নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট জয়ের মধ্য দিয়ে নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসে অন্যতম সেরা এক নজির গড়ল বাংলাদেশ। ১৬ বারের চেষ্টায় অবশেষে টেস্টে হারানো গেল নিউজিল্যান্ডকে।
এই জয়ের মাধ্যমে ভেঙে দেয়া হল নিজেদের মাটিতে নিউজিল্যান্ডের টানা ১৭ ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ড। এক কথায় রেকর্ড বইয়ে ওলট-পালট করে দেয়া একটি জয়ই তুলে নিয়েছে বাংলাদেশ। তবে এই জয়ের পেছনে মূল টার্নিং পয়েন্টগুলো ছিল কোনগুলো?
টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অবস্থা বরাবরই শোচনীয়। পরিসংখ্যান ঘাঁটলেই তা পরিষ্কার বোঝা যায়। আর বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের টেস্ট পরিসংখ্যান তো রীতিমতো লজ্জাজনক। সেখানে এবারও আশঙ্কা ছিল নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে আরেকটি ভরাডুবির। এটি হল সেই নিউজিল্যান্ড,যারা কিনা বর্তমান ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়ন।
কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেই নিউজিল্যান্ডকেই রীতিমতো শাসন করে হারিয়ে দিল র্যাংকিং এ ৯ নম্বরে থাকা বাংলাদেশ! সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে,কি পরিমাণ কঠোর নিবেদন,মনোযোগ ও আত্নবিশ্বাসের সংযোগ ঘটিয়ে এ জয় অর্জন করতে হয়েছে। এই ম্যাচে প্রতিটি ক্ষণে ক্ষণে বাংলাদেশ দল এতটাই নিখুঁত ছিল যে,তার মধ্য থেকে কয়েকটি মূল টার্নিং পয়েন্ট খুঁজে বের করতে রীতিমতো ঘাম ঝরাতে হয়েছে।
শরীফুল-তাসকিনের আগুনঝরা বোলিংয়ের সূচনা
টেস্ট ম্যাচের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হল প্রথম সেশনের প্রথম ঘন্টা। এ সময়টা ব্যাটসম্যানদের জন্য অনেকটা অগ্নিপরীক্ষার মতই। কাজেই অধিনায়ক মুমিনুল টস জিতে বোলিং নিতে দু’বার ভাবেননি। বল তুলে দিয়েছিলেন শরীফুল-তাসকিনের হাতে। তারাও দিয়েছেন আস্থার পূর্ণ প্রতিদান। দু প্রান্ত থেকে শুরু হল আগুনঝরা বোলিং। আর সেই তোপেই কিনা ভেঙে পড়ল নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিং মেরুদণ্ড।
অধিনায়ক লাথামকে আউট করে শুরুতেই বিশাল ধাক্কা দিলেন শরীফুল। শরীফুলের সুইংয়ে রীতিমতো বোকা বনে গিয়ে লিটনের হাতে ক্যাচ তুলে দিয়ে প্যাভিলিয়নে ফেরত গেলেন নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিং স্তম্ভ। টেস্ট ক্রিকেটে বোলিংটা সবসময় করতে হয় একটি জুটি হিসেবে। একপ্রান্ত থেকে ক্রমাগত ডট বল করতে থাকলে অপরপ্রান্তের বোলারের উইকেট পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় বহুগুণ। ঠিক এই কাজটিই করেছেন তাসকিন-শরীফুল জুটি। লাইন-লেন্থ ঠিক রেখে সুইং-বাউন্সের পসরা সাজিয়ে রীতিমতো খোলসবন্দি করে রেখেছিলেন ব্যাটসম্যানদের।
