আপনি যদি উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে বসবাস করে থাকেন তাহলে ভাল ক্রেডিট স্কোরের গুরুত্ব সম্পর্কে নিশ্চয়ই অবগত আছেন। উন্নত বিশ্ব বলতে আমি বুঝিয়েছি প্রধানত ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং অষ্ট্রেলিয়া। এর বাইরে আরও কিছু দেশে ভোক্তার ক্রেডিট রেটিংকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে।ভারতেও ক্রেডিট রেটিংয়ের প্রচলন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মুলত উন্নত বিশ্বের যেসব দেশে প্রবাসী বাঙ্গালীদের আধিক্য আছে সেসব দেশকে বিবেচনায় নিয়েই এই প্রতিবেদনের তথ্যগুলো সন্নিবেশিত হয়েছে। ক্রেডিট স্কোর বাড়াবেন কীভাবে জানার আগে আমরা ক্রেডিট স্কোর কি তা জানা নিই।
ক্রেডিট স্কোর কি?
ক্রেডিট স্কোর বলতে সহজ ভাষায় যা বুঝায় তাহল আপনার বিশ্বস্ততা কিংবা নির্ভরযোগ্যতা। আপনাকে বাকিতে কোন কিছু বিক্রির আগে বিক্রেতা যেসব প্রধান বিষয়গুলো বিবেচনা করেন সেগুলোই মুলত ক্রেডিট রেটিং বা স্কোর। সাধারনত কেউ বাকিতে কিছু বিক্রি করতে গেলে আপনার সম্পর্কে একটু জেনে নিতে চাইবে। পাড়ায় কিংবা গ্রামের মুদি দোকানে সাধারনত প্রথম দিকে সকলেই বাকিতে কিছু না কিছু কিনে নিতে পারেন। কিন্তু সময়ের সাথে যারা বিক্রেতার পাওনা পরিশোধ করেন না বরং এড়িয়ে চলেন সেই ক্রেতাকে এর পরবর্তীতে আশে পাশের কেউ বাকিতে কিছু বিক্রি করবে না। কারন পাওনাদার সাধারনত আরও অনেককে বিষয়টি জানিয়ে রাখেন।
উন্নত বিশ্বে যেহেতু সব লেনদেনই অনলাইনে লিপিবদ্ধ হয় সেহেতু ভোক্তা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য জেনে নেয়াটা বাকিতে পণ্য কিংবা সেবা বিক্রেতার পক্ষে খুবই সহজ। ধরা যাক ব্যাংকে আপনার একটি একাউন্ট আছে। সেই একাউন্টে আপনার যেসব লেনদেন হচ্ছে সেটা ব্যাংক সংরক্ষণ করে রাখে। এখান থেকেই সাধারনত আপনার ক্রেডিট রেটিং শুরু হবে।
ব্যাংকে কারো একাউন্ট থাকলে সেই ব্যক্তি যদি ব্যাংক কাউন্টারে কোন দরকারে যান তাহলে অনেক সময় দেখা যায় ব্যাংকের সেবা প্রদানকারী ব্যাংকিং সেবা গ্রহীতাকে বিদায় জানানোর পূর্বক্ষণে ক্রেডিট কার্ড কিংবা লোন নেয়ার জন্য প্রস্তাব করেন। এর কারন হচ্ছে যাকে প্রস্তাব করা হচ্ছে তার ক্রেডিট রেটিং মোটামুটি (কিংবা অনেক) ভাল।
বিদেশে যারা নতুন এসেছেন:
কোন পাড়ায় যদি আপনি বাসা বদল করে নতুন অবস্থায় আসেন তাহলে সেই পাড়ায় প্রথম দিকে আপনি কিছুটা ভাল খাতির পাবেন। যেহেতু বিক্রেতা আপনার সম্পর্কে তেমন কিছু জানেন না। আবার কিছুটা সন্দেহের চোখেও দেখবেন। কারন লেনদেনে আপনার স্বচ্ছতা সম্পর্কে তার তেমন কোন ধারনা নেই।
যদি আপনি বিদেশে নতুন এসে থাকেন তাহলে এখানেও বিষয়টি একই রকম। আপনার ক্রেডিট স্কোর প্রথম দিকে কিছুই দেখাবে না। সেক্ষেত্রে আপনি প্রথম অবস্থায় বেশি কোন পণ্য বা সেবা নিতে পারবেন না। তবে আপনার ডকুমেন্টস অনুযায়ী আপনি সাধারন প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হবেন না। যেমন ব্যাংকে গেলে আপনি ব্যাংক একাউন্ট করতে পারবেন। কেউ কেউ হয়তো এক্ষেত্রে কিছুটা অভারড্রাফট সুবিধাও পেতে পারেন। তবে ক্রেডিট কার্ড কিংবা লোন পাবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। পেলেও সীমিত আকারে মিলবে।
ক্রেডিট স্কোর বাড়াবেন কীভাবে?
