লাদাখের তুষারমরু নুব্রা উপত্যকায় যেতে লে শহর থেকে প্রায় ১২৫ কিলোমিটার দুর্গম যাত্রাপথ অতিক্রম করতে হয়। এই পথে একের পর এক পাহাড় ডিঙিয়ে যেতে হয় লাদাখের উত্তরাংশের শেষ সীমানায়
কারাকোরাম পর্বতমালার দোরগোড়ায়। নুব্রা উপত্যকার এই রোমাঞ্চকর সফরের জন্য দুটি দিন বরাদ্দ করতে পারেন। সকাল হতেই লে থেকে গাড়ি নিয়ে রওনা করুন। দুদিনের এই ট্যুরে নুব্রার দুটি অংশ
হুন্ডার ও সুমোর সহ সব দ্রষ্টব্যই দেখে নিবেন। এই ট্যুরে গাড়িভাড়া লাগবে ৭,০০০ টাকা। এদিকটাও সেনাবাহিনীর দখলে। তাই নির্দিষ্ট ট্যুরিস্ট জোনেই ঘোরা যাবে। লে-র ডি সি অফিস থেকে প্রয়োজনীয় পারমিট করিয়ে নিতে হয়। নুব্রা উপত্যকা বেড়ানোর জন্য এবার লেহ শহরে বেড়াতে গিয়ে সড়কপথে চললাম নুব্রা উপত্যকার দিকে।
শহর ছাড়িয়ে গাড়ি ধরল নতুন রাস্তা। বেশ খানিকটা এগোনোর পরে পিছন ফিরে দেখি শহর ছাড়িয়ে আমরা অনেকটা দূরের চলে এসেছি। এবার আমাদের পাহাড় চড়া শুরু হলো। ড্রাইভার বলল, সামনের যে আকাশ ছোঁয়া রুক্ষ পাহাড়টা দেখছেন ওখানেই রয়েছে বিশ্বের সর্বোচ্চ মোটরপথ খারদুংলা পাস।
আমরা যাব সেই পথ ধরে। ভাবলেই ভয়ে গায়ে কাঁটা দেয়। আমরা যে পথ দিয়ে যাচ্ছি তার নাম বেকন হাইওয়ে। পুরো পথটাই সেনাবাহিনীর দখলে।
গোঁতা খেতে খেতে গাড়ি ক্রমশ খাড়াই উঠছে। প্রাণান্তকর চড়াইপথ। মাঝেমধ্যেই পথের অবস্থা বেশ খারাপ। ধসপ্রবণ অঞ্চল।
প্রায়ই পাথর গড়িয়ে পড়ে পথের ওপর। পথ খুব একটা প্রশস্ত নয়। বেশ কয়েকটা হেয়ারপিন বেন্ড পেরিয়ে পৌঁছলাম গাংলাস। গাড়ি থেকে নেমে নিচের দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল সবুজ সাজানো লে শহরের ছবি। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে শহরের ঘরবাড়িগুলোকে। চোখের সামনে বিস্তৃত লাদাখ রেঞ্জের গিরিশ্রেণি।
গংলাস ছাড়িয়ে আবার চড়াইপথে
রওনা হলাম। গাড়ির সামনের কাচ দিয়ে মুখ বাড়িয়ে পাহাড়ের দিকে তাকাতে দেখলাম
এই পথটা ইংরেজি ত অক্ষরের মতো সোজা পাহাড়ের মাথায় উঠে গেছে। দূর পাহাড়ে এগিয়ে চলা গাড়িগুলোকে খেলনা গাড়ির মতো ক্ষুদ্র দেখাচ্ছে। ফেলে আসা লে শহরটাকে
ওপর থেকে ক্রমশ ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে দৃশ্যপট থেকে মুছে যেতে দেখছি।
এই পথটা দুর্ঘটনাপ্রবণ অঞ্চল। খাদের গায়ে গড়িয়ে পড়া দুর্ঘটনাগ্রস্ত কয়েকটি গাড়ির কঙ্কাল চোখে পড়তেই বুকটা ভয়ে কেঁপে উঠল।
ধীরগতিতে গাড়ি চলছে আমাদের। একটু বেসামাল হলেই গড়িয়ে যাবে খাদের অতল গভীরে। বেশ কিছুটা যাওয়ার পরে গাড়ি আটকাল ট্র্যাফিক জ্যামে।
পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির দীর্ঘ লাইন।
