টিভিতে খেলা দেখার সাথে মানসম্মত ধারাভাষ্য যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তবে জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার হর্ষ ভোগলের কন্ঠে খেলার ধারা বিবরণী শুনলে মনে হয়, যেন তার বিবরণ অনুযায়ীই খেলাটা টিভিতে দৃশ্যমান হচ্ছে। এ যেন খেলার বর্ণনা দিয়ে ধারা বিবরণী নয়,বরঞ্চ ধারা বিবরণী দ্বারা চালিত খেলা! ধারাভাষ্যের এমন মন্ত্রই যেন জানা আছে হার্শা ভোগলের।
মাত্র ১৯ বছর বয়সেই “অল ইন্ডিয়া রেডিও”র হয়ে হার্শা ভোগলের ধারাভাষ্যে অভিষেক ঘটে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক খেলায় ধারাভাষ্য দিয়ে সকলকে মনমুগ্ধ করতে থাকেন তিনি। তিনিই সর্বপ্রথম ভারতীয় ধারাভাষ্যকার যাকে ১৯৯১ সালে “অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্ট কর্পোরেশন” আমন্ত্রণ জানায় ভারতের সিরিজগুলোতে ধারাভাষ্য প্রদানের জন্য। সুতরাং,বোঝাই যায়,অতি অল্প বয়সেই হার্শা ভোগলে একেবারে ঝানু ধারাভাষ্যকার হওয়ার কৌশল রপ্ত করে ফেলেন।
তবে হর্ষ ভোগলেকিন্তু সবসময়ই একজন লেখক হতে চেয়েছিলেন। তার লেখার হাত দারুণ। এমনকি ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় জুড়েই তিনি লেখালেখিটা চালিয়ে গেছেন এবং এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন। হার্শার সবচেয়ে বড় গুণ,তিনি যেকোন একটি পরিস্থিতিকে শুধু গভীরভাবে উপলব্ধিই করেন না,সাথে সাথে এর বর্ণনাও এমনভাবে করেন যাতে শ্রোতাদের চোখের সামনে সেটি চলমান ছবি হিসেবে ভেসে ওঠে। এই দুটি গুণ একসাথে রপ্ত করতে পারা ধারাভাষ্যকারের সংখ্যা অতি নগণ্য। হার্শা কখনোই নিজেকে ক্রিকেট বিশ্লেষক হিসেবে দাবি করেন না। বরঞ্চ তিনি নিজেকে একজন “স্টোরি-টেলার” হিসেবে পরিচয় দেন। তার মতে,ধারাভাষ্যকারের কাজ শুধু ক্রিকেট বিশ্লেষণ করা নয়। একজন ধারাভাষ্যকারের কাজ হল,শ্রোতাকে খেলার প্রতিটি মুহুর্তের বাস্তব অভিজ্ঞতা দেয়া। যাতে দর্শকের কখনোই মনে না হয় যে,তারা খেলাটি শুধু শুনছে। তাদের যেন মনে হয়,খেলাটি তারা মাঠে বসেই দেখছে,তারাও খেলাটিরই একটি অংশ।
তবে কি হর্ষ ভোগলের ক্রিকেটীয় জ্ঞান স্বল্প? হর্ষ ভোগলে নিজেই এ বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন। তিনি বলেন,”আমাকে নিয়ে একটা কথা খুব প্রচলিত যে,আমি কখনো পেশাদার ক্রিকেট খেলিনি। তবে যারা এটি মনে করেন,তারা বোধহয় জানেন না যে আমি হায়দ্রাবাদের হয়ে ‘এ’ ডিভিশন পেশাদার ক্রিকেট খেলেছি ও আমার বিশ্ববিদ্যালকে প্রতিনিধিত্ব করেও প্রচুর ক্রিকেট খেলেছি। সুতরাং,এ ধরণের কথা শোনার জন্য মুখরোচক,তবে এটি সত্যি নয়।“
সাধারণত ধারাভাষ্যকাররা তারকা খেলোয়াড় ও বড় দলগুলোর প্রতি কিছুটা পক্ষপাতী হলেও হর্ষ এখানে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তিনি সবসময়ই তরুণ,সম্ভাবনাময় খেলোয়াড় ও ছোট দলগুলোরও সমানভাবে প্রশংসা করেন। তাদেরকে উৎসাহিত করেন।
