কুন্দনলাল সায়গল: অবিস্মরণীয় তারকা অমরকন্ঠ যার


অমর কণ্ঠ কুন্দনলাল সায়গল অভিনীত ‘দেবদাস’, ‘দিদি’, ‘জীবনমরণ’, ‘পরিচয়’, ‘সাথী ‘, ‘তানসেন’, ‘শাহজাহান’, ‘লগন’, ‘স্ট্রিট সিঙ্গার’, ‘প্রেসিডেন্ট’ প্রভৃতি ছবির কথা এখনো অনেকের মনে থাকার কথা । ছবিতে ¯স্বকণ্ঠে গান গাইতেন তিনি। মাত্র ৪৩ বছর বয়সে এই শিল্পীর মহাপ্রয়াণ ঘটেছিল। ত্রিশের দশকে কুন্দনলাল সায়গলকে একনজর দেখবার জন্য দর্শকের কত হা-হুতাশ, কত উচ্ছ্বাস ছিল। আজ সে-সব শুধুই ধূসর স্মৃতি। লিখেছেন দুই বাংলার অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র ও ভ্রমণ লেখক লিয়াকত হোসেন খোকন

Table of Contents

অমরকন্ঠ –

কুন্দনলাল সায়গলের কণ্ঠকে বলা হয় ‘অমর কণ্ঠ’। শ্রীলঙ্কা ব্রডকাস্টিং-এ প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে সাড়ে আটটা পর্যন্ত পুরোনো দিনের হিন্দি গানের যে অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয় সেখানে সবশেষে সায়গলের গান দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ করা হতো একসময়। আমরা অধীর আগ্রহ সহকারে সেই গান শুনতাম । প্রতিবছর সায়গল স্মরণসভা হয়। তাঁর নামে অভিনেতা এবং সংগীতশিল্পীদেরকে এখনো পুরস্কার দেওয়ার প্রচলন রয়েছে। ‘শুনি ডাকে, কে মোরে ডাকে’, ‘প্রেম নহে মোর মৃদু ফুল হার দিল সে দহন জ্বালা’, ‘গোলাপ হয়ে উঠুক ফুটে তোমার রাঙা কপোলখানি’, ‘যখন রব না আমি’, ‘দুঃখকে অবদিন’, ‘বালম আয়ো বসো মেরে মনমে’, ‘সোজা রাজকুমারী’ সহ অসংখ্য হিন্দি ও বাংলা গানের মাধ্যমে কুন্দনলাল সায়গল চিরকাল বেঁচে থাকবেন। ১৯৪৭ সালের ১৮ই জানুয়ারি পাঞ্জাবের জলন্ধরে তিনি মারা যান।

জন্ম ও শৈশব –

১৯০৪ সালের ১১ই এপ্রিল জম্মুতে কুন্দনলাল সায়গলের জন্ম। শৈশব থেকেই আপনমনে গান গাইতেন। গানের ব্যাপারে কারো কাছে তালিম বা শিক্ষা নেননি তিনি। অনেক প্রচেষ্টা করেও বোম্বে কিংবা লাহোর রেডিয়োতে গান গাওয়ার সুযোগ পাননি।

অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করে চাকরিতে প্রথম ঢুকলেন দিল্লির পিডব্লিউডির ইলেকট্রিসিটিতে। কয়েক মাস চাকরি করে এটি ছেড়ে নর্থ ওয়েস্টার্ন রেলওয়েতে ঢুকলেন। এ চাকরিও বেশিদিন করেননি। কয়েক মাস বেকার থাকার পরে ১৯২৯ সালে রেমিংটন টাইপরাইটার কোম্পানির সেলসম্যানের পদে চাকরি নেন। পোস্টিং হলো কলকাতায়।

রেকর্ডে ও রেডিওতে গান গাওয়া শুরু –

হঠাৎ করে পরিচয় ঘটল নিউ থিয়েটার্স-এর সুরকার রাই চাঁদ বড়ালের সঙ্গে। সায়গলের গান শুনে তিনি মুগ্ধ হলেন। স্বভাবত সায়গলের জীবনে আরেকবার পেশার পরিবর্তন হলো। সেলসম্যান থেকে তিনি অল্পদিন পরেই হলেন গায়ক-অভিনেতা। ১৯৩০ সালে আকাশবাণী কলকাতায় অডিশন দিলেন। অডিশনে উত্তীর্ণ হয়ে আকাশবাণী কলকাতায় নিয়মিত গান গাইতে শুরু করলেন। প্রথম রেকর্ডকৃত গান হলো – ‘ঝুল না ঝুলাওরে…।’ এটি ১৯৩২ সালে হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি থেকে রেকর্ড হয়। ১৯৩২ সালে কুন্দনলাল সায়গলের পেশার পরিবর্তন হলো। হরিশচন্দ্র বালি ও রাই চাঁদ বড়ালের অকুণ্ঠ সাহায্য ও সহযোগিতায় হলেন গায়ক-অভিনেতা।

