পাঠানদের কথা স্কুলে পড়ার সময়ে শিক্ষকদের মুখে বহুবার শুনেছি।
পিরোজপুর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের বড় হুজুর লোকমান হোসেন বলতেন, পাঠানদের চেহারার সঙ্গে ইহুদিদের চেহারার অনেকটা মিল রয়েছে।
পাঠানরা থাকে পাকিস্তানের উত্তর -পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে।
পাঠানদের মধ্যে রয়েছে তীক্ষ্ণবুদ্ধি, সাহসিকতা, যুদ্ধপ্রিয়তা, অতিথিপরায়ণতা। এরা আশ্রিতবৎসলও বটে।
সে বহু বছর আগের কথা, ১৯৬৮ খৃষ্টাব্দে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে পাঠানদের দেশে বেড়াতে গিয়ে পেশোয়ারে কয়েকদিন অবস্থানের কথা মন থেকে কোনদিন হয়তো সরানো যাবে না। কারণ, সে তো মনে রাখার মতো ঘটনা।
পেশোয়ারের সদর রোডস্থ সিন্দবাদ হোটেলে উঠেছিলাম। হোটেলের ম্যানেজারকে বললাম, পেশোয়ার ঘুরে দেখব, কম খরচে ঘুরে দেখার ব্যবস্থা আছে কি না। উনি বললেন, ট্যুরিজমের লোক এলেই আপনার রুমে পাঠিয়ে দেব।
পরদিন পর্যটনের গাড়িতে চড়ে পেশোয়ার শহর দেখতে বের হলাম।
আরও পড়ুন: হৃদয় স্পর্শ করা মহাতারকা অমিতাভ বচ্চন
যা যা দেখেছিলাম – ইসলামিয়া কলেজ, জাহাঙ্গীরাবাদ, কাবুল রিভার চ্যানেল, পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, ওয়াজিরবাগ, পলোগ্রাউন্ড, আফগান কলোনি, নটিয়া গেট, সানহেরি মসজিদ, খুশাল খান কাহাতক পার্ক, আর্মি স্টেডিয়াম, জামরুদ দুর্গ,
বালা হিসাব দুর্গ, চক ইয়াদগার, আবাসিন ঘাট, মোহাব্বত খান মসজিদ, খালেদ বিন ওয়ালিদ পার্ক, সেন্ট জনস ক্যাথেড্রাল চার্চ, লাহোরি গেট, সদর শাহ গেট, গঞ্জ গেট, আসামাই গেট, স্যার এশিয়া গেট, পেশোয়ার ক্যান্টনমেন্ট, বিমানবন্দর ইত্যাদি।
পেশোয়ার শহর দেখার সময় আমারই বয়সি সৈয়দ আহমেদ নামে একটি ছেলের সঙ্গে পরিচয় হয়। তখন তার বয়স সতেরো, আমারও তাই। সে আমাকে ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল দিলীপ কুমার ও রাজ কাপুরের দাদার বাড়ি।
দিলীপ কুমার, পৃথ্বিরাজ কাপুর, রাজ কাপুর, শাম্মী কাপুর এরা তো ছিলেন পাঠান।
পেশোয়ার শহরের আসল নাম ছিল পুষ্পপুরা। একদা ফুলে ফুলে ছেয়ে ছিল পেশোয়ার অঞ্চল। তখনও শহর গড়ে ওঠেনি। মোগল সম্রাট বাবরের স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই পেশোয়ারে।
দিলীপ কুমারের দূর সম্পর্কের আত্মীয় সৈয়দ আহমেদ আমাকে নিয়ে একটি বাজারে গেল। সমবয়সী সৈয়দ আহমেদ বলল, এই যে বাজারটি দেখছেন এর নাম কেচ্ছাখানি।
বাজরটি দেখে তো অবাক বনে গেলাম। ভেবে ছিলাম, আলিফ -লায়লার বর্ণিত কোনো এক শহরের সঙ্গে যেন এর হুবহু মিল রয়েছে।