শরীফুল তো ছিলেন অসাধারণ। প্রথম ইনিংসে তুলে নিয়েছেন নিউজিল্যান্ডের গুরুত্বপূর্ণ ৩ ব্যাটসম্যানকে। অন্যদিকে প্রথম ইনিংসে উইকেট না পেলেও তাসকিন ছিলেন মিতব্যয়ী। ফলে অধিনায়কের আস্থার পূর্ণ প্রতিদানই দিয়েছেন এই জুটি। এটিই ছিল ম্যাচের প্রথম টার্নিং পয়েন্ট।
মিরাজ–মুমিনুলের স্পিন ভেলকিতে আচমকা ধ্বস
প্রাথমিক ধাক্কা সামলে বেশ ভালই জবাব দিচ্ছিল নিউজিল্যান্ড। উইকেট ধরে রেখে রানের চাকা সচল রেখেছিলেন তারা। দূর্দান্ত শুরু করা পেসাররাও যেন কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। ঠিক তখন নিজেই বল হাতে তুলে নিলেন মুমিনুল। তাতেই যেন সর্বনাশ ঘটল নিউজিল্যান্ডের।
অত্যন্ত সাবলীল ও দূর্দান্ত খেলতে থাকা ১২২ রান করা ডেভন কনওয়েকে ফিরিয়ে দিয়ে যেন বাংলাদেশকেই ম্যাচে ফেরালেন মুমিনুল। মুমিনুলের করা নিরীহ এক বলের পাতা ফাঁদে পা দিয়েই যেন কাটা পড়লেন এই ব্যাটসম্যান। “দ্যা ম্যান উইথ গোল্ডেন আর্ম” যাকে বলে আরকি! এরপর তুলে নিলেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭৫ রান করা হেনরি নিকোলসকে। যেন দানে দান মারলেন মুমিনুল। কালেভদ্রে বল হাত তুলে নেয়া মুমিনুলই যেন ধ্বস নামালেন নিউজিল্যান্ড মিডল অর্ডারে।
আর বাকি কাজটা সারলেন মেহেদী মিরাজ। তার ঘূর্ণিতে নাকাল নিউজিল্যান্ডের ৩ ব্যাটসম্যান। শরীফুল-তাসকিন-ইবাদত যেখানে ভেঙে দিয়েছিলেন নিউজিল্যান্ডের টপ অর্ডারকে,সেখানে ৫ উইকেট তুলে নিয়ে বাকি কাজটা সারলেন মুমিনুল-মিরাজ জুটি।
একটা সময় যখন মনে হচ্ছিল,নিউজিল্যান্ড প্রথম ইনিংসে ৪৫০ এর অধিক রান তুলবে,সেখানে আচমকাই মুমিনুল-মিরাজের স্পিন বিষে নাকাল হয়ে মাত্র ৩২৮ রানেই গুটিয়ে গেল নিউজিল্যান্ডের প্রথম ইনিংস। প্রথম ইনিংসে এই কম রান করাটাই শেষ পর্যন্ত কাল হয়ে দাঁড়ায় নিউজিল্যান্ডের জন্য। ম্যাচ হারের অন্যতম কারণও এটি। এটি ছিল ম্যাচের দ্বিতীয় টার্নিং পয়েন্ট।
শান্ত–জয়ে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে সাবলীল শুরু
টেস্ট ম্যাচে বাংলাদেশের ওপেনিং মানেই যেন একরাশ হতাশার নাম। ব্যাটিংয়ে নামার কিছুক্ষণের মধ্যেই ২-৩ উইকেট পড়ে যাওয়াকে যেন ডালভাত বানিয়ে ফেলেছিল বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানরা। সেখানে সম্পূর্ণ নতুন এক ছবি দেখতে পেলাম আমরা।
মাত্র দ্বিতীয় টেস্ট খেলতে নামা মাহমুদুল হাসান জয় ও সাদমান ইসলাম ইনিংসের শুরুটা করলেন খুবই সাবলীল ও স্বাচ্ছন্দ্যে। দূর্ভাগ্যবশত সাদমান দ্রুত আউট হয়ে গেলেও এরপর হাল ধরেন জয় ও শান্ত। জয়ের ব্যাটিং দেখে কখনও মনেই হয়নি মাত্র দ্বিতীয় টেস্ট খেলছেন তিনি। অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানের মতই দেখেশুনে ঠান্ডা মাথায় খেলেছেন তিনি।