গাড়ি থেকে নেমে সামনের দিকে হেঁটে গিয়ে দেখলাম ধস নেমে রাস্তার হাল
খুবই খারাপ হয়ে গেছে। একেই তো অপ্রশস্ত
রাস্তা তার ওপর এমন অবস্থা। বুলডোজার দিয়ে প্রায় আধঘণ্টা ধরে ধস সরিয়ে গাড়ি যাওয়ার পথ কিছুটা পরিষ্কার করে দেওয়ার পরে ধীরে ধীরে আবার নড়েচড়ে উঠল স্তব্ধ গাড়ির সারি। এই পথে এই এক সমস্যা। ড্রাইভারের কথায় আমরা খুব সকাল সকাল রওনা হয়েছি আরও
একটি কারণে, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই পথে বাড়তে থাকে ট্যুরিস্ট গাড়ির ভিড়। আর তার সঙ্গে যদি সেনাবাহিনীর কনভয় যুক্ত হয় তাহলে তো সোনায় সোহাগা। তখন খারদুংলার পথে যানজট ভয়ঙ্কর রূপ নেয়। যাই হোক আমরা ধসপ্রবণ অঞ্চল সাবধানে পেরিয়ে পৌঁছলাম সাউথ পুল্লুতে। এখানে সেনাবাহিনীর চেকপোস্টে পারমিট দেখাতে হলো।
এরপর গাড়ি চড়তে শুরু করল আরও খাড়াই দুর্গম পথ। এই পথ যেন আকাশ ছুঁতে চলেছে।
ক্রমশ ওপরে উঠে চলেছি। বাতাসে এখন ঠাণ্ডার প্রকোপ। অক্সিজেন কম টের পাচ্ছি। ঝোড়ো হাওয়া বইছে তীব্র গতিতে। অবশেষে পৌঁছলাম এই যাত্রাপথের অন্যতম আকর্ষণ বিশ্বের সর্বোচ্চ মোটরপথ খারদুংলা পাসে (উচ্চতা ১৮,৩৮০ ফুট)। লে থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে এখানে পৌঁছলাম। পাসে নেমে দেখলাম এখানে সেনাশিবির রয়েছে। লাগোয়া স্যুভেনির শপ ও ক্যাফেটেরিয়া চালাচ্ছে সেনা জওয়ানরা। ওখানেও পর্যটকদের ভিড়। পাসের চারপাশটা বরফে ঢেকে রয়েছে। চারপাশে হিমশৃঙ্গরাজি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখছি। উত্তরে দেখা যাচ্ছে কারাকোরাম পর্বতমালা, দক্ষিণ-পশ্চিমে লাদাখ আর জাঁসকার পর্বতমালার বিস্তৃতি আরও দূরে চোখে পড়ছে হিমালয়ান রেঞ্জ। খারদুংলা পাস চোখে পড়ল যেন বিখ্যাত সব পর্বতমালা দেখার ভিউ পয়েন্ট!
পাসের ওপর রয়েছে ছোট্ট বুদ্ধমন্দির আর শিবমন্দির। পতপত করে হাওয়ায় উড়ছে প্রার্থনা পতাকার সারি। হঠাৎ পাসের ওপর মেঘ করে কিছুক্ষণ তুষারপাত হলো। হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা। খারদুংলা পাসের আবহাওয়া ক্ষণে ক্ষণেই পাল্টায়।
ভারতীয় সেনাদের অদম্য প্রচেষ্টায় ১৯৭৩ সালে এই গিরিবর্ত্মের ওপর দিয়ে পথ তৈরি হয়। এই পথ বানাতে গিয়ে মারা যান বেশ কিছু সেনা জওয়ান। তাঁদের স্মৃতিতে বানানো একটি ফলকও রয়েছে পাসের ওপর।
পাসের ওপর কিছুক্ষণ কাটিয়ে এবার
নামতে থাকলাম বরফ ঢাকা দুর্গম রাস্তা পেরিয়ে। এরপর এলো নর্থ পুল্লু । এখানেও সেনাবাহিনীর চেকপোস্ট রয়েছে। প্রায় ২০ কিলোমিটার পথ উপত্যকায় গাঁ দিয়ে যাওয়ার পর এলো খারদুংলা গ্রাম। কয়েক ঘর জনবসতি নিয়ে ছোট্ট গ্রাম।
