আমেরিকা সারা বিশ্বের পর্যটকদের কাছে স্বপ্নের দেশ। দিবারাত্রির শহর নিউইয়র্ক সার বিশ্বের রাজধানী হিসাবে পরিচিত। আমেরিকার প্রধান কিছু ট্যুরিষ্ট আকর্ষণ নিয়ে লিখেছেন দুই বাংলা অন্যতম সেরা ভ্রমণ লেখক লিয়াকত হোসেন খোকন।
Table of Contents
আকার -আয়তনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশাল দেশ। আমেরিকায় দর্শনীয় স্থানের সংখ্যাও প্রচুর। এখানের ৫০টি রাজ্য জুড়ে প্রায় শতাধিক বড় বড় শহর রয়েছে। সেখানকার প্রকৃতি ও মানুষের সৃষ্টি দেখার মতো।
আমাদের বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরের এই দেশে, ভ্রমণের খরচ একটু বেশি। প্রায় কুড়ি দিন হাতে সময় নিয়ে আমেরিকা ভ্রমণে যেতে পারেন।
অ্যারিজোনা
সবচেয়ে ভাল লাগবে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে গেলে। অ্যারিজোনা রাজ্যে অবস্থিত গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন প্রকৃতির বিস্ময়কর সৃষ্টি। কলোরাডো নদী বয়ে গেছে এখান থেকে। বিশাল ক্যানিয়ন অঞ্চলের মধ্যে পর্যটকদের দেখার জন্য যে অংশটি তার নাম ‘গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ন্যাশনাল পার্ক’।
লাসভেগাস থেকে গাড়িতে গেলে পথে পড়বে নেভাদা ও অ্যারিজোনার মোহাবি ডেজার্ট, বিখ্যাত হুভার ড্যাম। পার্কের এন্ট্রি পয়েন্টে টিকিট কেটে বা পাস দেখিয়ে প্রবেশ করতে হয়। প্রথমেই ভারক্যাম্প ভিজিটর সেন্টার। এখানে রয়েছে বিভিন্ন টেম্পল।
ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য এখানে ব্লু -লাইন, রেডলাইন ভিন্ন ভিন্ন নামের শাটল বাস ভিন্ন ভিন্ন দিকে নানান জায়গার পয়েন্টে নিয়ে যায়। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দিনের বিভিন্ন সময়ে ক্যানিয়নের রং বদলায়।
দেখতে ভুলে যাবেন না কিন্তু মারিকোপা পয়েন্ট, পাওয়েল পয়েন্ট, হোপি পয়েন্ট। যে পয়েন্টে যাবেন সেখানে গিয়ে নিচে তাকালেই দেখবেন কলোরাডো নদী। একই সঙ্গে ঘুরে বেড়ান মোহাবি পয়েন্ট, অ্যাবিস, মনুমেন্ট ক্রিক ভিস্তা, পিনা পয়েন্ট, হারমিটস পয়েন্ট। এর সর্বত্রই সূর্যাস্তের রং চমৎকার।
এখানে যারা ভ্রমণে যান তাদের জন্য রয়েছে বাইকিং, হাইকিং ট্যুর, রিভার রাফটিং, হর্স রাইডিং।
আরও আছে লাসভেগাস থেকে হেলিকপ্টার ট্যুর।
লাসভেগাস
আমেরিকা বেড়াতে গিয়ে লাসভেগাস না গেলে বা না দেখলে ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এত আলো, রোশনাই, বিলাস -বৈভব আর এত মজা পৃথিবীর অন্য কোনও শহরে পাওয়া যাবে না।
লাসভেগাস বুলেভার্ডের অন্য পরিচিতি ‘ভেগাস স্ট্রিপ’ নামে। এখানে এপারে -ওপারে অসংখ্য হোটেল, ক্যাসিনো। প্রতিটি হোটেলই থিম হোটেল এবং প্রতিটিই আকর্ষণীয়। হোটেলের ভিন্ন ভিন্ন তলায় হরেক রকমের মজা আর আনন্দ। আছে ড্যান্স ফ্লোর, ক্যাসিনো, অতি লাক্সারি ব্র্যান্ডের শপিংমল, চাইনিজ, ইটালিয়ান, মেক্সিকান, কলম্বিয়ান, আমেরিকান হরেক দেশীয় রেস্টুরেন্ট, পঁচিশ থেকে একশো ডলার টিকিটে আর কিছু কিছু বিনা ডলারে সার্কাস, ম্যাজিক, কমেডি বা অ্যাডাল্ট শো রয়েছে। এখানের স্ট্রিপে হাঁটতে হাঁটতে দেখা হয়ে যাবে স্বল্পবসনা সাম্বা সুন্দরীর সঙ্গে।
লস এঞ্জেলস