বল বুঝে শট সিলেকশন ছিল প্রায় নিখুঁত। অন্যপ্রান্তে নামা শান্ত আবারও প্রমাণ করলেন কেন তার পেছনে এতবছর ধরে বিনিয়োগ করা হচ্ছে। দুজন মিলে গড়েন ১০৪ রানের প্রতিরোধী বিশাল জুটি। বল বুঝে কখনও আক্রমণাত্মক,কখনও রক্ষণাত্মক খেলে মাঠের চারপাশ জুড়েই রানের পসরা সাজিয়ে বসেন এই দুই তরুণ তুর্কি। বিশেষ করে জয়ের ধৈর্যশীল ও মাথা ঠান্ডা রেখে ব্যাটিংয়ের ভূয়সী প্রশংসায় মেতে ওঠেন ক্রিকেট বিশ্লেষকগণ। টপ অর্ডারের টানা ব্যর্থতার জুজু যেন কাটালেন এই দুই ব্যাটসম্যান। ক্রিজে তাদের বোঝাপড়াটাও ছিল চোখে পড়ার মত। জয়ের ২২৮ বলে ৭৮ ও শান্তর ১০৯ বলে ৬৪ রানের ইনিংসই বলে দেয় তারা কতটা মনোযোগী ছিলেন ম্যাচে।
ধাক্কা সামাল দিয়ে রানের মুমিনুল–লিটনের রানপাহাড়
উড়তে থাকা বাংলাদেশের ব্যাটিং ইনিংস হঠাৎই চাপে পড়ে যায় ২০৩ রানের মধ্যে পরপর শান্ত,জয় আর মুশফিকের উইকেটের পতনে। ক্রিজে আসেন নতুন দুই ব্যাটসম্যান,অধিনায়ক মুমিনুল ও লিটন। অতীত রেকর্ড বলে,বহুবার এসব পরিস্থিতিতে খুব অল্প সময়েই গুটিয়ে যাওয়ার নজির আছে বাংলাদেশের।
কিন্ত,মুমিনুল-লিটন যেন সেটার পুনরাবৃত্তি হতে না দেয়ার পণ করেই নেমেছিলেন। কাজটা সহজ ছিল না মোটেও। নিউজিল্যান্ডের পেসাররা সুযোগ পেয়ে যেন চেপে বসতে চেয়েছিলেন ওদের ওপর। নেইল ওয়াগনার তো রীতিমতো আরো একধাপ এগিয়ে ক্রমাগত স্লেজিংয়ে ব্যতিব্যস্ত করে রাখছিলেন মুমিনুল-লিটনকে। কিন্তু,জবাবটা ব্যাটেই দিল ওরা। সম্পূর্ণ দুই রকম কৌশলে রানের চাকা ঘোরাতে লাগলেন দুই ব্যাটসম্যান। একদিকে লিটন আক্রমণাত্মক হয়ে চড়ে বসেছিলেন বোলারদের ওপর। অপরদিকে মুমিনুল ছিলেন কিছুটা রক্ষণাত্মক।
আরও পড়ুন: অধিনায়ক মাশরাফির যে বিশেষ গুণাবলি তাঁকে করেছে ব্যতিক্রম
এই দুইয়ের মিশেলে নিউজিল্যান্ডের বোলাররা যেন হয়ে পড়ল দিশেহারা। আবার জমাট বাঁধা জুটি গড়ে ফেলল ওরা। দেখতে দেখতে জুটিটা হয়ে গেল ১৫৮ রানের! এই জুটির ওপর ভর করেই বাংলাদেশের লিড নেয়ার ভিত্তি গড়ে উঠল। তবে দুজনেরই সেঞ্চুরি করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সেটি পূরণ না হওয়ার আক্ষেপ থেকেই যাবে।
মুমিনুল ও লিটন আউট হয়ে যান ৮৮ ও ৮৬ রানে। তবে মঞ্চ প্রস্তুত করে দিয়ে যান বাকিদের জন্য। বাংলাদেশকে নিরাপদ অবস্থানে পৌঁছে দিয়েই নিজেদের দায়িত্ব পালন করেন মুমিনুল-লিটন। এরপর বাকি কাজটা সারেন মেহেদী মিরাজ ও ইয়াসির রাব্বি। মিরাজের দ্রুত ও কার্যকরী ৪৭ রানের ইনিংসে তরতর করে বাড়তে থাকে লিড এর চাকা। সঙ্গ দেন ২৬ রান করা রাব্বি। অবশেষে ৪৫৮ রানে থামে বাংলাদেশের ইনিংস। বাংলাদেশ পায় ১৩০ রানের মহা মূল্যবান লিড।
স্যালুট এবাদত!