এদিকটায় সবুজ উপত্যকার বুক চিরে বইছে অচেনা পাহাড়ি ঝোরা। পথের ধারে তৃণভূমির মাঝে গর্ত থেকে উঁকি মারছে ভোঁদড় সদৃশ মারমটের দল।
খরগোশ আর ইঁদুরের সংমিশ্রণে তৈরি এই অভূতদর্শন প্রাণী লাদাখেই বেশি দেখা যায়। খারদুংলা পাস থেকে প্রায় ৫৭ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে ১২টা নাগাদ পৌঁছলাম খালসায়-এ। এখানেই পথের ধারে একটা সাদামাটা ধাবাতে দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম। খালসায় পৌঁছানোর বেশ কিছুটা আগে রং মাততি নামে একটি জায়গায় শিয়ক নদীর
সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হলো। চীনের রিমো হিমবাহ থেকে এই নদী জন্ম নিয়ে নুব্রা উপত্যকার ওপর দিয়ে বয়ে গিয়ে পাক-অধিকৃত বালতিস্তানে সিন্ধু নদে মিশেছে। রং মাততি পেরিয়ে খালসায় এলাম।
খালসাতে আসার পর চোখের সামনে ফুটে উঠল নুব্রা উপত্যকার অনবদ্য সৌন্দর্য।
অদূরেই দেখা যাচ্ছে নীল আকাশে হেলান
দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কারাকোরাম পর্বতমালা। ধূসর পাহাড়ের মাথায় বরফের আস্তরণ। আকাশে ভাসছে পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘের দল।
খালসার থেকে দুটি আলাদা পথ গেছে নুব্রা উপত্যকার দুই প্রান্তে। খালসার থেকে খানিকটা এগোতেই তিরিং এ শিয়ক নদীর সঙ্গে এসে মিশেছে সিয়াচেন হিমবাহ সৃষ্ট নুব্রা নদী। শিয়ক আর নুব্রা এই উপত্যকাকে সুজলা-সুফলা করে তুলেছে। নুব্রা উপত্যকায় বয়ে যাওয়ার সময় এই দুই নদী থেকে কয়েকটি শাখা-নালা তৈরি হয়ে তারাও আপন ছন্দে বয়ে চলেছে। লাদাখের অন্যতম সেরা সৌন্দর্যের খনি এই নুব্রা উপত্যকা।
খালসার থেকে সোজা রাস্তাটা চলে গেছে এই উপত্যকার সবুজ গ্রাম সুমোর এ। খালসার থেকে দূরত্ব ২০ কিলোমিটার। শিয়ক নদীর ব্রিজ পেরিয়ে চললাম সুমোরের দিকে।
গ্রামের গাঁ দিয়ে বইছে খরস্রোতা নুব্রা নদী। বিস্তৃত সমভূমি দিয়ে ছুটে চলেছে আমাদের গাড়ি। যে পথে এখন আমরা যাচ্ছি এই পথ প্রাচীন রেশমপথ বা সিল্ক রুটের একটা অংশ। অতীতে এই পথ ধরেই চীন থেকে যাযাবর সওদাগররা সোনা, জহরত রেশম, পশম-মশলা নিয়ে পাড়ি দিতো কারাকোরাম পর্বতমালার দুর্গম গিরিবর্ত্ম পেরিয়ে মধ্য এশিয়ায়। হুন উপজাতিরাও এই পথ ধরে ভারতে এসেছিল।
পথের দু’ধারে উইলো আর পপলার গাছের সারি। দু’পাশে গ্রাম-লাগোয়া বিস্তীর্ণ চাষের খেত। চেনা-অচেনা রঙিন মরসুমি ফুলে ভরে আছে নুব্রা উপত্যকা। কারাকোরাম গিরিশিরা এখন হাতের মুঠোয় এসে গেছে। ন্যাড়া পাহাড়ের গায়ে রঙিন বর্ণচ্ছটা। সুমোর গ্রামের মধ্যে রয়েছে একমাত্র দ্রষ্টব্য প্রায় ১৮০ বছরের পুরনো সামস্তলিং গুম্ফা। গুম্ফাটা আকারে বেশ বড়। গুম্ফার গায়ে নতুন রঙের প্রলেপ পড়ায় বেশ ঝলমলে দেখতে লাগছে। গুম্ফার মধ্যে রয়েছে পদ্মসম্ভব ও অবলোকিতেশ্বর বুদ্ধের মন্দির। দেওয়ালের চিত্রকলাও চমৎকার। গুম্ফার একাংশ চিত্রকলাও চমৎকার। একাংশ নবনির্মিত।