দেবদাস ও চন্ডীদাস –

‘দেবদাস’-এ নাম-ভূমিকায় অভিনয় করে খ্যাতির তুঙ্গে ওঠেন। তিনি সাজলেন দেবদাস, যমুনা দেবী সাজলেন পার্বতী। ‘দেবদাস’ ছবিতে ‘বালম আয়ো বসো মেরে মনমে’ এবং ‘দুঃখকে অবদিন বীতত নেহি’ গান দু-খানি গেয়েও উপমহাদেশের দর্শকদের মন ভোলালেন কুন্দনলাল সায়গল। সে বছরই হিন্দি ‘চণ্ডীদাস’-এ উমাশশীর বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন তিনি।

নিউ থিয়েটার্সের ছবিতে –

সায়গলের অভিনয় ও গানে নিউ থিয়েটার্সের অনেক ছবি সাফল্যের শীর্ষে উঠেছিল সেদিন। তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য বাংলা ছবি হলো –  ‘দিদি’ (১৯৩৭), ‘দেশের মাটি’ (১৯৩৮), ‘সাথি’ (১৯৩৮), ‘জীবনমরণ’ (১৯৩৯), ‘পরিচয়’ (১৯৪১) প্রভৃতি। কলকাতায় থাকাকালীন হিন্দিতে, যেমন –  ‘দেবদাস’ (১৯৩৫), ‘চণ্ডীদাস’ (১৯৩৫), ‘ধরতিমাতা’ (১৯৩৬), ‘দুষমন’ (১৯৩৯), ‘স্ট্রিট সিঙ্গার’ (১৯৩৯), ‘ক্রোড়পতি’, ‘প্রেসিডেন্ট’, ‘পূজারি’, ‘ডাকু মনসুর’, ‘ধূপ ছাঁও’, ‘কারওয়ান-এ-হায়াত’, ‘ইহুদি কি লড়কি’ প্রভৃতিতে সায়গল অভিনয় করেন। এসব ছবিতে তাঁর গাওয়া গানগুলো অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল।

সায়গলের গান –

বহুদিন যাবৎ শ্রোতাদের মুখে মুখে ফিরেছে সে-সব গান। সায়গলের গাওয়া –  ‘আহা স্বপন দেখি’, ‘ঝুমুর ঝুমুর নূপুর বাজে’, ‘রাজার কুমার পঙ্খিরাজে , আবার যে রে রং ফিরেছে ধুলার ধরণিতে’, ‘বাঁধিনু মিছে ঘর ভুলের বালুচরে’, ‘ছায়াঘেরা ঐ পল্লি ডাকিছে মায়ের মতন করে; ‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম গান’; ‘এ গান তোমার শেষ করে দাও’ প্রভৃতি এখনো অসম্ভব জনপ্রিয়।

সায়গল – লীলা দেশাই জুটি –

এখনো অনেকের মনে দাগ কাটে ‘জীবনমরণ’-এ মোহনের ভূমিকায় সায়গলের অভিনয়ের কথা।‘জীবনমরণ’ ছবিতে সায়গলের যক্ষা হয়েছিল। এ ছবিতে তিনি গেয়েছিলেন –  ‘শুনি ডাকে কে মোরে ডাকে, তারার হৃদয় আঁখিজল, কে নিয়েছে বুকে করে আমারে…’। ‘জীবনমরণ’-এ তাঁর নায়িকা ছিলেন লীলা দেশাই। সায়গল-লীলা দেশাই জুটির ‘জীবনমরণ, ‘দিদি’, ‘প্রেসিডেন্ট’ প্রভৃতি সফল হয়েছিল তখন।

সায়গল – কাননবালা জুটি –

কানন দেবীর বিপরীতে ‘সাথি’, ‘পরিচয়’, ‘স্ট্রিট সিঙ্গার’ আর ‘লগন’-এ অভিনয় করেন ত্রিশের দশকে। সে যুগে ‘কানন-সায়গল’ জুটির কথা মানুষের মুখে মুখে ফিরত। ‘সাথী ‘ ছবিটিও প্রথম সফল হয়েছিল।  ‘পরিচয়’ ছবিতে সায়গল ‘কবি’সেজেছিলেন। এ ছবিতেই সায়গল গান শিখাতেন কানন দেবীকে। তাকে না-পাওয়ার বেদনা বার বার হৃদয়ে এসে হোঁচট খেতো। আর তাই তো সায়গল গেয়েছিলেন – ‘যখন রব না আমি দিন হলে অবসান, আমারে ভুলিয়া যেয়ো মনে রেখো মোর গান…’।

বোম্বের ছবিতে –

১৯৪৩ সালে সায়গল কলকাতা ছেড়ে বোম্বেতে চলে যান। সেখানে প্রথম ‘তানসেন’ ছবিতে অভিনয় করেন ও কণ্ঠ দেন। ‘তানসেন’-এ তাঁর নায়িকা ছিলেন খুরশিদ। ছবিতে এরা একত্রে গানও করেছিলেন। এই জুটি সেদিন অসম্ভব খ্যাতি পেয়েছিল। ‘ভক্ত সুরদাস’ (১৯৪৪) এবং ‘শাহজাহান’ (১৯৪৫) ছবি দুটিতে এরা একত্রে অভিনয়ও করেছিলেন। বোম্বেতে সায়গল অভিনীত আরও উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে কয়েকটি হলো-  তদবির,  ওমর খৈয়াম, পরোয়ানা প্রভৃতি। ‘পরোয়ানা’ ছবিতে তাঁর নায়িকা ছিলেন সুরাইয়া।

