মেহরান করিমি নাসেরী: একটানা ১৮ বছর যিনি কাটিয়ে ছিলেন এয়ারপোর্টের টার্মিনালে


অবশেষে অনন্তের পথে যাত্রা করলেন মেহরান করিমি নাসেরী। তিনি স্যার আলফ্রেড নামেও খ্যাত। ফ্রান্সের শার্ল দ্য গল এয়ারপোর্টের এক নাম্বার টার্মিনালে যিনি একটানা কাটিয়েছেন ১৮ বছর। তার জীবনীভিত্তিক সুপারহিট ‘দ্য টার্মিনাল‘ ছবিটি শুন্য দশকে ২১৯ মিলিয়ন ডলার ব্যবসা করেছিল।

মেহরান করিমি নাসেরী ইরানী বংশদ্ভুত হলেও তিনি সে পরিচয়ে পরিচিত হতে চাননি। এক সময় পড়ালেখা করেছিলেন যুক্তরাজ্যে। তিনি দাবী করেছিলেন তার বাবা ছিলেন একজন ডাক্তার, যিনি চাকরিসূত্রে বসবাস করতেন স্কটল্যান্ডে এবং সেখানেই একজন নার্সকে বিয়ে করেছিলেন। সেই নার্সই হচ্ছেন তার মা যিনি তার পড়ালেখার খরচ যুগিয়েছিলেন। মা মারা যাওয়াতে তিনি পড়ালেখা আর চালিয়ে নিতে পারেননি। এসব বক্তব্যের সমর্থনে অবশ্য তিনি কোন কাগজপত্র দেখাতে পারেননি। কারন হিসাবে তিনি বলেছিলেন তার ট্রাভেল ব্যাগটি বেলজিয়ামে চুরি হয়ে গিয়েছিল।

একসময় যুক্তরাজ্য ছেড়ে তিনি ইউরোপে চলে যান এবং ১৯৮৮ সালে ব্রাসেলস থেকে প্যারিস এয়ারপোর্ট হয়ে লন্ডনে প্রবেশ করার চেষ্টা করেন। এখানে ইমিগ্রেশনে তিনি ভ্রমণের বৈধ কোন পাস দেখাতে পারেননি বিধায় আইন অনুসারে আবার তাকে প্যারিসে পাঠিয়ে দেয়া হয়। যেহেতু ফ্রান্সে ভ্রমণেরও কোন অনুমতি তার ছিলনা তাই কার্যত সেখানে তিনি কিছুদিন নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বন্দী ছিলেন। এক সময় এক নাম্বার টার্মিনাল হয়ে যায় তার স্থায়ী ঠিকানা।

এয়ারপোর্টের ষ্টাফরা তার প্রতি ছিলেন খুবই আন্তরিক। এয়ারপোর্টের ভিতরে অবস্থিত ম্যাকডোনাল্ডসহ বিভিন্ন রেষ্টুরেন্ট তাকে বিনামূল্যে খাবার প্রদান করত। এছাড়া যাত্রিরাও তাকে অনেক সময় নগদ টাকাসহ অন্যান্য উফার প্রদান করতেন। এয়ারপোর্টের ভিতরে অবস্থিত একটি পোষ্ট অফিসে তিনি একটি সেভিংস একাউন্ট খুলে তার টাকা সেখানেই জমা রাখতেন।

১৯৯৯ সালে ফ্রান্সে বসবাসের জন্য তাকে অনুমতি দেয়া হলেও তিনি এক নাম্বার টার্মিনালেই থেকে যান।

তার জীবনীভিত্তিক দ্য টার্মিনাল ছবিটির স্বত্ব বাবদ তিনি আনুমানিক দুই থেকে পাঁচ কোটি টাকা পেয়েছিলেন। এছাড়া তার আত্মজীবনীর উপর লেখা বই বিক্রি করেও তিনি কিছুটা আয় করেন। এয়ারপোর্ট টার্মিনালে তিনি পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও বই পড়ে সময় কাটিয়ে দেন। একসময় অবশ্য তিনি মিডিয়ার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। তার সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য মিডিয়া কর্মীরা ভিড় করতেন।

আরও পড়ুন: লন্ডনে কম খরচে থাকা খাওয়ার জায়গা পাবেন যেখানে

অসুস্থতার জন্য ২০০৬ সালে এয়ারপোর্ট থেকে মেহরান করিমি নাসেরী কে হসপিটালে নেয়া হয়। এরপর থেকে তিনি একটি হোস্টেলেই বসবাস করছিলেন। তবে কিছুদিন আগে তিনি আবার টার্মিনালে ফিরে আসেন এবং ৭৭ বছর বয়সে এখানেই শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। যদিও তাকে প্রাইভেট নার্সিং হোমে নেয়ার জন্য অনেকেই চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তিনি সম্মত হননি।

তার পরিবারের সদস্যরা তার সাথে দেখা করতে এলেও তিনি তাদেরকে চিনেন না বলে জানান এবং কথা বলতে অস্বীকৃতি প্রদান করেন। বিভিন্ন সময় সাংবাদিকরা তাকে পারসিয়ান (ইরান) ভাষায় কথা বলার অনুরোধ জানালেও তিনি সে ভাষা জানেননা বলে জানান। তিনি নিজেকে পুরোপুরি ইউরোপীয়ান হিসাবেই পরিচয় দিতে আগ্রহী ছিলেন।

গত তিন দশকে একজন হোমলেস মেহরান করিমি নাসেরীর জন্য ফ্রান্সের শার্ল দ্য গল এয়ারপোর্ট আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে যে প্রচারনা পেয়েছে তা আর কোন এয়ারপোর্ট পেয়েছে বলে মনে হয় না। মাঝে মাঝে ক্ষুদ্র ব্যক্তি সাধারণও যে কোন প্রতিষ্ঠানকে মহিমান্বিত করতে পারেন এটা করিমীর  উদাহরণ থেকেই ষ্পষ্ঠ।