জার্মানী: প্রাচীন নর্ডীয় ব্রোঞ্জ যুগে উৎপত্তি যে দেশের


প্রাচীন নর্ডীয় ব্রোঞ্জ যুগ অথবা প্রাক রোমান লৌহ যুগে জার্মানিতে আদি জাতিগোষ্ঠীগুলোর বসবাস শুরু হয়। পশ্চিম ইউরোপের শিল্পন্নোত এই দেশ নিয়ে লিখেছেন দুই বাংলার অন্যতম সেরা ভ্রমণ লেখক লিয়াকত হোসেন খোকন

Table of Contents

জার্মানির প্রধান নগরী বার্লিনে শত বছর আগে থেকে আন্ডার গ্রাউন্ডে ট্রেন চলাচল করে আসছে। মাটির নিচে সুরক্ষা পথে যেতে হয় লিফটে চড়ে। এখানে নিমিষে ট্রেন থেমেই আবার ছেড়ে দেয়। রাস্তায় অনেক লোক চটপট গাড়িতে চলাফেরা করা যায় না ভিড়ের জন্য। মাটির নিচে ভীষণ জোরে নির্ভয়ে ইলেকট্রিক ট্রেন চলে। সে জন্য অল্প সময়ের মধ্যে শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে যাওয়া যায়। বার্লিনে মাটির নিচে ট্রেন একটার পর একটা ছুটছে। দূরত্ব বা দুই ট্রেনের মধ্যে ব্যবধান সামান্য। এখানে এমন ব্যবস্থা আছে যে দুটো ট্রেন খুব কাছাকাছি এলে আপনি পিছনেরটা বন্ধ হয়ে যায়। ইলেকট্রিক কাট অফ সিস্টেম একেবারে সুনিশ্চিত।

বার্লিন শহরের পশ্চিম প্রান্তে কুরফুর স্টেনডাম পাড়া, সেখানে রয়েছে চওড়া রাস্তা। এরই দুই পাশে বিশাল বিশাল অট্টালিকা। এখানেই বসবাস করে বড় লোকরা বা ধনাঢ্য পরিবারের লোকজন। সন্ধ্যা হতেই আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে। কাছেই টিয়াত গার্ডেন ও চিড়িয়াখানা।

বার্লিনের একধারে ‘ভোয়ান সে’। এটি একটি হ্রদ। এই হ্রদের তীরে পিকনিক কর্ণার রয়েছে। শহরের বাইরে নয়স্টার্ড নামে একটি জায়গায় বিখ্যাত ‘সাঁ খুশি’ প্রাসাদ। ইতিহাস প্রসিদ্ধ ফ্রেডরিক দ্য গ্রেট শহর থেকে দূরে একটা শান্তিময় পরিবেশে পাহাড়ের ওপর এই প্রাসাদ তৈরি করিয়েছিলেন সম্রাট। সম্রাটের সঙ্গে ফরাসি লেখক ভলটেয়ারের সঙ্গে সম্রাটের বন্ধুত্ব ছিল।

এখনও জার্মানদের উচ্চাশার শেষ নেই, যুদ্ধ বাধাবার জন্য যেন এরা পা বাড়িয়েই আছে। তারা প্রমাণ করবার চেষ্টা করে, জার্মানি সবার উর্ধ্বে। যেমন তাদের জাতীয় সংগীতে আছে -‘জার্মানি, জার্মানি সবার সেরা’।

জার্মানী
কাইজারের ভাস্কর্য: বার্লিন

গণিতবিদের জন্ম জার্মানীতে –

এমি নোয়েথার নিঃসন্দেহে বিংশ শতাব্দীর একজন অসামান্য গণিতবিদ। নারী গণিতবিদদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বলতম গবেষকও তিনি। এই এমি নোয়েথারের জন্ম ১৮৮২ খৃষ্টাব্দের ২৩ মার্চ জার্মানির এরল্যাঞ্জেন শহরে। তাঁকে বলা হয়, পারদর্শী গণিতবিদদের মধ্যে এমি নোয়েথারই ছিলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সৃষ্টিশীল