আমেরিকার ওয়েস্ট কোস্টে কালিফোর্নিয়া স্টেটে আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর লস এঞ্জেলস। এ শহরে এক রাত কাটাতে পারেন। এখানের উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় হল – গেটি সেন্টার – মডার্ন আর্ট ও এক্সিবিশনের বিশাল সম্ভার, ডলবি থিয়েটার। এই ডলবি থিয়েটারে অস্কার পুরস্কার দেওয়া হয়ে থাকে। পাশেই সান্তামনিকা সমুদ্র সৈকত, সেখানেও যাবেন।
লস এঞ্জেলস শহর থেকে এক ঘন্টার দূরত্বে অ্যানাহাইম। এই জায়গাটিতে রয়েছে ডিজনিল্যান্ড ক্যালিফোর্নিয়া। ওয়াল্ট ডিজনির নিজের হাতে গড়া এই অ্যামিউজমেন্ট পার্কের সব কিছু একদিনে ঘুরে দেখা অসম্ভব। এখানে গিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যা যা ঘুরে দেখবেন, তা হলো – ফ্যান্টাসি ল্যান্ড, ফ্রন্টিয়ার ল্যান্ড, নিউ অরলিয়েন্স স্কোয়ার, অ্যাডভেঞ্চার ল্যান্ড, মিকিস টুনটাউন, ডিজনি অ্যাডভেঞ্চার পার্ক -ইত্যাদি। এর সব জায়গাতে ঢুকতে টিকিট লাগবে।
সময় নষ্ট না করে সকাল সকাল পার্কে প্রবেশ করতে হলে অ্যানাহাইমের হোটেলে রাত কাটাবেন। এখানে ৬০ থেকে ১০০ ডলারের মধ্যে হোটেল পাওয়া যাবে।
লস এঞ্জেলস থেকে আধঘন্টার দূরত্বে হলিউড। এখানে অনেকগুলো স্টুডিওর মধ্যে ইউনিভার্সাল স্টুডিও ট্যুর অধিক বিখ্যাত। একদিনে সব দেখা বা সব রাইডে চড়া মুশকিল। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দেখে নিন – আপার লটে স্টুডিও বাস ট্যুর, সিম্পসনস ওয়ার্ল্ড, কিংকং থ্রি ডি, শ্রেক কোর ডি, ইউনিভার্সাল অ্যানিম্যাল অ্যাক্টরস এবং লোয়ার লটে জুরাসিক পার্ক, মমি রাইড, ইউনিভার্সাল সিটি ওয়াক, কস্টিউম মিউজিয়াম -ইত্যাদি।
বেভারলি হিলসে অবশ্যই যাবেন। আলাদা হাফ ডে ট্যুরে ঘুরে আসতে পারেন বেভারলি হিলস থেকে। এখানেই দেখবেন পৃথিবীর সেরা ধনী ও হলিউড সিনেমা তারকাদের বাড়ি।
ভ্রমণ নিয়ে আরও পড়ুন: মায়া সভ্যতার পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের দেশ
লস এঞ্জেলস থেকে সড়কপথে ৩৪০ মাইল দূরে সানফ্রান্সিসকো। লস এঞ্জেলস থেকে বাসে, ট্রেনে, গাড়িতে গেলে ৫ থেকে ৭ ঘন্টা লাগবে। বিমানে মাত্র ৪২ মিনিট।
আমেরিকার পূর্ব দিকের পুরনো শহর যেমন নিউইয়র্ক বা শিকাগো, পশ্চিমে তেমন সানফ্রান্সিসকো। এই সানফ্রান্সিসকো হলো এক ঐতিহাসিক নগরী। সানফ্রান্সিসকোতে এসে দেখে নিবেন – সুন্দর সব কুয়াশামাখা সমুদ্র সৈকত, চায়না টাউন, বে এরিয়া, আলকাট্রাস দ্বীপের কারাগার, গোল্ডেন গেট ব্রিজ -ইত্যাদি।
নিউইয়র্ক
যারা আমেরিকার পূর্বদিকে যাবেন তারা অবশ্যই প্রথমে নিউইয়র্ক ভ্রমণ করবেন। নিউইয়র্ক শহরে দেখার মতো অনেক জিনিস আছে। কম করে হলেও তিনদিন নিউইয়র্কে থাকবেন। এখানে বেড়ানোর সবচেয়ে সহজ উপায় মেট্রোয় চেপে অথবা হপ অন হপ অফ বাস ট্যুরে এখান থেকে ওখানে ঘুরে বেড়াবেন। তিনদিনের জন্য টিকিট পাওয়া যায়। অনেকগুলো কোম্পানি আছে। পেনসিলভানিয়া স্টেশনের সামনে, টাইমস স্কোয়্যারে এদের টিকিট কাউন্টার আছে। প্রয়োজনে অনলাইনে অগ্রিম বুক করে নিতে পারেন। বাস ট্যুরে সুবিধা হল যে -কোনও জায়গায় নেমে পড়া যায়। প্রতি দশ -পনেরো মিনিট অন্তর বাস পাওয়া যায়। নিউইয়র্কে যা যা ঘুরে দেখবেন তা হল – স্ট্যাচু অব লিবার্টি, এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং, টাইমস স্কোয়্যার, সেন্ট্রাল পার্ক, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার সাইট, মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট, ব্রুকলিন ব্রিজ, নিউইয়র্ক হারবার, ইয়াঙ্কি স্টেডিয়াম, ওয়াল স্ট্রিট।