বাংলাদেশের কথাই ধরা যাক না। এমনিতেই ভারতের সাথে বাংলাদেশের খেলা খুব কম হয়। তার ওপর মাঠের খেলায়ও বাংলাদেশ ও ভারতের শক্তির ব্যবধান অনেক। তারপরও,ভারতের সাথে খেলা ও বৈশ্বিক আসরগুলোতে বাংলাদেশের ম্যাচে যখনই হার্শা ভোগলে ধারাভাষ্যে থাকেন,ততক্ষণ বাংলাদেশের ইতিবাচক দিকগুলোই আলোচনা করেন,ভুল-ত্রুটিগুলো ধরিয়ে দিয়ে উৎসাহব্যঞ্জক মন্তব্য করেন। বাংলাদেশ দল যে হার্শা ভোগলের অন্যতম প্রিয়,সেটি তার ধারাভাষ্য ও নানা কার্যক্রম থেকেই বোঝা যায়। তিনি সবসময়ই চেষ্টা করেন বাংলাদেশের খেলার খোঁজ-খবর রাখতে। বাংলাদেশের ভাল-মন্দ পারফরম্যান্সে প্রায়ই তাকে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে টুইট করতে দেখা যায়। আর সাকিব আল হাসান তো তার অন্যতম প্রিয় ক্রিকেটার। সাকিবকে নিয়ে তার উৎসাহ-উদ্দীপনা ও উচ্ছাসের কমতি নেই।
একথা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই যে,ভারতীয় ধারাভাষ্যকাররা ভারতীয় খেলোয়াড়দের সবসময় প্রশংসার বানে ভাসালেও তাদের দোষ-ত্রুটি নিয়ে খুব একটা সমালোচনা করেন না। তবে এখানেও হর্ষ ভোগলে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তিনি সবসময়ই চেষ্টা করেন সর্বোচ্চ নিরপেক্ষ ধারাভাষ্য প্রদানের জন্য। এছাড়া তিনি সবসময় ন্যায় ও যুক্তির পক্ষেই কথা বলেন,সেটি যার পক্ষে-বিপক্ষেই যাক না কেন। ঠিক এই কারণেই,২০১৬ সালের টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতীয় খেলোয়াড়দের সমালোচনা করায় ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড তাকে ধারভাষ্য প্রদান থেকে অব্যাহতি দেয়। এটি ছিল গোটা ধারাভাষ্য জগতের জন্যই অত্যন্ত নিন্দনীয় একটি ঘটনা। এটি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়। অবশেষে ১ বছর পর তাকে আবারও ধারাভাষ্যে ফেরাতে বাধ্য হয় ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড।
আরও পড়ুন:কোহলির বদলে রোহিতেই কি বদলাবে ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাস?
হর্ষ ভোগলের এত গুণাবলীর পেছনে অন্যতম কারণ হল,তিনি প্রচুর পড়তে ভালবাসেন। পেশাগত দায়িত্ব পালনের বাকি সময়টা তিনি কাটিয়ে দেন নানা বিষয়ের ওপর পড়াশোনা করে। এছাড়া ব্যক্তিগত জীবনে তিনি প্রচন্ড শৃঙ্খলা পরায়ণ। ভিন্ন ভিন্ন মানুষের চাহিদা ও মনোবৃত্তির ভেতরে প্রবেশ করতে তার জুড়ি নেই।
পৃথিবীতে বোধহয় এমন একজনও ক্রিকেটপ্রেমী নেই,যে কিনা হর্ষ ভোগলেকে পছন্দ করে না। শুধু হর্ষ ভোগলের ধারাভাষ্য শোনার জন্যই খেলা দেখতে বসে এমন দর্শকের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। হার্শা ভোগলে কোন সাবেক তারকা ক্রিকেটার নাইবা হতে পারেন; কিন্তু বিচক্ষণতা,সাবলীল বর্ণনার মাধ্যমে সহজবোধ্য বিশ্লেষণ ও অভিজ্ঞতার মিশেলে শুধু ধারাভাষ্য দিয়ে কোটি কোটি দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধের মত খেলার প্রতিটি মুহুর্তের সাথে সম্পৃক্ত করে রাখার গুণাবলীর কারণেই তিনি অন্য যেকোন ধারাভাষ্যকারের তুলনায় অনন্য ও অনবদ্য।