পরিচর্যা নিয়ে থাকলেও সবসময় খুব সুখে ছিলেন না। গরম, মশা মাছির কামড়, নানা রকম রোগ, নতুন দেশ, অজানা ভাষা। স্বামীরা তো সাম্রাজ্য বিস্তারে ব্যস্ত এদিকে গৃহে আকবর আলী বাবুর্চিখানায় কি রাঁধছে, বা খেন্তি ঝি আসবাব পরিস্কার করলে কি না সে দেখার দায় তো গৃহিণীর।

সেকালের ভারতবর্ষে মেমসাহেবদের জীবনে ‘বেনে’ একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। এই ব্যক্তিটি সাহেবদের সংসারের একচ্ছত্র অধিপতি ; ঝি চাকর মালি সে যোগাড় করবে, সংসারে কেনাকাটা সব তারই হাত দিয়ে হবে, দুঃসময়ে সাহেবকে চড়া সুদে টাকা ধার দেবে। এই ‘বেনে’ কি শ্রেণির জীব ছিলেন সাহেবদের চোখে? এদের সম্পর্কে প্রথম মন্তব্য করে ১৭৬৭ সালের এক জার্নালে শ্রীমতী কিনডরসলী লিখেছেন, এদের মত অপদার্থ আয়েসী ধূর্ত লোক আর নেই। প্রত্যেক কাজেই এদের বাঁদরামি ফুটে বেরোয়। চাকরদের মাইনে, মাসকাবারি বাজার সব কিছুতে তার দস্তুরি চাই। লাভটা ঠিক থাকলে গালমন্দ যা কিছু করো তার শান্তি অবিচল।

স্যর ফ্রান্সিস একটু সৌখিন প্রকৃতির লোক ছিলেন, একলাই থাকতেন বৃহৎ এক প্রাসাদোপম অট্টালিকায়। তাঁর ভৃত্য সংখ্যা ছিল একশোর কাছাকাছি। আর একজন ধনী ইংরেজ ব্যবসায়ী শ্রীযুক্ত ম্যাকরাবি তার বেনেকে মাঝে মাঝে ধমকাতেন এই বলে যে স্বামী -স্ত্রী এই দুজনের জন্য ১১৬ জন গৃহভৃত্যের কি দরকার। হিকে

সাহেবকে সেই নবাবির যুগের কলকাতায় কেউ ধনী বলে মনে করত না। তবু তাঁর ভৃত্য সংখ্যা ছিল ৬৩ জন। তখনকার সাহেবরা আবার হুঁকোর বিশেষ ভক্ত ছিলেন, মহিলারাও হুঁকাসেবী ছিলেন। সাহেবরা তো এক একটি লক্কা পায়রা, তাঁদের সাজসজ্জা এবং প্রসাধনপর্ব মহিলাদের মতই মনোহারী এবং সময় সাপেক্ষ। তাঁদের প্রত্যেকের নিজস্ব হুঁকাবরদার, নাপিত, পরচুলাবাহক এসব থাকত। স্যর ফ্রান্সিসের প্রাইভেট সেক্রেটারির ভৃত্য সংখ্যা ছিল মাত্র পনেরো জন ফলে মাঝে মাঝে তাঁর নিজের জুতোই নিজেকে পরিস্কার করে বার্নিশ করতে হত।

ভৃত্য

একজন পাদ্রীকে জ্যাকেট পরিয়ে দিচ্ছেন দুইজন ভৃত্য। ছবি: www.alamy.com

এই বৃহৎ ভৃত্যবাহিনী পুষতে তাঁদের খরচ হত প্রচুর। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এক সাহেব দুঃখ করে বলছেন, ২৫ বছরের মধ্যে কি খরচই বেড়ে গেল।

ক্রমশ অবশ্য নবাবদের সংখ্যা কমে, ভৃত্যের সংখ্যাও কমে। তবে ১৮৪৬ সালে কলকাতায় এক ধনী বান্ধবীর বাড়িতে বম্বের এক মেমসাহেব জানালেন ৬০ জন ভৃত্য আছে, আর জন পাঁচেক বিলেত থেকে আনা মেম পরিচারিকা – খাবার টেবিলেই আটজন ভৃত্য তাঁদের তদারক করল। ১৮৭৮ সালে মফস্বলের এক জজ বা ম্যাজিষ্ট্রেটের স্ত্রী শ্রীমতী রবার্ট মস কিং বলেছেন তাঁকে ৩২ জন লোক রাখতে হয়েছে।