টেস্ট শুরুর আগে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ব্যক্তিটি ছিলেন এবাদত হোসেন। দলে তার অন্তর্ভুক্তি নিয়ে উঠেছিল সমালোচনার ঝড়। সেটি যে অমূলক ছিল,তাও বলা যাবে না। কেননা,এই ম্যাচের আগ পর্যন্তও এবাদতের পারফরম্যান্স ছিল একেবারেই গড়পড়তা। কাজেই তাকে একাদশে দেখে অনেকের চোখ বাঁকা হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক।
কিন্তু ম্যাচে যেন পাওয়া গেল সম্পূর্ণ নতুন এক এবাদতকে। হয়তো সমালোচনার জবাব দেয়ার জেদ চেপেই মাঠে নেমেছিলেন। প্রথম ইনিংসে উইকেট পেয়েছিলেন মোটে একটি। কিন্তু,আসল গোলাবারুদ যেন সব জমিয়ে রেখেছিলেন ৪র্থ দিনের জন্য! ৪র্থ দিনে নিউজিল্যান্ডের ২য় ইনিংসের ব্যাটিংয়ে তখন বেশ ভাল অবস্থান। ২ উইকেটে ১৩৬ রান করে নিউজিল্যান্ড তখন বাংলাদেশকে বড় টার্গেট ছুঁড়ে দেয়ার সব রকম আয়োজনই করে ফেলেছিল।
আরও পড়ুন: সাকিব আল হাসান: ক্ষুরধার ক্রিকেটীয় মস্তিষ্কই কী তাঁর সবচেয়ে বড় অস্ত্র?
মনে হচ্ছিল বেশ বড় সংগ্রহের দিকেই যেন এগোচ্ছে নিউজিল্যান্ড। ঠিক তখনই এবাদত সিদ্ধান্ত নিলেন পাঁচদিনের ম্যাচটার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনা ঘটানোর। গতি আর সুইংয়ে ব্যাটসম্যানদের নাকাল করে একে একে তুলে নিলেন ইয়াং,নিকোলস ও ব্লান্ডেল এর উইকেট। ১৩৬-২ থেকে নিউজিল্যান্ডের স্কোরকার্ড হয়ে গেল ১৩৬-৫! শেষ বিকেলে সূর্য পড়ন্ত হয়ে হেলে পড়লেও এবাদত যেন সূর্যের উত্তাপের মতই জ্বলে উঠলেন।
তার সেই ২০ মিনিটের ছোঁড়া আগুনের গোলাতেই ছারখার হয়ে গেল গোটা ব্যাটিং লাইন আপ। ম্যাচের পাল্লা হেলে পড়ল বাংলাদেশের দিকে। তবু শঙ্কা ছিল শেষ দিনে রস টেইলর আবার প্রতিরোধ গড় তুলে ম্যাচটা বের করে নিয়ে যায় কিনা? তবে পরদিন সকালেই এবাদত জানান দিলেন,শেষ বিকেলের আগুন এখনও নিভে যায়নি।
যেখান থেকে শেষ করেছিলেন,সেখান থেকেই যেন শুরু করলেন। রস টেইলরকে কুপোকাত করে যেন পুরো ম্যাচটাকেই ঠেলে ফেলে দিলেন বাংলাদেশের কোর্টে। সঙ্গে বাকি ব্যাটসম্যানদের লেজ মুড়ে দেয়ার কাজটা করলেন তাসকিন। ৬ উইকেট নিয়ে এবাদত একাই ধ্বসিয়ে দিলেন বিশ্বসেরা টেস্ট ব্যাটিং লাইন আপ কে। ম্যাচে মোট ৭ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরার পুরস্কার জেতার পাশাপাশি বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে সেরা সাফল্যের পাতায় নিজের নামটা হেডলাইনে বড় করে লিখলেন। উইকেট নেয়ার পর বারবার স্যালুট ঠোকা এবাদতকে এবার দাঁড়িয়ে স্যালুট ঠুকল গোটা বিশ্বের কোটি কোটি ক্রিকেট অনুরাগী!
এই ঐতিহাসিক জয়টি এমনি এমনিই আসেনি। প্রতিটি মুহুর্তে কতটা নিখুঁত হলে এমন ম্যাচ বের করে আনা সম্ভব,সেটিই জানান দিয়েছে টাইগাররা। ১৩ সেশনের প্রায় প্রতিটি সেশনে নিউজিল্যান্ডকে শাসন করা যেন সেটিরই জানান দেয়।
তাইতো ম্যাচ শেষে তাসকিন বলছিলেন যে,ম্যাচ জয়ের জন্য তাদের প্রত্যেককে ১১০% নিবেদন ঢেলে দিতে হয়েছে। সুতরাং,ম্যাচের মূল টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে কয়েকটি ঘটনাপ্রবাহকে বেছে নেয়ার কাজটা সহজ নয় মোটেও। বরঞ্চ বাংলাদেশ দলের ১১ জন ক্রিকেটারই যেন ছিলেন জয়ের টার্নিং পয়েন্ট!