ভালবাসার টানে লখনৌতে


ভালবাসার টানে লখনৌতে : লিয়াকত হোসেন খোকনের ধারাবাহিক উপন্যাস

পর্ব – এক

মুরাদ বলল, ভালবাসা আছে, আমরা পাই না অনেক  খুঁজেও পাই না। ভালবাসা বোধহয় হীরে -মণিমুক্তা।

হাসতে হাসতে রাকিব – হায়রে নিঠুর ভালবাসা, প্রথম দেখায় লীলাকে প্রেম জানাতে, সে আমাকে যা শুনিয়েছিল – তা ছিল বড় বেদনার।

মুরাদ বলল, প্রেমট্রেম ভাল লাগে না, গরমে বড় অস্থির হয়ে পড়লাম যে।

যদি ধর প্রতিটি শহরে কিছুদূর অন্তর অন্তর পুকুর -দীঘি থাকত তাহলে এই মুহূর্তে পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়তাম। শহর নির্মাণের পরিকল্পনার সঙ্গে যারা জড়িত তারা আস্ত একটা গর্দভ। তাই শহরে নাই পুকুর, নাই বাগান, নাই গাছ গাছালি। একটার সঙ্গে আরেকটা লাগিয়ে ভবনের পর ভবন গড়েই উঠছে। ইট, বালু, সিমেন্ট, পাথর দিয়ে গড়া শহরে রয়েছে শুধু দুই নাম্বারিদের কারবারি। চাটুকার, দুর্বৃত্ত, দখলবাজ, মিথ্যুকদের ছড়াছড়ি।

ঈদের বাকি আর মাত্র কয়েকটা দিন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত হয়নি ঈদের কেনাকাটা। গত দু’বছরের মতো এবছরও ঈদে নতুন পোশাক হবে কি – না তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছে অনেক পরিবারই। পিরোজপুরের বেকুটিয়া, পাঙ্গাশিয়া,  সাতুরিয়া, নিলতি, ডুমজুরি,

চিরাপাড়ার মতো  এলাকার বহু প্রান্তিক পরিবারের অল্প বয়সী ছেলেরা ঈদে নতুন পোশাক কিনতে আইসক্রিম বিক্রি করছে। তাদের দলে আছে শাহরুখ সেখ, রাকেশ সেখ।

আইসক্রিমের কথা শুনে রাকিব বললো, গরমে টিকতে পারছি না, কোথায় পাব যে আইসক্রিম। গরমে যে ডাবের পানি খাব তাও সম্ভব হচ্ছে না।

এক একটা ডাবের দাম শত টাকার উপরে।

আরও পড়ুন: তোমরা রচিলে যারে নানা অলংকারে

মুরাদ – যারা ঈদের পোশাক কেনার জন্য আইসক্রিম বিক্রি করছে এই মুহূর্তে তাদের কারো কাছ থেকে আইসক্রিম কিনে খেতে ইচ্ছে করছে।

ঈদের পোশাক কেনার জন্য যারা আইসক্রিম বিক্রি করছে সেই সমস্ত ছেলেদের বয়স কারও নয় -দশ, তো কারও আবার বারো -তেরো। কেউ তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে, কেউ আবার ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণির পড়ুয়া।

মুরাদ -এই সব কচিকাঁচাদের দাবি, ঈদে নতুন পোশাক কিনতেই তারা আইসক্রিম, বরফ বিক্রি করছে। সাইকেলে করে প্লাস্টিক বা থার্মোকলের বাক্সে পলিথিন মুড়িয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায়, পাড়ার অলিতে -গলিতে বরফ, আইসক্রিম বিক্রি করতে দেখা যায়।

হঠাৎ এক ছেলের দেখা, তার কাছে রয়েছে আইসক্রিম। করিমপুরের বাসিন্দা শাহরুখ সেখ স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। বাবা সমিরুল সেখ রাজমিস্ত্রীর কাজ করেন। গত পরপর দু’বছর কাজ হারিয়ে বাড়িতেই ছিলেন তিনি। ফলে পরপর দু’বছর ঈদে হয়নি নতুন পোশাক।

শাহরুখ সেখের কাছ থেকে রাকিব ও মুরাদ আইসক্রিম কিনল।

শাহরুখ সেখ বলল, বাবা চট্টগ্রামে কাজ করে, ঈদের আগে তার আসার কথা ছিল। কিন্তু আসতে পারবে না। তা

ই কি আর করা, নিজের ও ছোট বোনের জন্য পোশাক কিনতে প্রায় মাসখানেক ধরে সকালে ও বিকেলে বরফ ও আইসক্রিম বিক্রি করছি।