মদ্য পান শুরু –

১৯৩০ এর দশকের ছবি ‘ভাগ্যচক্র’তে নায়ক হওয়ার কথা ছিল সায়গলের। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এ ছবি থেকে সায়গলকে বাদ দিয়ে নীতিন বসু পাহাড়ি সান্যালকে নেন। এজন্য সায়গল ভীষণ দুঃখ পেয়েছিলেন। দুঃখ ভুলে থাকার জন্য তিনি মদপান শুরু করলেন। ক্রমে তাঁর জীবনটা উচ্ছৃঙ্খল হতে থাকে।

জব দিল হি টুট গয়া –

অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে মাত্র ৪১ বছর বয়সে তাঁর লিভার নষ্ট হয়ে যায়। দীর্ঘ দু’বছর লিভার অব সিরোসিসে ভোগার পর ১৯৪৭ সালের ১৮ জানুয়ারি তিনি জলন্ধরে নিজ বাসভবনে পরলোকগমন করেন। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৩ বছর। জানা যায় , কুন্দনলাল সায়গলের মরদেহ জলন্ধরের শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার পথে আর দেহ ভস্মীভূত হওয়া পর্যন্ত বারবার – ‘জব দিল হি টুট গয়া’ গানখানি রেকর্ড থেকে মাইকে বাজানো হয়েছিল ।।

কুন্দনলাল সায়গলের গান আজও জনপ্রিয় –

কুন্দনলাল সায়গল জীবিত থাকাকালীন রাস্তাঘাটে কোথাও বের হলে দর্শক ভক্তের ভিড় উপচে পড়ত। স্টুডিয়োর সম্মুখে এত দর্শক দাঁড়িয়ে থাকত, ওদের একটিই ইচ্ছা ছিল সায়গলকে একনজর দেখা। সেদিন অনেক আগেই ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু সায়গলের গান আজও শেষ হয়ে যায়নি। এ প্রজন্মের কণ্ঠশিল্পীরাও ‘হারানো দিনের গানে’ কুন্দনলাল সায়গলের গান গেয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করছেন।

কন্ঠে ছিলো জাদু –

সংগীত-বিশ্লেষকরা সায়গলের সংগীতশিল্পকে জার্মানির স্থপতিবিদ ওয়াল্টার গোরো পিয়াসের স্থপতিশিল্পের সঙ্গে তুলনা করেছেন। আবার তাঁর অভিনয়শিল্পকে অনেকে রেলগাড়ির সময়-নির্ধারকের সঙ্গে তুলনা দিয়েছেন। রেলগাড়ি যেভাবে সময় মেনে চলত, সায়গলও ঠিক তেমনি সময় মেনে চলতেন। বিগত দিনের নায়িকা-গায়িকা খুরশিদ একবার  বলেছিলেন, ‘সায়গল যখন গান গাইতেন তখন তাঁর ফুসফুসের প্রতিটি জিনিস ব্যয় করতেন। তার গলায় এমন জাদু ছিল যে, তাকে অনুকরণ করতে গিয়েও কেউ পারেননি।’

আরও পড়ুন: সঞ্জীবনী সুধায় কঙ্কাবতীর ঘাট থেকে উত্তম কুমারের যাত্রা হল শুরু

কুন্দনলাল সায়গলের গান – ‘এখনি উঠিবে চাঁদ আধো আলো আধো ছায়াতে, / কাছে এসে প্রিয় হাতখানি রাখো হাতে ।/ এখনি জাগিবে ভীরু চামেলি / জোছনায় নয়ন মেলি / ফিরিবে কপোত নীড়ে প্রিয় পাশে তরুশাখাতে । /

হেরো  গোধূলি আকাশে জ্বলে দুটি তারা পথহারা /গত জনমের যেন ছিনু মোরা দুটি তারা / এ মায়া গোধূলি তীরে প্রিয় / চিরদিন মনে রাখিয়ো / যত কথা  যত গান ডুবে যাক ভালোবাসাতে’  কিম্বা ‘গোলাপ হয়ে উঠুক ফুটে তোমার রাঙা কপোলখানি, / ভোমরা সম গুণগুনিয়ে শুনিয়ে যাব প্রণয় বাণী। / একটু তোমার পরশ লাগি / পরাণ আমার হয় বিবাগী, / পিয়াস জাগায় অধর তব, দেয় কামনার খবর আনি। / কুঁড়ির বুকে গন্ধ যেমন কাঁদে সমীর মিলন তরে -/

তোমায় যাচি বাসনা মোর আকুল আশায় কেঁদে মরে। /

প্রেম যদি না দিলে প্রাণে / আসব তবে কীসের টানে, /

তবু কেন চোখের কোণে হাসির খেলা নাহি জানি’ – দেবদাস ছবির এ গান আজও আমরা ভুলতে পারিনি। সে ঘোর আজও কাটেনি।