কলকাতার ফ্যাশনেবল মেমসাহেবদের গর্ব ছিল যে তাঁদের ভৃত্য সংখ্যা সব চেয়ে বেশি। তবে ভৃত্যতন্ত্রে জাতিভেদ প্রথা ছিল – যার যা কাজ। চা আনবে একজন মুসলমান বেয়ারা, বই, কাগজপত্র নিয়ে যাবে হিন্দু চাপরাশি, বাতিদান -তেল -মোমবাতি হিন্দু সর্দার বেয়ারার হেপাজতে, মুসলমান আবদারের কাজ মদ বরফ দিয়ে ঠান্ডা রাখা। আর এই বৃহৎ ভৃত্যরাজ্যের মাথায় রয়েছে মুসলমান খানসামা। ভৃত্যমহলে সে আল্লাহর মত ক্ষমতাবান। এই ভৃত্যেরা কিন্তু দরকার মত মেমসাহেবকে ভয়ানক জ্বালাতো। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় এক মেমসাহেব মনের দুঃখে বলেছেন, খানসামাকে জিজ্ঞেস করেছিলুম মাছের দাম তিনগুণ কেন? তার ফলে পরের দিন প্রাতরাশের টেবিলে প্রধানত কাঁটাচামচই এল, খাদ্যদ্রব্য খুবই কম। খানসামারা মিলে ঠিক করতো কোন জিনিসের কি দাম, তার কমে কেউ বাজার করবে না।

ভৃত্য
একজন মেম সাহেবকে সেবা করছেন দুইজন ভৃত্যা। ছবি: www.alamy.com

শ্রীমতী কেট গুথরি বলেছেন, ভারতবর্ষে প্রাইভেসি বলে কিছু নেই – চাকর, চাকরানির দল সারা বাড়িতে  ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সাহেব অফিসে গেলেই রাস্তায় বা বাগানে দাঁড়িয়ে সাহেববাড়ির কেচ্ছা কাহিনি উচ্চস্বরে আলোচনা করে।

মেমসাহেব শ্রীমতী ম্যাকেনজী কলকাতার এক যুবতী মেমের লজ্জাহীনতার কথা লিখে গেছেন, শোবার ঘরে আধ ডজন পুরুষ ভৃত্য ভিড় করে রয়েছে আর তিনি অতি স্বল্পবাসে সজ্জিত হয়ে তাদের হুকুম দিচ্ছেন। কলকাতার আর এক সুন্দরী মেমের অভ্যাস ছিল তিনি দরজির সামনেই পোশাক ছাড়তেন  এবং পোশাক পরতেন।

সাহেবরা অনেক সময় ভৃত্যদের সঙ্গে যথেষ্ট খারাপ ব্যবহার করতেন – মারধর, বন্দী করে রাখা, মাইনে না দেওয়া কিছুই বাদ যেতো না। ১৮২১ সালের ১৩ জুন কলকাতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতীয় ভৃত্যদের ওপর সাহেবদের অত্যাচার বন্ধ করার জন্য এক ফতোয়া জারি করেন। ভৃত্য ছাড়াও ক্রীতদাস বা ক্রীতদাসী রাখা সাহেব সমাজে খুবই চালু ছিল।

১৭৭৮ সালে কলকাতার পুলিশ সুপার প্লেডেল সাহেবের চার্জশিট পড়লে জানা যায় কি অপ্রতিহত প্রভাব ছিল সাহেবদের। জন বিংগুয়েল তাঁর বাবুর্চি রামজানির বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন, সে না বলে চাকরি ছেড়ে পালিয়েছে। অপরাধ প্রমাণিত। দশ ঘা বেত্রাঘাত। এর আগের কোন অপরাধের জন্য সাহেব রামজানির একটা কান কেটে দিয়েছিলেন। মিঃ এন্ডারসনের ক্রীতদাসী পিগি আবার পালিয়ে যাওয়ার অপরাধে ৫ ঘা বেত্রাঘাতের পর তার প্রভুর কাছে ফিরে যেতে হবে। মিঃ ক্যান্টওয়েলের মেথরানী খালি বোতল চুরি করার অপরাধের জন্য ১০ ঘা বেত্রাঘাতের পর সারা শহর ঠেলাগাড়ি করে ঘুরিয়ে আনা হবে।

সেকালের বিভিন্ন সংবাদপত্রে এই ধরনের বিজ্ঞাপন দেখা যেতো –

বিক্রি হবে – একটি সুন্দর কাফরী ছেলে, রান্নাবান্না জানে। বাটলার বা খিদমতগার হিসেবে কাজে লাগবে। দাম চারশো সিক্কা রুপিয়া। ৯ ডিসেম্বর, ১৭৮০।

বিক্রি হবে – ১৮ বছরের দু’জন কাফ্রি ছেলে। ভাল বাঁশি বাজাতে পারে। কলকাতার পর্তুগীজ চার্চে লিখুন। ১৭ মার্চ, ১৭৮১।