গণিত -প্রতিভা।

কবি ও চিন্তাবিদদের দেশ জার্মানি –

জার্মান ভাষায় জার্মানিকে প্রায়ই বলা হয়ে থাকে ‘ডাস লান্ড ড্যার ডিখটার উন্ড ডেনকার’ যার অর্থ হচ্ছে ‘জার্মানি হলো কবি ও চিন্তাবিদদের দেশ।’

একটি জাতির দেশ হিসেবে জার্মানির উত্থানের অনেক আগে থেকেই জার্মান সংস্কৃতির আবির্ভাব এবং এর বিস্তৃতি ছিল গোটা জার্মান ভাষা এলাকা জুড়ে। গোড়া থেকেই জার্মান সংস্কৃতি ইউরোপের তৎকালীন সব হালচালে প্রভাবিত হয়ে এসেছে এবং এই প্রভাবে ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা দু’টোই ছিল। এই জন্যে জার্মান সংস্কৃতিকে ইউরোপের উচ্চ সংস্কৃতি থেকে আলাদা করে চিহ্নিত করা মুশকিল।

ফুটবল জার্মানদের জাতীয় খেলা, আর ফুটবল খেলার সবচেয়ে বড় অর্জন ফিফা বিশ্বকাপে জার্মানি চারবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এছাড়াও ক্লাব ফুটবলে জার্মান দল বায়ার্ন মিউনিখ তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছে। খেলাধুলার আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে জার্মানিরা সব সময় তাদের শ্রেষ্ঠত্ব দেখিয়ে গিয়েছে এবং যাচ্ছে।

জার্মানি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সবচেয়ে জনবহুল দেশ। সারা পৃথিবীর মধ্যে জার্মানি ১৫তম জনবহুল দেশ। প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২২৯.৪ জন অধিবাসী বাস করে।

জার্মান ভাষা জার্মানির সরকারি ভাষা। তবে জার্মানিতে আরও অনেকগুলি ভাষা প্রচলিত আছে, এ ভাষাগুলো হলো – আরবি, গ্রিক, ইতালীয়, কুর্দি, তুর্কি, সার্বিয়, ডেনিয়, ফ্রিসীয়, পোলিয়, রোমানি, ওলন্দাজ – ইত্যাদি ভাষা।

জার্মানির কিছু বড় শহর হলো – বার্লিন, হামবুর্গ, মিউনিখ, ড্রেসডেন, এসেন, লিপজিগ, কোলেন, ফ্রাঙ্কফুর্ট।

ইউরোপের অন্যতম প্রধান শিল্পোন্নত দেশ হলো জার্মানি। এ দেশটি ১৬টি রাজ্য নিয়ে গঠিত একটি সংযুক্ত ইউনিয়ন। এটি মধ্য ইউরোপ ও পশ্চিম ইউরোপের একটি দেশ।

জার্মানি দেশটি উত্তর সীমান্তে উত্তর সাগর ও বাল্টিক সাগরের মাঝখানে এবং দক্ষিণে আল্পস পর্বতমালার মাঝখানে অবস্থিত

জার্মানির পূর্ব সীমান্তে ফ্রান্স, লুক্সেমবার্গ, বেলজিয়াম এবং নেদারল্যান্ডস ; উত্তর সীমান্তে ডেনমার্ক এবং দক্ষিণ সীমান্তে অস্ট্রিয়া ও সুইজারল্যান্ড।

প্রাচীন নর্ডীয় ব্রোঞ্জ যুগ অথবা প্রাক রোমান লৌহ যুগে জার্মানিতে আদি জাতিগোষ্ঠীগুলোর বসবাস শুরু হয়। দক্ষিণ স্ক্যান্ডিনেভিয়া এবং উত্তর জার্মানি থেকে এই গোষ্ঠীগুলো দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম দিকে বসতি স্থাপন শুরু করে খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে। এই সম্প্রসারণের ফলে তারা গলের কেল্টীয় গোষ্ঠী এবং পূর্ব ইউরোপের ইরানীয়, বাল্টিক ও স্লাভিক গোষ্ঠীগুলোর সান্নিধ্যে আসে।