রয়েছে দলাই লামার শয়নকক্ষ। গুম্ফার ছাদে উঠে সুমোর গ্রাম আর নুব্রা উপত্যকার ছবি তুললাম। সুমোর গ্রামে কয়েকটি হোটেল ও গেস্টহাউস রয়েছে রাত কাটানোর জন্য। সুমোর গুম্ফা দেখে বেরিয়ে এলাম। রেশমপথে কিছুক্ষণ পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ালাম। এই রাস্তা চলে গেছে ২২ কিলোমিটার দূরের পানামিক গ্রামে। সেখানে একটা উষ্ণপ্রস্রবণ রয়েছে। পানামিক পর্যন্ত যাওয়ার অনুমতি দেবে সেনাবাহিনী।
তারপর সাধারণ মানুষের জন্য পথ রুদ্ধ। এই পথ গিয়ে শেষ হয়েছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ যুদ্ধক্ষেত্র সিয়াচেন হিমবাহে। এখান থেকে সিয়াচেন হিমবাহ ঘণ্টাপাঁচেকের সফর।
নুব্রা বেশ প্রশস্ত উপত্যকা। উচ্চতা প্রায় ১১,০০০ ফুট।
সুমোর গ্রাম থেকে ফিরে এলাম খালসারে।
এবার গন্তব্য এখান থেকে ২১ কিলোমিটার দূরে নুব্রা উপত্যকার সবচেয়ে বড় ও প্রধান জনপদ ডেসকিট। লে থেকে ডেসকিটের দূরত্ব ১১৮ কিলোমিটার।
গাড়ি চলেছে ডানদিকের এক নতুন পথ দিয়ে। উপত্যকার বুক চিরে শিয়ক নদীকে ডানদিকে রেখে পথ চলেছে ডেসকিটের দিকে। এটা নুব্রা উপত্যকার কোল্ড ডেজার্ট অর্থাৎ তুষারমরু অঞ্চলের প্রধান অংশ। পথের দু’পাশে সাদা বালির ঢেউ খেলানো ময়দান। শিয়ক নদীর ধার দিয়ে ডেসকিট, হুন্ডার, খারু, ছালুঙ্খা হয়ে পথ গিয়ে শেষ হযেছে পাক অধিকৃত কাশ্মীর সীমান্তে তুর্তুক এ। তবে এই পথে হুন্ডারের পর যাওয়ার অনুমতি মিলবে না পর্যটকদের। খালসার থেকে এই পথে লের দিক থেকে এলে বাঁদিকে ও সুমোরের দিক থেকে এলে ডানদিকে ঘুরতে হবে নুব্রা উপত্যকার এই মূল অংশে প্রবেশের জন্য।
সাদা বালির বিস্তৃত্ব উপত্যকার মাঝখান দিয়ে সর্পিল পথ চলে গেছে উপত্যকার অন্দরে।
অপার নির্জনতা এদিকটায়। কানে বাজছে শিয়ক নদীর জলতরঙ্গ। যত এগোচ্ছি বালিয়াড়ির বৈচিত্র্য ততই বাড়ছে। মনে পড়ছে রাজস্থানের মরুপথে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। দু’পাশে কারাকোরাম পর্বতমালার সুউচ্চ প্রাচীর। গাড়ি কখনও পাহাড়ে উঠছে, কখনও বা উপত্যকার বুকে নেমে আসছে। রোমাঞ্চকর যাত্রাপথ। অবশেষে পৌঁছলাম ডেসকিট গঞ্জে। হোটেল, গেস্টহাউস, দোকানপাট, গ্রাম্য বাড়িঘর নিয়ে মাঝারি মাপের ব্যস্ত গঞ্জ এটি। এখানেও প্রচুর চাষ হয় গ্রাম-লাগোয়া কৃষিজমিতে। এদিকে প্রচুর চাষ হয় গ্রা বালিয়াড়ি কিছুটা কম। নদীর জলকে সেচের কাজে লাগিয়ে কৃষিকার্য চলছে। আপেল আর অ্যাপ্রিকট ফলের বাগানও রয়েছে এই গ্রামে।