হঠাৎ আরেকটি ছেলের আগমন, সেও আইসক্রিম বিক্রি করছে। ছেলেটির নাম রাকেশ সেখ, সে জুনিয়র হাইস্কুলের ছাত্র। বাবা শুকুর সেখ পেশায় টেম্পু চালক। স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে সংসার তার। কিন্তু সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় তাকে। ফলে তার ছেলে রাকেশও নতুন পোশাক কেনার টাকা যোগাড় করতে বিকেল হলেই বরফ, আইসক্রিম বিক্রি করছে।

রাকেশের আবদার সহকারে বলে , ওর কাছ থেকে যখন আইসক্রিম নিয়েছেন তখন আমার কাছ থেকে দু’টো আইসক্রিম নিন।

মুরাদ ও রাকিব ওর অনুরোধ ফেলতে পারল না।

ভালবাসার টানে লখনৌতে

 

রাকেশ টাকাটা হাতে নিয়ে ভীষণ আনন্দ অনুভব করে। বলে, পরীক্ষার জন্য মাঝেমধ্যেই স্কুল বন্ধ থাকছে, মাঝেমধ্যে স্কুল কামাই করেও আইসক্রিম বিক্রি করছি। যা রোজগার হবে তা দিয়েই সবার জন্য নতুন পোশাক কেনার ইচ্ছে রয়েছে।

প্রতিদিন খবরের কাগজে পাতায় – খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, রাহাজানি, নির্যাতন সহ কত কি অপরাধের ঘটনা। খাদ্যে ভেজাল, জীবনরক্ষকারী ওষুধও ভেজাল – মানুষ কি করবে? কোথায় যাবে? কার কাছে বিচার চাবে? বিচার পেতে উকিল, মহুরি, পেশকারের পিছনে ঘুরতে ঘুরতে জনম যাবে। লক্ষ লক্ষ টাকা যাবে…!

প্রশ্নটা তুললো, রাকিব।

জবাবে মুরাদ বলল, যদি এমন হত, অপরাধী ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিলে তখন আর মানুষ অপরাধের পথে পা বাড়াবে না। অপরাধ করতে তখন সাতবার  চিন্তাভাবনা করবে। আমাদের দেশে বিচারের ক্ষেত্রে সেই ব্রিটিশ শাসনামলের ঢিলেঢালা আইন থাকার কারণে অপরাধীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পার পেয়ে যাচ্ছে। সাক্ষী আনো, প্রমাণ আনো – কিন্তু কে সাক্ষী হবে, কে সাক্ষী দিতে যাবে – তার কি প্রাণের মায়া নেই? সাক্ষী দিতে গিয়ে গোষ্ঠীসহ মরবে নাকি! তাই বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।

রাকিব – যদি এমন হতো, অপরাধী ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার একটা আইন করা যেত?

মুরাদ – কে আইন রচনা করবে? কারো আগ্রহ নেই। আগ্রহ থাকার কথাও নয়। যারা ‘বুলডোজার দিয়ে অপরাধীর বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেওয়ার আইন করবে’ তারাই তো ফেঁসে পড়বে। কারণ, তাদের দলের লোক, তাদের আত্মীয় স্বজন তখন ফাঁটা বাঁশে আটকা পড়বে।

রাকিব – শুনেছি, ভারতের উত্তরপ্রদেশে রাষ্ট্রশক্তির প্রতীক এখন বুলডোজার। কিন্তু আইন -শৃঙ্খলা আর নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার প্রধান দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সেই রাষ্ট্র যদি নিজেই অগণতান্ত্রিক হয়ে উঠে বেপরোয়া শক্তি প্রয়োগ করতে থাকে, তখন সাধারণ জনজীবন দিশাহারা হয়ে পড়ে।

মুরাদ – গণতন্ত্র এ সন্ত্রাস পরস্পরবিরোধী। সেজন্যই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস সবচাইতে বিপজ্জনক। কেননা, রাষ্ট্রের চেয়ে বড় সংগঠিত শক্তি তো আর কেউ হতে পারে না। রাষ্ট্রের হাতেই পুলিশ বাহিনী। সংবিধানসন্মত শক্তি প্রয়োগের অধিকার তারই।

রাকিব – বুলডোজার দিয়ে আইনি শাসন গুঁড়িয়ে দেওয়ার বৈধতা অর্জন করেছিল উত্তরপ্রদেশে। ‘আইন তার নিজের পথে চলবে’ এই বুলি কপচিয়ে ফেক নিউজের কারবারিরা আর হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির পড়ুয়ারা বুলডোজারের রাজনীতিতে একান্ত আপন করে নিয়েছিলেন সে রাজ্যে।

মুরাদ – অবশ্যই সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সৌজন্যে। তারপর ‘একে একে নিভিয়ে দেউটি’। উত্তরপ্রদেশের বুলডোজার মডেলের ‘কাট -পেষ্ট’ সংস্করণ দেখা দিল গুজরাটে এবং মধ্যপ্রদেশে।

রাকিব – উভয় রাজ্যেই যে বিধানসভা নির্বাচন ১৮ মাস পরেই। আর সম্প্রতি সেই বুলডোজারের রাজনীতির দাপুটে নষ্টামি পৌঁছে গেল ভারতের রাজধানী দিল্লিতে।