অগাস্টাসের রাজত্বকালে রোমান জেনারেল পুবলিয়াস কুইঙ্কটিলিয়াস ভ্যারাস জার্মানিতে আগ্রাসন চালানো শুরু করে। এই আগ্রাসন চলাকালেই জার্মানির গোষ্ঠীগুলো রোমানদের যুদ্ধ কৌশল সম্বন্ধে জানতে পারে। এই গোষ্ঠীগুলো নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেই রোমান যুদ্ধ কৌশলের অনেকাংশ রপ্ত করতে সক্ষম হয়। ৯ খৃষ্টাব্দে টেউটোবুর্গ বনের যুদ্ধে জার্মানির চেরুস্কান নেতা আরমিনিউস, রোমান জেনারেল ভ্যারাসের নেতৃত্বে পরিচালিত নয় লেজিয়নের এক সৈন্য দলকে পরাজিত করে। এর ফলে আধুনিক জার্মানি তথা রাইন এবং দানিয়ুব রোমান সাম্রাজ্যের বাইরেই থেকে যায়।

বর্তমান জার্মানি অঞ্চলটি ৮৪৩ অব্দে ক্যারোলিঙ্গিয়ান সাম্রাজ্যের বিভাজনের ফলে সৃষ্টি হয়। এরপর বহু শতাব্দী যাবৎ জার্মানি ছিল দুর্বলভাবে একত্রিত জমিদারি ভিত্তিক কতগুলি দেশের সমষ্টি। ১৬শ শতকের পর থেকে জার্মান রাষ্ট্রগুলি ইউরোপের যুদ্ধ ও ধর্মীয় সংঘাতে ক্রমশ বেশি করে জড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ১৯শ শতকের শুরুতে ফ্রান্স জার্মান রাষ্ট্রগুলি দখল করলে জাতিগতভাবে একত্রিত এক জার্মানির জন্য জনমত প্রবল হয় এবং ১৮১৫ খৃষ্টাব্দে প্রুশিয়ার নেতৃত্বে জার্মান রাষ্ট্রগুলি একটি কনফেডারেশন গঠন করে, যা ১৮৬৭ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।

জার্মানী
হারকিউলিসের ভাস্কর্য: জার্মানী

১৮৭১ খৃষ্টাব্দের পর জার্মানিতে দ্রুত শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটে। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে জার্মানি ইউরোপে আধিপত্য স্থাপনের চেষ্টা চালালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত হয়। ১৯১৮ খৃষ্টাব্দে যুদ্ধে জার্মানির পরাজয় ঘটলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। এদিকে জার্মানিতে উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রক্রিয়ার ফলে নাৎসি পার্টির আবির্ভাব ঘটে। নাৎসি পার্টি ১৯৩০ এর দশকে আডলফ হিটলারের নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে। ১৯৩৯ খৃষ্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয় ঘটে। সেই সময় এই দেশটিকে দু’টি ভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে বহু বছর পরে দুই জার্মানি একত্রিত হয়ে যায়।

জার্মানির রাজধানী বসেছে বার্লিনে। এ দেশের মুদ্রার নাম -ইউরো। কয়েকটি অঞ্চলে বিভক্ত জার্মানি। যেমন, উত্তর জার্মানি – এই জায়গার উল্লেখযোগ্য স্থান ব্রেমেন, হামবুর্গ, উইন্ডসওয়েপ্ট পাহাড়, উত্তর সাগর, বাল্টিক সাগর।

পশ্চিম জার্মানি – এই অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য ও দর্শনীয় স্থান – উত্তর রাইন – ওয়েস্টফ্যালিয়া, রাইনল্যান্ড -প্যালাটিনেট, সারল্যান্ড, মসেলি ভ্যালিস।

মধ্য জার্মানি – এখানের উল্লেখযোগ্য স্থান – হেসে, প্রাচীন থুরিংজিয়ান বন।

পূর্ব জার্মানি – এ অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য স্থান হল – বার্লিন, ব্র্যান্ডেনবার্গ, স্যাক্সোনি, অ্যানহাল্ট।

দক্ষিণ জার্মানি – এ অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য স্থান – বেভারিয়া, ব্ল্যাক ফরেস্ট, আল্পস।

জার্মানির দুই তৃতীয়াংশ লোক রোমান ক্যাথলিক।