থাকার জন্য নিউইয়র্কে দামি, কমদামি অজস্র হোটেল রয়েছে। ম্যানহাটনে হোটেল ভাড়া বেশি, তুলনামূলকভাবে ব্রুকলিনে অনেকটা সস্তা।
আমেরিকার অন্যতম সেরা আকর্ষণ নায়াগ্রা জলপ্রপাত। নিউইয়র্ক থেকে বাসে বা ট্রেনে সেখানে যেতে সাত থেকে আট ঘন্টা লাগে। বিমানে লাগে এক ঘন্টা।
নায়াগ্রায় শুধু ফলসের ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যই নয়, তার আশপাশের সবুজ অরণ্য, ঘননীল জলের নায়াগ্রা নদী, তার ওপর ছোট ছোট সুন্দর সব দ্বীপ -এসব দেখতে দেখতে নায়াগ্রা স্টেট পার্কে ঘুরে বেড়ানো সত্যিই অসাধারণ অভিজ্ঞতা হতে পারে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পার্কে ঘুরে ঘুরে দেখে নিন – আমেরিকান ফলস, ব্রাইডাল ভেইল ফলস, কানাডিয়ান ফলস ইত্যাদি। নায়াগ্রা সিনিক ট্রলি নামের কাঠের তৈরি ট্রামে চড়ে পার্কের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে বেড়িয়ে নিন।
ওয়াশিংটন
ওয়াশিংটন না গেলে আমেরিকা ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। বিখ্যাত ওয়াশিংটন মলের এক প্রান্তে হোয়াইট হাউস, পেন্টাগন আর ওয়াশিংটন মনুমেন্ট। এর উল্টো দিকে আছে ইউ, এস, ক্যাপিটল ও লাইব্রেরি অব কংগ্রেস। সবুজ ঘাসে ঢাকা লম্বা পার্কটির নামই ওয়াশিংটন মল।
হাঁটতে হাঁটতে চোখ ভরে দেখে নিন সব মিউজিয়াম। এ শহরের বিশেষ বৈশিষ্ট্য কোনও মিউজিয়ামেই ঢুকতে টিকিট লাগে না। দিনটি যদি রবিবার হয়, তবে মেট্রোয় ঘুরে বেড়ান অর্ধেকেরও কম ভাড়ায়। অবশ্যই দেখে নিন স্মিথসোনিয়াম ন্যাশনাল এয়ার অ্যান্ড স্পেস মিউজিয়াম আর স্মিথসোনিয়াম ন্যাচারাল হিষ্ট্রি মিউজিয়াম। কেনেডি সেন্টার, ন্যাশনাল গ্যালারি অব আর্ট, ওয়ার্ল্ড ওয়ার মেমোরিয়াল ও জায়েন্ট পান্ডার জন্য বিখ্যাত ন্যাশনাল জু’তেও যাবেন।
আমেরিকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে যাবেন – আমেরিকান ন্যাশনাল পার্ক, গ্র্যান্ড টেটন ও ইয়োলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক, ইয়েসোমিটি ন্যাশনাল পার্ক, ডেথ ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক – ইত্যাদিতেও।
আলাস্কা
আলাস্কা হল আমেরিকার মূল ভূখণ্ড থেকে অনেক দূরে। একদিকে কানাডা ও অন্যদিকে রাশিয়ার মাঝে আলাস্কা। এই আলাস্কা উত্তর মেরুর বিশাল এলাকা ও দেশের সবচেয়ে বড় রাজ্য হল এটি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বন্যপ্রাণীর অসাধারণ মেলবন্ধন আলাস্কার প্রধান শহর অ্যাঙ্কোরেজে। আমেরিকার সবচেয়ে কাছের শহর সিয়াটল। কয়েক ঘন্টা বিমানযাত্রা। আলাস্কায় দেখবেন – ডেনালি ন্যাশনাল পার্ক, সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট ম্যাকিনল। বিশাল আলাস্কা যেন সৌন্দর্য ও রূপে অপরূপ – এখানে গেলে ফিরে আসতে মন চায় না। মন হারানোর দেশ আলাস্কা।
প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর অসংখ্য পলিনেশীয় দ্বীপ নিয়ে হাওয়াই। লস এঞ্জেলস থেকে প্রায় ৫ ঘন্টায় বিমানে চলে যান হাওয়াইয়ের রাজধানী হনলুলুতে। এ শহরটি ওহায়ু দ্বীপে অবস্থিত। হনলুলুতে ও এর আশেপাশে দেখবেন – ওয়াইকিকি সমুদ্র সৈকত, হাওয়াই ভলক্যানো ন্যাশনাল পার্ক। ভলক্যানো ন্যাশনাল পার্কে দেখবেন দু’টি জীবন্ত আগ্নেয়গিরি কিলাউয়া ও মৌনা লোয়া।
ভ্রমণ নিয়ে আরও পড়ুন: ফ্রান্স যেসব জনপ্রিয় পর্যটন আকর্ষন কেন্দ্রের জন্য বিখ্যাত