কিছু নিয়মতান্ত্রিক পন্থা অবলম্বন করে খুব সহজেই ক্রেডিট স্কোর বাড়ানো যায়। নীচে সংক্ষেপে কয়েকটি প্রধান সোপান তুলে ধরা হল।
(১) ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি:
প্রথমেই যা করতে হবে তা হল আপনি যদি ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না হয়ে থাকেন তাহলে অচিরেই সংশ্লিষ্ট এলাকায় তালিকভূক্ত হয়ে যান। বাকিতে পণ্য বা সেবা প্রদানের আগে বিক্রেতা আপনার ঠিকানা সম্পর্কে সম্পূর্ন ওয়াকিবহাল না হয়ে আপনাকে সুবিধা প্রদান করবেন না। সাধারণত ভোটার তালিকা বা ইলেক্টোরাল পুলে অন্তর্ভুক্ত হবার কয়েকমাস পরে তা ভোক্তার ক্রেডিট রেটিংয়ে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। ব্যাংকিং রেকর্ডের সাথে আপনার ক্রেডিট রেটিং সার্চে অন্যান্য যে সব সংশ্লিষ্টতা ডিজিটালি দেখা যায় তার মধ্যে ভোটার তালিকা ছাড়াও আছে ব্রডব্যান্ড,মোবাইল ফোন বিল, ইউটিলিটি বিল এবং বাকিতে ক্রয়কৃত অন্যান্য যেকোন পণ্য/সেবার তথ্যসমুহ।
(২) বকেয়া প্রদানের ডেটলাইন মিস না করা:
আপনার ক্রেডিট কার্ডের বকেয়া পরিশোধ, ঋণের কিস্তি, বিলের তারিখ এগুলো সবসময় নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিশোধ করতে হবে। ক্রেডিট কার্ডের বিল বড় হলে তাতে মিনিমাম অংক প্রদান করার সুযোগ নিন। কোন অবস্থাতেই বকেয়া প্রদানের সময়সীমা পার হতে দিবেন না। কারন নির্দিষ্ট সময়ের পর পরিশোধ করলে এমনিতেই অনেক ক্ষেত্রে জরিমানার বিধান রয়েছে।
আরও পড়ুন: ভাল ক্রেডিট স্কোর যেসব কারনে দরকার
(৩) একসাথে অনেকগুলো আবেদন না করা
বাকিতে একসাথে অনেকগুলো পণ্য বা সেবার জন্য আবেদন না করা। যদি কম সময়ের মধ্যে আপনি কয়েকটি ক্রেডিট কার্ড, ব্যাংক একাউন্ট এবং মোবাইলে ফোনের জন্য আবেদন করেন তাহলে আপনার ক্রেডিট স্কোর কমে যাবে এবং আবেদন অনুমোদন না পাবার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। পণ্য বা সেবা বিতরণকারী আপনার অনেকগুলো আবেদন একসাথে দেখে সন্দেহপ্রবণ হতে পারেন। তারা মনে করতে পারেন আপনি আর্থিক সংকটে আছেন। পরবর্তীতে কিস্তি পরিশোধে সক্ষম নাও হতে পারেন।
(৪) পণ্য বা সেবার জন্য নিয়মিত আবেদন করা
