ব্রিসবেন টেষ্ট। শেষ বিকেলে মরণকামড় দিয়েছে ভারত। এই মাঠে ৩২ বছর ধরে অপরাজিত ছিল অষ্ট্রেলিয়া। সেই রেকর্ড ধুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে ভারত। অষ্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছে ৩ উইকেটের ব্যবধানে। ভারতের চোখ ধাঁধানো এই জয় ক্রিকেট বিশ্বের সম্পুর্ণ মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে।
পিছিয়ে পড়েও ২-১ ব্যবধানে সিরিজ জয়! তাও অষ্ট্রেলিয়ার মাঠিতে! সামাজিক মাধ্যমে ভারতীয় দলের সাফল্যের স্তূতি বন্ধনা চলছে বিরামহীনভাবে। খ্যাতিমান ধারাভাষ্যকার, প্রাক্তন ক্রিকেটার এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা ভারতের সাফল্যের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
শোচনীয় পরাজয়ে সিরিজে সূচনা ভারতের
চার টেষ্ট ম্যাচের সিরিজে প্রথম ম্যাচের প্রথম ইনিংস । ভারত এক লজ্জাজনক ইতিহাসের মুখোমুখি হয়। অষ্ট্রেলিয়ার দুর্দান্ত পেস বোলিং আক্রমণের সামনে ভারতীয় দলের বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানরা দাঁড়াতেই পারেননি। প্রথম ইনিংসে মাত্র ৩৬ রানের বিনিময়ে অলআউট হয়ে নিজেদের সর্বনিম্ন রানের এক রেকর্ড গড়ে ভারত। স্বভাবতই সেই টেষ্টে শোচনীয়ভাবে পরাভূত হয় ভারতীয় দল। চারদিকে সমালোচনা শুরু হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এ নিয়ে শুরু হয় অনেক ট্রল। হাসাহাসির হিড়িক পড়ে যায় সবখানে।
যেভাবে ঘুরে দাঁড়াল ভারত
দ্বিতীয় টেষ্টেই ঘুরে দাঁড়ায় ভারত। যেন প্রথম টেষ্টের শোচনীয় পরাজয়ের লজ্জা ঢাকার পণ নিয়েই দ্বিতীয় টেষ্ট খেলতে নেমেছিলেন ভারতীয় দল। বোলারদের চোয়ালবদ্ধ নৈপুন্যের প্রদর্শনী । এর সুবাধে অষ্ট্রেলিয়া দল কে দুই ইনিংসেই দুইশ রানের মধ্যে আটকে রাখে ভারত।
নিজেদের মাঠিতে অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানরা ব্যর্থ হন ভারতীয় বোলারদের স্পিরিটের কাছে মাথা নোয়াতে। প্রথম ইনিংসে ১৯৫ রানের সাথে দ্বিতীয় ইনিংসে দুইশ রানে পাততাড়ি গুটায় ক্যাঙারু বাহিনী। ফলে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের জন্য জয়ের কাজটি সেরে নেয়া অনেক সহজ হয়ে যায়। ৮ উইকেটের বিশাল ব্যবধানে অষ্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে সিরিজে ফেরে ভারতীয় দল।
সেয়ানে সেয়ানে লড়াই তৃতীয় টেষ্টে
সিরিজের তৃতীয় টেষ্টে দুইপক্ষের লড়াই ছিল অনেকটা রয়েসয়ে। দুইপক্ষই পরষ্পরের শক্তিমত্তা বিচার করে খেলেছেন। অনেকটা সেয়ানে সেয়ানে লড়াইয়ের মত। প্রথম ষ্ট্রাটেজীই ছিল কোন অবস্থাতেই হারা চলবে না। অষ্ট্রেলিয়া অনেক আক্রমনাত্মক খেলা প্রদর্শন করেছে। এক্ষেত্রে ভারতীয় দলের কৌশল ছিল শম্ভুক গতিতে এগিয়ে চলা। প্রথম ইনিংসে অষ্ট্রেলিয়া ১০৫.৪ ওভার ব্যাটিং করে সংগ্রহ করে ৩৩৮ রান। সেই তুলনায় ভারতের সংগ্রহ ছিল ১০০.৪ ওভারে ২৪৪ রান। অর্থাৎ মাত্র ৫ ওভার কম খেললেও অষ্ট্রেলিয়ার সাথে ভারতের রানের ব্যবধান ছিল ৯৪।
ভারতের কৌশল ছিল উইকেটে মাটি কামড়ে পড়ে থাকা। দ্বিতীয় ইনিংসে অষ্ট্রেলিয়া জয়ের জন্য তড়িঘড়ি করে খেলে ৮৭ ওভার ব্যাটিং করে । ৬ উইকেটে ৩১২ রানে ইনিংস ডিক্লেয়ার করে । ৪০৭ রানের টার্গেট দেয় ভারতকে। কিন্তু ভারত সেই লক্ষ্যে না ধেয়ে ১৩১ ওভারে ৩৩৪ রান করে ৫ উইকেট হারিয়ে।
দ্বিতীয় ইনিংসে অষ্ট্রেলিয়ার রান তোলার গড় ছিল ৩.৫৮ । ভারতীয় দলের গড় ছিল ২.৫৪। যুদ্ধে জিততে হলে শুধু সম্মুখ সমরে কাজ হয় না । মস্তিষ্ককেও কাজে লাগাতে হয়। ভারতীয় দলে আছেন একজন ম্যানেজার, রবিশাস্ত্রী। তুখোড় ক্রিকেট মস্তিষ্ক। যার তুলনা সমসাময়িক ক্রিকেট বিশ্বে বিরল!
