মেসির ফুটবল ইমেজকে ঘিরে আর্জেন্টিনার ব্যাপক পরিচিতি হলেও দেশটি মূলত: কৃষিপ্রধান। আর্জেন্টিনার জানা অজানা বিষয় নিয়ে লিখেছেন দুই বাংলার অন্যতম সেরা ভ্রমণ লেখক লিয়াকত হোসেন খোকন
Table of Contents
আর্জেন্টিনা দেশটি দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশে অবস্থিত। ফুটবল খেলোয়াড় লিওনেল মেসির নামে আজ আর্জেন্টিনা দেশটির নামে সবাই জানে।
বুয়েনোস আইরেস দেশটির বৃহত্তম শহর ও রাজধানী। আর্জেন্টিনা দেশটি দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ অংশের প্রায় পুরোটা জুড়ে অবস্থিত। আয়তনের দিক থেকে আর্জেন্টিনা দক্ষিণ আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম রাষ্ট্র। বিশ্বকাপে ফুটবল খেলায় এই দেশটির যথেষ্ট খ্যাতি ছড়িয়ে রয়েছে বিশ্বজুড়ে।
আর্জেন্টিনার দর্শনীয় স্থান হল – কুয়েব্রাদা দে হুমাহুয়াকা – এ হল সাতটি রঙের পাহাড়। কুয়েব্রাদা দে হুমাহুয়াকা পাহাড় আর্জেন্টিনার জুজুই রাজ্যে অবস্থিত। এটিকে বলা হয় চিত্রানুগ সংকীর্ণ উপত্যকা। এটি আর্জেন্টিনার পশ্চিমে ও উত্তরে আলতিপ্লানো, পূর্বে আন্ডিজ পাহাড় এবং দক্ষিণে ভ্যালেস টেমপ্ল্যাদোস দ্বারা পরিবেষ্টিত। এখানের মাইমারা গ্রাম থেকে গ্র্যান্ডে নদী দেখা যায়। গ্র্যান্ডে নদী শীতকালে শুষ্ক থাকে কিন্তু গ্রীষ্মকালে কানায় কানায় জলে পরিপূর্ণ হয়ে যায়।
আর্জেন্টিনা -ব্রাজিল সীমারেখায় মিলিত হয়েছে ইগুয়াচ্ছি জলপ্রপাত। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় জলপ্রপাত – দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান এই জলপ্রপাতটি ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে সংরক্ষিত। যারা আর্জেন্টিনা ভ্রমণে আসেন তারা খুব কাছ থেকে এই জলপ্রপাতকে দেখতে পারেন। আর্জেন্টিনার মিনিওনিস প্রদেশের ইগুয়াচ্ছি বা ইগুয়াসি নদী এবং ব্রাজিলের পারানো নদীর মিলিত স্রোত তৈরি করেছে এই জলপ্রপাতটি। এই নদীর প্রায় অর্ধেক স্রোত গিয়ে পড়ছে একটি সরু গভীর গিরিখাতে।
বুয়েনোস আইরেস –
বুয়েনোস হল আর্জেন্টিনার রাজধানী ও বৃহত্তম নগরী। নগরীটি দক্ষিণ আমেরিকার আটলান্টিক মহাসাগরের দক্ষিণ -পূর্ব উপকূল থেকে ২৪০ কিলোমিটার ভেতরে রিও দে লা প্লাতা নামক মোহনার পশ্চিম তীরে অবস্থিত। গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র বন্দরও এটি।
এই শহরে গেলে দেখা যায় জাদুঘর, আর্ট গ্যালারি, আইনসভার প্রাসাদ, পুয়েন্তে দে লা মুহের সেতু, রাষ্ট্রপতির বাসভবন কাসা রোসাদা। রাজধানী বয়েনোস আইরেসের আয়তন প্রায় ২০৩ বর্গকিলোমিটার। আর্জেন্টিনা কৃষিপ্রধান দেশ, তাই প্রতি জুলাই মাসে রাজধানী বুয়েনোস আইরেসে গবাদিপশু ও কৃষি মেলা বসে। এই নগরীতে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, ধাতুর দ্রব্য প্রস্তুত কারখানা, মোটরযান নির্মাণ ও খনিজ তেল প্রক্রিয়াজাতকরণের শিল্প -কারখানা আছে। এই নগরীর তিন -চতুর্থাংশ লোক শেতাঙ্গ ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত।
উসুয়াইয়া –
এই শহরটি আর্জেন্টিনার দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত। উসুয়াইয়ায় গেলে দেখা মেলে আন্দিজ পর্বতমালা। এখানের অপূর্ব প্রাকৃতিক ভূ -বৈচিত্র্যের তুলনা হয় না। এই শহরের চারপাশ ঘিরে আছে পর্বতমালা, সাগর, হিমবাহ এবং বনাঞ্চল। এখানে রয়েছে টিয়েরা ডেল ফুয়েগো ন্যাশনাল পার্ক।
উসুয়াইয়া শহর থেকেই অ্যান্টার্কটিকা এবং হর্ণ অন্তরীপ ভ্রমণে যাতায়াত করা হয়ে থাকে। এই শহরটিকে বলা হয় পৃথিবীর সর্ব দক্ষিণের শহর।
করডোভা –
আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর হল করডোভা। এখানের প্রধান আকর্ষণ প্রাচীনতম ক্যাথেড্রাল চার্চ। এই শহরের পুরনো দালানগুলোর বেশির ভাগ ষোল শতকে নির্মিত হয়েছিল। শহরের ঠিক মাঝখানে রয়েছে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট প্লাজা সান মার্টিন।
স্পেনের করডোভা শহরের নামানুসারে এই শহরের নামকরণ করা হয়। আন্দিজ পর্বতমালা দেখতে যাওয়া পর্যটকরা এই শহরে দু’চারদিন অবস্থান করে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করে থাকেন।
পতাগোনিয়া –
পাতাগোনিয়া হল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক স্থান। এখানের লস গ্লেসিয়ারেস ন্যাশনাল পার্ক আর্জেন্টিনার জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট।
একসময় বিপন্ন ডাইনোসরদের আবাসস্থল ছিল এখানে এবং এই অঞ্চল জুড়ে বহু জায়গায় তার প্রমাণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এখানের এক হ্রদের পাশে এখনও ডাইনোসরদের বিশালকার পায়ের ছাপ দেখা যায়।
আর্জেন্টিনার উত্তরে আছে ঊষ্ণমন্ডলীয় অঞ্চল, আর দক্ষিণে রয়েছে প্রায় অ্যান্টার্কটিকা ঘেঁষে থাকা পাতাগোনিয়া। পাতাগোনিয়ায় গেলে দেখা যায় পেরিতো মরিনো হিমবাহ – এই হিমবাহের নামকরণ করা হয়েছে এক বিখ্যাত পরিব্রাজকের নামানুসারে। শহরকেন্দ্র থেকে মাত্র ৭৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই হিমবাহটি আকৃতিতে বিশাল। প্রায় ১২১ বর্গমাইল জুড়ে এর বিস্তার। এটি চিলি এবং আর্জেন্টিনার মাঝখানে একটি আইসফিল্ডের অংশ।
আর্জেন্টিনার ভূ -প্রকৃতি ও জলবায়ু বড্ড বিচিত্র। এখানে উত্তরের নিরক্ষীয় অঞ্চল থেকে দক্ষিণের মেরু -উপদেশীয় অঞ্চল পর্যন্ত এই দেশটির বিস্তার। এর মধ্যেই রয়েছে আন্দেস পর্বতমালা ও তার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ আকোনকাগুয়া। তবে এ দেশের বেশির ভাগ লোক বসবাস করে দেশটির মধ্যভাগে। উর্বর সমভূমিকে ওখানে বলা হয়, পাম্পাস। আর এই পাম্পাসেই আর্জেন্টিনার অধিকাংশ কৃষিসম্পদ উৎপন্ন হয়। আর এখানেই দক্ষিণ আমেরিকার বিখ্যাত কাউবয়দের আবাসস্থল। কাউবয়দেরকে ওখানে বলা হয় ‘গাউচো’।
আধুনিক আর্জেন্টিনার ইতিহাস শুরু হয় ১৬শ শতকে – তা হয়েছিল স্পেনীয় উপনিবেশীকরণের মাধ্যমে। ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে এখানে স্পেনীয় সাম্রাজ্যের অধীনে রিও দে লা প্লাতা উপরাজ্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে এই উপরাজ্যের উত্তরসুরী রাষ্ট্র হিসেবে আর্জেন্টিনার উত্থান ঘটে। ১৯শ শতকের শেষ ভাগ থেকে আর্জেন্টিনা প্রচুর পরিমাণে কৃষিদ্রব্য যেমন মাংস, পশম, গম ইত্যাদি রপ্তানি শুরু করে। দক্ষিণ আমেরিকায় আর্জেন্টিনাতেই প্রথম শিল্পায়ন শুরু হয় এবং বহুদিন দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের সবচেয়ে ধনী দেশ ছিল। সে সময়ে এখানকার অধিবাসীরা ইউরোপীয় দেশগুলির সমমানের জীবনযাত্রা নির্বাহ করত। একসময় ব্যাপক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করে আর্জেন্টিনা দেশটি বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিশ্বের ৭ম ধনী দেশ হতে পেরেছিল। তবে ১৯৪০ এর দশকে আর্জেন্টিনায় ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব ও বড় আকারের জাতীয় ঋণের সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পিছিয়ে পড়ে।
তবে বর্তমানে আর্জেন্টিনার যত যশ -খ্যাতি, তা যেন ফুটবল খেলাকে ঘিরে। বিখ্যাত ফুটবল খেলোয়াড় লিওনেল মেসির জন্য বিশ্ববাসী আজ আর্জেন্টিনা দেশটির নামটি হৃদয়ের অতল গভীরে গেঁথে নিয়েছে।
আরও পড়ুন: ফ্রান্স যেসব জনপ্রিয় পর্যটন আকর্ষন কেন্দ্রের জন্য বিখ্যাত