একবারে যেমন অনেকগুলো ক্রেডিট সুবিধার জন্য আবেদন করলে আপনার ক্রেডিট রেটিং ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমনি এসব সুবিধার জন্য আবেদন একবারে না করলেও আপনার ক্রেডিট স্কোর বাড়বে না। সেজন্য ক্রেডিট কার্ড কিংবা ঋণের মাধ্যমে নিয়মিত পণ্য বা সেবা ক্রয়ের মাধ্যমে আপনার ক্রেডিট স্কোর বৃদ্ধি পাবে। বিক্রেতা দেখবেন আপনি টাকা পরিশোধে ধারাবাহিক যেহেতু আপনি নিয়মিত ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করছেন এবং নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যেই কিস্তি পরিশোধ করছেন।
(৫) পরিশোধের সক্ষমতা অনুযায়ী আবেদন করা:
ক্রেডিটে কোন সেবা বা পণ্য কেনার আগে সেটার দাম পরিশোধের সক্ষমতা আপনার আছে কীনা আগে দেখে নিন। যদি আপনার বেতন ও অন্যান্য আয় অনুযায়ী আপনি যা কিনবেন সেটার মূল্য পরিশোধের সক্ষমতা না থাকলে আপনার আবেদন প্রত্যাখ্যাত হতে পারে। সেক্ষেত্রে আপনার ক্রেডিট স্কোর কমবে।
(৬) বড় অংকের বকেয়া পরিশোধ করুন
ক্রেডিট কার্ড কিংবা ঋণের বকেয়া যদি বড় অংকের হয়ে থাকে তাহলে সেটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পরিশোধ করুন। কারন এগুলো যত দীর্ঘ্য সময় অনাদায়ী থাকবে আপনার প্রদেয় সুদের পরিমান ততই বৃদ্ধি পাবে।
(৭) ক্রেডিট কার্ড কিংবা ঋণের পরিমান কম রাখুন
বাকিতে পণ্য বা সেবা খরিদ করলে আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে আপনাকে প্রদত্ত পরিমানের সীমা থেকে সর্বোচ্চ ৩০ ভাগের বেশি যেন ব্যবহৃত না হয়। যেহেতু আপনার লেনদেন ডিজিটালি সংরক্ষিত হচ্ছে এবং সেই তথ্যগুলো ব্যাংক ও অন্যান্য এজেন্সীগুলো সেটা দেখার জন্য অনুমোদন প্রাপ্ত। তারা দেখবে আপনি মিতব্যয়ী কীনা এবং ক্রেডিট ব্যবহারের জন্য মুখিয়ে থাকেন কীনা।
(৮) নিয়মিত ক্রেডিট রিপোর্ট দেখুন
আপনার ক্রেডিট রিপোর্ট নিয়মিত দেখার মাধ্যমে জেনে নিতে পারবেন আপনি কোন অবস্থানে আছেন। যদি স্কোর কম হয়ে থাকে তাহলে এর কারন অনুসন্ধান করুন এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিন। আর বড় অংকের ঋণ কিংবা মর্টগেজ অথবা প্রিমিয়াম ক্রেডিট কার্ডের জন্য আবেদন করার আগে আপনার ক্রেডিট রেটিং অবশ্যই চেক করে নিবেন। যদি ক্রেডিট স্কোর কম থাকে তাহলে আবেদন না করে ক্রেডিট রেটিং বাড়িয়ে নিন। তাহলে আপনার আবেদন প্রত্যাখ্যাত হবার সম্ভাবনা কমে যাবে।