ডেসকিটে প্রবেশের পর দেখতে চললাম
প্রধান দ্রষ্টব্য নুব্রা উপত্যকার সবথেকে প্রাচীন ও বড় গুম্ফাটি। পথের বাঁদিকে পাহাড়ের ওপর গুম্ফার অবস্থান। পাহাড় ঘুরে গাড়ি চলার পথ গেছে গুম্ফার সামনে। ১৪২০ সালে তৈরি এই গুম্ফাটির পোশাকি নাম খাদান তাশিচোলিং গুম্ফা। পুরো পথের ধারে সার দিয়ে বানানো হয়েছে নানা মাপের চোর্তেন।
গাড়ি থেকে নেমে লামাদের গ্রামের মধ্য দিয়ে খাড়াই সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছলাম গুম্ফার প্রবেশ ফটকে। এই গুম্ফার প্রবেশমূল্য মাথাপিছু ২০ টাকা। গুম্ফার মূল মন্দিরে রয়েছে নানা রূপের কালীমূর্তি, বুদ্ধের চক্রপাণি মূর্তি, মহাকালী, ভৈরব মূর্তি। গুম্ফাটি গেলকুপা লামাদের অধীনে। গুম্ফার দেবমূর্তিগুলোর ভয়ঙ্কর রূপ দেখলে গা ছমছম করে। গুম্ফার মধ্যে আলো-আঁধারি পরিবেশ। দেওয়ালে দেওয়ালে ছড়িয়ে রয়েছে থাঙ্কা চিত্রকলা। বৃদ্ধ লামা বসে মন্ত্র পাঠ করে চলেছেন এক মনে। এখানে একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখলাম। কালীমূর্তিগুলোর মুখ কাপড় দিয়ে ঢাকা। অক্টোবর মাসে এক বিশেষ উৎসবের দিনে বছরে একবার কালীমূর্তিগুলোর মুখের ঢাকা খোলা হয়।
গুম্ফার সংলগ্ন অঞ্চলে একটি লামাদের স্কুল রয়েছে। পাহাড়ের মাথায় একটা বিশাল বুদ্ধমূর্তি তৈরির কাজ চলছে জোরকদমে।
এই গুম্ফার ওপর থেকে কারাকোরামে পর্বতমালার কোলে নুব্রা উপত্যকার মন ভোলানো দৃশ্যপট চোখে পড়ল। ওপর থেকে দেখছি উপত্যকার সফেদ বালিয়াড়ির বুক চিরে সাপের মতো এঁকেবেঁকে বয়ে চলা শিয়ন আর নুব্রা নদীর প্রবাহ।
দূরে দেখা যাচ্ছে কে-টু সাসের কাংড়ি, গোল্ডেন থ্রোন প্রভৃতি বিখ্যাত হিমশৃঙ্গ। ভারতের উত্তরতম সীমানায় এখন আমরা দাঁড়িয়ে।
আরও পড়ুন: আন্দামান: জীবন্ত প্রবালের জন্য বিখ্যাত যে দ্বীপপুন্জ
গুম্ফা দেখে নেমে এলাম ডেসকিটে। ডেসকিটের থেকে চললাম এই পথের শেষ ঠিকানা হুন্ডারের দিকে। এই পথটুকুর দূরত্ব মাত্র ৭ কিলোমিটার। ডেসকিট ও হুন্ডারে বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকলেও টেলিফোনের যোগাযোগ সব সময় থাকে না। মোবাইলও কাজ করবে না এই বিচ্ছিন্ন প্রান্তরে।
ডেসকিট গ্রামের সীমানা পেরতেই সবুজ উধাও হয়ে পথের দু’পাশে সাদা বালির ঢেউ খেলানো
প্রান্তর শুরু হলো। বালিয়াড়ির মাঝেমধ্যে উঁকি মারছে কাঁটাঝোপ। এই তুষারমরু প্রকৃতির এক আজব সৃষ্টি। বালিয়াড়ির এক পাশ দিয়ে বইছে শিয়ক নদী। মাঝেমধ্যেই ঝোড়ো হাওয়ায় বালিয়াড়ির রূপ বদলাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম হুন্ডার গ্রামে। মরুপ্রকৃতির মাঝে এই গ্রাম যেন মরূদ্যান। সবুজ গাছপালায় ছাওয়া হুন্ডার