শীতকালে পেশোয়ারের উত্তরে উঁচু -উঁচু পাহাড়ে বরফ জমে ওঠে, তখন উটে চড়ে সওদাগরেরা আসেন এই বাজারে। নানান ধরনের ফলফলাদি তারা বিক্রি করেন।
উত্তরের আফগানিস্তান, দীড়, সোয়াত, চিত্রল প্রভৃতি জায়গার লোকজন নানারকম পণ্য নিয়ে এই কেচ্ছাখানি বাজারে এসে ভিড় জমান। বাজারে ঢুকেই দেখলাম, আঙুর, বেদনা, পীচ, আখরোট, আপেল সহ কত রকমের ফল। বড় বড় তরমুজও চোখে পড়েছিল। কিসমিস, মনক্কা, খোবানি, পেস্তা ইত্যাদিও চোখ থেকে এড়িয়ে যায়নি।
সৈয়দ আহমেদ আমার ডান হাতে কয়েকটি আঙুর দিয়ে বললো, এগুলো খেয়ে দেখুন। এগুলো খেলে আঙুর কিনতে ইচ্ছে হবে। মুখে দিয়ে অনুভব করলাম, দারুণ মিষ্টি।
কথায় কথায় সৈয়দ আহমেদ জানিয়েছিল, তাঁর বাবা থাকে সোয়াতে। ওর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে ওকে এবং ওর মাকে ফেলে দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে সে সোয়াতে থাকে। পেশোয়ারে সে তার মাকে নিয়ে ছোট একটা কামরায় বসবাস করে। ওর মা কয়েকটি বাড়িতে রান্না করে সংসার চালায়। তার মায়ের আয় রোজগারের টাকায় সৈয়দ আহমেদও আমার মতো ১৯৬৮ খৃষ্টাব্দে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিল।
সৈয়দ আহমেদের কাছেই শুনেছিলাম, পেশোয়ার বহুকালের পুরনো শহর। প্রাচীন সংস্কৃতি -সাহিত্যে এর নাম গান্ধার। পরে নাম হয় পুরুষপুর। আল বেরুনী এই পেশোয়ারকে বলেছেন, পশিয়ার। মোগল সম্রাট আকবর এর নাম দিয়েছেন, পেশোয়ার। তারপর থেকেই হয়ে গেল পেশোয়ার।
আরও পড়ুন: সোয়াত উপত্যকার আলকোজাইন পশতুন থেকে যেভাবে সালমান খান
পাঠানদের মাতৃভাষা হল পশতু। পশতুতে আরবি ভাষার শব্দ প্রচুর রয়েছে।
সৈয়দ আহমেদ একদিন ওর ঘরে আমাকে নিয়ে গেল। ওর মা সেই সময় ঘরে ছিলেন না। সৈয়দ আহমেদ বলল, পাঠানদের মধ্যে অনেকেই নাচে। আমার মা একসময় নাচতেন। আমার জন্মের পরে মা নাচ ছেড়ে দিয়েছেন।
সৈয়দ আহমেদের সঙ্গে এক সন্ধ্যায় এলাম পাঠানি নাচ দেখতে। পাঠান ছেলেমেয়েদের নাচ দেখে তো অবাক হয়ে গেলাম। ওদের নাচ আঙুল বাঁকিয়ে মুদ্রা দেখানোর নাচ নয়, হাতের তলা উলটপালট করার নাচ নয়, পায়ের দোলায় ঘুঙুর বাজানোর নাচও নয়। দেখেছিলাম, পাঠান নৃত্য শিল্পীদের নাচের দাপটে মাটি কাঁপে, হাওয়া দোলে। এ নাচের নাম খটক নাচ।
নাচ শেষে একজন পাঠান যুবক এসে বলল, তোমাদের জন্য দুম্বার মাংস রান্না হয়েছে, খেয়ে দেয়ে আজকের রাতটি তোমরা এখানেই কাটাবে। সেই রাতের কথা আজও ভুলতে পারিনি। দুম্বার মাংসের সঙ্গে ছিল রুটি।
পাঠান পাড়ায় রাত কাটানোর পর সকালে ঘুম ভাঙতে অনেকটা দেঁড়ি হয়ে গেল। পরদিন সকালে নাস্তা করে আমি আর সৈয়দ আহমেদ হাতে হাত ধরে বেরিয়ে পড়লাম।