ইউরোপ মহাদেশের দীর্ঘতম নদী হল ভলগা। এটি রাশিয়ার মধ্য দিয়ে বয়ে অবশেষে কাস্পিয়ান সাগরে গিয়ে পতিত হয়েছে। নদীটির দুই তীরে রয়েছে বনজঙ্গল। রাশিয়ার দশটি বৃহত্তম শহরের মধ্যে চারটি ভলগার ড্রেনেজ অববাহিকায় অবস্থিত। আবার পৃথিবীর বৃহত্তম জলাধারগুলির মধ্যে কয়েকটি ভলগা নদীর তীরে অবস্থিত। রুশ সংস্কৃতিতে নদীটির বেশ গুরুত্ব রয়েছে। রাশিয়ার কবি -সাহিত্যিকরা এই ভলগাকে নিয়ে যুগে যুগে লিখেছেন কবিতা, গান, রচনা, উপন্যাস -গল্প।
রাশিয়ান হাইড্রোনিম ভলগা প্রোটো -স্লাভিক ভলগা – ওয়েটনেস, ময়েশ্চার নাম থেকে এসেছে, যা অনেক স্লাভিক ভাষায় সংরক্ষিত রয়েছে, তা হল – ডেলাগা আর্দ্রতা, চেক আর্দ্রতা, সার্বো ক্রোয়েশিয়ান – ডেলাগা আর্দ্রতা, পোলিশ উইলগোচ আর্দ্রতা, ম্যাসিডোনিয়ান ডেলাগা আর্দ্রতা – ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ভলগার সিথিয়ান নাম ছিল রাহা, এর আক্ষরিক অর্থ হলো ‘ভেজা’।
একদা ভলগা নদীর তীরে বসবাসকারী তুর্কী জনগণ এই নদীকে বলত, ইতিল বা আতিল। আধুনিক তুর্কী ভাষায় এর নাম ভলগা তাতারে, চুবাসে, বাশকিরে আইজেল। কাজাখ ভাষায় এর নাম এডিল।
লাটভিয়ান ভলকা অনুসারে, এর অর্থ অতিবৃদ্ধ নদী। এই নদীর তীরে প্রাচীনকালে প্রথম বসতি স্থাপন শুরু করেছিল বাল্টরা উপজাতিরা।
ভালদাই পাহাড়ে একটি ছোট ভূগর্ভস্থ ঝর্ণা
থেকে উৎপন্ন হয়েছে এ নদীটি। যা টোভার অঞ্চলের ভলগোভারখোভি গ্রামের কাছে বীট করে, তারপর উপরের ভলগা জলধারে একত্রিত হ্রদের একটি সিস্টেমের মধ্য দিয়ে চলাচল করেছে। ভলগার পাশে প্রথম বসতি স্থান হলো রাজেভ শহরটি। এটি ভলগার উৎস থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এর পিছনে শুরু হয় নদীর নাব্য অঞ্চল।
ভলগার প্রথম ঘাটটি হল স্টারিসা শহর, যা ১২৯৭ খৃষ্টাব্দে তাভেরের প্রিন্স মিখাইল ইয়ারোস্লাভিচ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই স্থানগুলির প্রধান আকর্ষণ হল পবিত্র হনুমান মঠ। এটি ১২ শতকের শুরুতে কিয়েভ পেচেরস্ক ও লাভরার নামে দুই সন্ন্যাসী দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
ভলগা রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ, ভলগা লেক স্টারজ, টেভার, দুবনা, রাইবিনস্ক, ইয়ারোস্লাভ, নিঝনি নোভগোরড এবং কাজানের পাশ হয়ে পূর্ব দিকে চলে গেছে। সেখান থেকে নদীটি দক্ষিণে মোড় নিয়ে উলিয়ানভস্ক, টলিয়াত্তি, সামারা, সারাতোড এবং ভলগোগ্রাদ অতিক্রম করে কাস্পিয়ান সাগরে প্রবাহিত হয়ে সমুদ্রের দিকে চলে গেছে।