গ্রাম প্রায় ৩,১০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত।
কয়েকটি নদীসৃষ্ট জলাশয় রয়েছে গ্রাম লাগোয়া তৃণভূমির মাঝে। পুরো গ্রামটাই সুউচ্চ পাহাড়ের প্রাচীরে ঘেরা। আজ রাতটা আমরা থাকব এই গ্রামের রিসর্টে। গ্রামে পৌঁছে হাঁটাপথে পৌঁছলাম ক্যাম্প অর্গ্যানিক রিটিপ্রটি রিসর্টে। এই সুইস ক্যাম্পের চারপাশ ফুলবাগানে ঘেরা। চাষ হচ্ছে হরেকরকম সবজি। আপেল ও খোবানি গাছও রয়েছে প্রচুর। গ্রামের একপাশ দিয়ে বইছে শিয়ক নদী। গ্রামের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা অনামী জলধারা গিয়ে মিশেছে ওই নদীর সঙ্গে। হুন্ডার পৌঁছতে সন্ধ্যে ৬টা বেজে গেল।
সন্ধ্যে বললে ভুল হবে। এই দিকে প্রায় ৮ টা পর্যন্ত দিনের আলো থাকে। নির্জন উপত্যকার আকাশে মাঝেমধ্যে চক্কর মারছে বায়ুসেনার হেলিকপ্টার। এদিকেও বিদেশি পর্যটক বেশি। গ্রামের রিসর্টে রাত কাটল।
পরদিন সকালে ব্রেকফাস্টের পর
রওনা হলাম হুন্ডারের শীতল মরুপ্রান্তরের স্যান্ড ডিউনেস। গতকাল যে পথ দিয়ে এসেছি সেই পথেই চলেছি। গতকাল গাড়ি থেকে বালিয়াড়ি দেখেছি। আজ গাড়ি থামিয়ে নামলাম সাদা বালির মরুভূমিতে। পিচসড়ক ছেড়ে বালিয়াড়ির ওপর দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। নানা আকৃতির
বালিয়াড়ি রয়েছে বিস্তীর্ণ প্রান্তরে। মাঝেমধ্যে মরুদ্যানের মতো সবুজ প্রান্তর। তার ওপর দিয়ে ঝিরঝির করে বইছে জলধারা। আশ্চর্য প্রকৃতি এখানে। এখানে বালিয়াড়িতে কামেল সাফারির ব্যবস্থা রয়েছে। লাদাখের ব্যাকট্রিয়ান উট। মধ্য এশিয়া থেকে রেশমপথ ধরে এই প্রাণী এসেছে নুব্রা উপত্যকায়। তারপর বংশবিস্তার করে সুদূর অতীত থেকে রয়ে গেছে এই উটের দল। রাজস্থানের উটের থেকে আকৃতিতে কিছুটা ছোট এই উটের গায়ে লোম ভর্তি। পিঠে একটির বদলে রয়েছে দুটি কুঁজ, এটাই বিশেষত্ব।
উটের পিঠে চেপে বালিয়াড়িতে ক্যামেল রাইডিংয়ের খরচ ১৫ মিনিটের জন্য জনপ্রতি ১৫০ টাকা। ক্যামেল রাইডিং চালু থাকে শুধু হুন্ডারেই প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে ১২টা ও দুপুর ৩টা থেকে সন্ধ্যে ৬টা পর্যন্ত। আমরাও কিছুক্ষণ উটের পিঠে চড়ে বেড়ালাম শীতল মরুর বুকে। দূরে নদীর তীরে ছুটে বেড়াচ্ছে কয়েকটি কিয়াং গাধা। উটের পিঠে থেকে নেমে কিছুক্ষণ হাঁটলাম বালিয়াড়ির উপর দিয়ে।
এরপর উপত্যকার উপর বয়ে চলা ঝোরার ওপর অস্থায়ী কাঠের সাঁকো পেরিয়ে হেঁটে চললাম শিয়ক নদীর তীরে। আপন ছন্দে পাথর ডিঙিয়ে বয়ে যাচ্ছে শিয়ক। প্রকৃতি যেন সৌন্দর্যের ডালি উপুড় করে দিয়েছে নুব্রা উপত্যকায়। বেলা ১২টা নাগাদ রওনা দিলাম ফিরতি পথে। খারদুংলা গিরিবর্ত্ম পেরিয়ে লে শহরে পৌঁছলাম সন্ধ্যের সময়।