ভারতীয় দলের অবিশ্বাস্য সিরিজ জয়
শেষ টেষ্ট দুই দলের জন্যই খোলা চ্যালেন্জ ছিল সিরিজ জিতে নেয়ার। এর মধ্যে ভারতীয় দলের জন্য কাজটি ছিল অত্যন্ত কঠিন। নিয়মিত একাদশের বেশিরভাগ সদস্যই ইনজুরি আক্রান্ত হয়ে খেলার জন্য ফিট ছিলেন না। তাই এক রকম আনকোরা, নবীন এবং অনিয়মিত একাদশ নিয়েই দল সাজাতে হয় ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্টকে। এই দলটির প্রতি কারোরই খুব বড় প্রত্যাশা ছিল না। ভাল খেলে নিদেন পক্ষে ড্র এবং সিরিজ অমীমাংসিত রেখে দেশে ফেরা। কিংবা হারলেও সম্মানজনক পরাজয়।
প্রথম ইনিংসে ভারতীয় দলের ব্যাটিং বিপর্যয়ের মধ্যেও টেষ্টে নিতান্তই ভাগ্যক্রমে সুযোগ পাওয়া ওয়াসিংটন সুন্দর এবং শার্দুল ঠাকুর দুর্দান্ত খেলে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেন। ১৮৬ রানে শেষ স্বীকৃত ব্যাটসম্যান রিষভ পন্ত বিদায় নিলে এই দুই নবীন দলের রান ৩০৯ এ নিয়ে যান। শেষ পর্যন্ত ৩৩৬ রান করে ভারত। প্রথম ইনিংসে অষ্ট্রেলিয়ার সংগ্রহ ছিল ৩৬৯ রান। দ্বিতীয় ইনিংসে ২৯৪ রানে অষ্ট্রেলিয়া আউট হলে ভারতের সামনে টার্গেট ছিল ৩২৮ রানের।
আরও পড়ুন:সাকিব আল হাসান: ক্ষুরধার ক্রিকেটীয় মস্তিষ্কই কী তাঁর সবচেয়ে বড় অস্ত্র?
জয়ের লক্ষ্যে অনেক ছক কষে মাঠে নেমেছিল ভারত। অভিজ্ঞ রোহিত শর্মা ৭ রানেই ফিরে যান। ভারতীয় দলে তিনে রাহুল দ্রাবিড়ের যোগ্য উত্তরসূরী চেতেশ্বর পূজারা একপ্রান্ত আগলে রেখে ২১১ বলে করেন ৫৬ রান। উইকেট পড়তে না দেয়ার এই কৌশল কাজে লাগে। অন্য প্রান্তে শুভম্যান গিল এবং আজিন্কা রাহানে রানের গতি বাড়িয়ে নেন। এরপর অন্যতম প্রধান কাজটি করেন রিষভ প্যান্ট। ওয়ানডে ষ্টাইলে ব্যাট করে ১৩৮ বলে করেন ৮৯ রান। এর আগে গিল করেন ১৪৬ বলে ৯১ রান।
শেষ পর্যন্ত তিন উইকেট হাতে রেখেই ভারতীয় দল পৌঁছে যায় ৩২৯ রানের লক্ষ্যমাত্রায়। দূর্দান্ত ব্যাটিংয়ের জন্য ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার পান রিষভ প্যান্ট। ভারতের টি-টুয়েন্টি দল এবং আইপিএলের এই দুই তরুন ব্যাটসম্যানদ্বয় শেষ পর্যন্ত টেষ্টেও দারুন পরিণত ব্যাটিংয়ের ঝলক দেখিয়েছেন। তাদের নৈপুন্যেই অষ্ট্রেলিয়ার দর্প চূর্ণ হয়ে যায়।