ভলগার অনেক উপনদী রয়েছে, আনুমানিক এর সংখ্যা ২০০ টির মতো। যার মধ্যে সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ হল কামা, ওকা, উনঝা, কেরঝেনেটস, টাভার্টসা, মেদভেদিসা, ভেটলুগা, সুরা এবং অন্যান্য। এখানে বেশির ভাগ নদীর প্রবাহের দিক উত্তর থেকে দক্ষিণমুখী।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, ভলগা মানুষকে পরিস্কার পানি, মাছ ও পরিবহন ধমনীর উৎস হিসেবে পরিবেশন করে যাচ্ছে। প্রায় শত প্রজাতির মাছ এই নদীর পানিতে বাস করে – এরমধ্যে অনেক প্রজাতির মাছ বাণিজ্যিক, যা কিনা বিদেশে রপ্তানি পর্যন্ত করা হয়।
সবচেয়ে সৌভাগ্যের কথা, রাশানরা দেশকে ভালবাসে, প্রকৃতিকে ভালবাসে বলে এরা কেউ নদী ভরাট করে না, নদীর চর দখলে নেয় না। যে জন্য ভলগা নদীর পানি কখনও কালো রং ধারণ করে না।
ভলগা হল পৃথিবীর দীর্ঘতম নদীগুলির মধ্যে ১৬ তম স্থান দখল করে আছে। এই নদীর দুই তীরে বিশ্রাম এবং বেড়ানোর জন্য চমৎকার জায়গা।
ভলগা নদীর দৈর্ঘ্য ৩,৫৩১ কিলোমিটার এবং এর নিষ্কাশন অবস্থান হল ১৩,৯১,২৭২ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে। এটি রাশিয়ার জাতীয় নদী হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। ঐতিহাসিকভাবে ভলগা ইউরোপীয় সভ্যতার মিলনস্থল হিসেবে কাজ করে আসছে।
ভলগা নদীর পানি থেকে উৎপন্ন হয়েছে জলবিদ্যুৎ –
যা কিনা রাশিয়ার বেশির ভাগ অঞ্চলে সরবরাহ করে থাকে। মস্কো খাল, ভলগা -ডন খাল এবং ভলগা – বাল্টিক পানিপথ মস্কোকে শ্বেত সাগর, বাল্টিক সাগর, কাস্পিয়ান সাগর, আজভ সাগর এবং কৃষ্ণ সাগরের সাথে সংযোগকারী নৌপথ তৈরিতে করেছে।
ভলগার বদৌলতে নদী তীরবর্তী উপত্যকায় প্রচুর পরিমাণে গম উৎপন্ন হচ্ছে। এছাড়া ভলগার পাশে রয়েছে খনিজ সম্পদ, পেট্রোলিয়াম শিল্প কেন্দ্র। অন্যান্য সম্পদের মধ্যে রয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাস, লবণ এবং পটাশ শিল্প। আবার ভলগা মাছ ধরার জন্য বিখ্যাত স্থান।
ভলগার তীরে অবস্থিত বড় বড় শহরগুলি হল – কাজান, নিজনি নভগ্রোড, সামারা, ভলগোগ্রাদ, সারাতোভ, টলিয়াত্তি, ইয়ারোস্লাভল, আস্ট্রখান, উলিয়ানভস্ক, চেবোক্সারি, তভের।
ভলগার স্রোত হল মস্কোতে নিরবিচ্ছিন্ন পানি সরবরাহের প্রধান উৎস – ইভানকোভস্কয় জলধারা যেখানে একটি বাঁধ এবং একটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। এটি দুবনার বিজ্ঞান শহরের কাছে নির্মিত হয়েছে। পারমাণবিক পদার্থ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গবেষণার জন্য এটি রাশিয়ার বৃহত্তম কেন্দ্র। ইভানকোভস্ক শহরটি ভলগায় অবস্থিত মস্কো অঞ্চলের একমাত্র বসতি।
রাশিয়ার প্রিয় প্রতীক শক্তিশালী মা -ভলগা নদী। এক কথায়, রাশিয়ার প্রাণ। এই নদীটি নিয়েই শতাব্দী ধরে গান ও কবিতা রচিত হয়েছিল, যা সম্পূর্ণভাবে মহিমান্বিত এবং গৌরবান্বিত করে চলেছে রাশিয়াকে।
আরও পড়ুন: সবাইকে কাছে টানে জলপ্রপাত
বিলাসহুল ও স্বর্ণ ব্যবসার কেন্দ্রস্থল দুবাই