মুরাদ – দিল্লির সংখ্যালঘু অধ্যুষিত জাহাঙ্গীরপুরীতে একে একে গুঁড়িয়ে ফেলা হয়েছে বাড়ি, দোকানপাট, সংখ্যালঘুদের ধর্মস্থানের প্রবেশদ্বার। বুলডোজার দিয়ে এই সর্বাত্মক ধ্বংস অভিযানে চালিকাশক্তি রাষ্ট্র। সরকার, পুলিশ ও পুরসভার যৌথ উদ্যোগ।

রাকিব – আর এবার ভারতে বুলডোজার হয়ে উঠল সংখ্যালঘু নিষ্পেষণের দর্পিত যন্ত্র। এখন আর ভোট, সরকারি প্রকল্প বা নীতির দরুন কতটা লাভবান হল আমজনতা, তার বিচারে হয় না। ভোট হয় সাম্প্রদায়িক ইস্যুকে সামনে রেখে।

মুরাদ – এখন খুল্লম খুল্লা গেরুয়া অস্ত্রধারীরা হুমকি দেয় সংখ্যালঘু পেটানোর। আবার এসবের মধ্যেও, ভয় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস আর অসহিষ্ণু আবহের ভেতরেও, রয়ে যান রাজস্থানের কারাউলির মধুলিকা রাজপুত যিনি ডজন খানেক সংখ্যালঘু যুবকের প্রাণ বাঁচান উন্মত্ত সংহারকামী জনতার হাত থেকে, নিজের প্রাণের মায়া ত্যাগ করে।

রাকিব – তারই মতো আছে আরও ভাল মানুষ। যেমন, জাহাঙ্গীরপুরীর সেই তরুণ দোকানি যিনি জোর গলায় সাংবাদিকদের বলেন ‘আমি হিন্দু আর ও মুসলমান, তাতে কী! আমরা তো বন্ধু। দুঃসময়ে একে অপরকে সাহায্য করি। বুলডোজার যদি মসজিদ গুঁড়িয়ে দিতে আসে, সেটার সামনে একলা হলেও, রুখে দাঁড়াব। দাঁড়াবই ‘।

মুরাদ – শুধু ভারতে নয়, গোটা ভারতবর্ষে বা উপমহাদেশ জুড়ে হিংসাটাই দস্তুর। এই উপমহাদেশের সহস্র বর্ষের ইতিহাসে মহাবীর, যুদ্ধ, অশোক, গান্ধী, ফজলুল হক – এঁদের শান্তির বাণী নাকি নেহাতই ব্যতিক্রমী পরম্পরা।

সেই হিংসা আবার আসছে দুর্নিবার গতিতে, বুলডোজারের স্পর্ধায়।

রাকিব – হতবল সহিষ্ণুতার শিথিল অর্গল ভেঙে হরণ করতে চাইছে জীবনের গৌরবের রূপ। এই ধৃস্ত প্রতিবেশে মধুলিকা রাজপুত কিংবা জাহাঙ্গীরপুরীর দোকানির মতো মানুষজনের শুভবুদ্ধির বলয়ই উপমহাদেশীয় ধর্মনিরপেক্ষতা ও সনাতন

সহিষ্ণুতার শেষ আশ্রয়।

ভালবাসার টানে লখনৌতে

মুরাদ – এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমাদের দেশ না। এই রক্তস্নাত কসাইখানা আমার  – তোমার – আমাদের -তোমাদের দেশ না, এ সব বলেটলে নিরাপদ প্রতিবাদের নিস্ক্রিয় আলস্যে সঁপে দেওয়াটাকেই আমরা যদি ফের চরম নাগরিক দায়িত্ব জেনে নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকি, তবে একটি দেশ হয়তো থাকবে, নিজস্ব সংস্কৃতি যাবে হারিয়ে।

রাকিব – এইটুকু, স্রেফ এটুকু যেন আমার ভুলে না যাই।

মুরাদ – নিউমার্কেট এলাকায় সংঘর্ষে নাহিদ হত্যা ঘটনায় ঢাকা কলেজের ৫ ছাত্র দুদিনের রিমান্ডে। এরকম রিমান্ডের ঘটনা কি নতুন? এর আগে বহু অপরাধীদের রিমান্ডের ঘটনা ঘটেছে। যাঁদের নেয়া হয় রিমান্ডে, তারা কি সৎ পথে ফিরে আসছে?

রাকিব – আসে নাই। যে খাদ্যে ভেজাল দেয়, তাকে জরিমানা করার পরেও সে ভেজাল দিয়েই যাচ্ছে। ভেজাল ওষুধ বিক্রেতাদের জরিমানা তো কম করা হয়নি। তারপরও সোজা হচ্ছে না ফার্মেসীর মালিক দাড়ি-টুপি ওয়ালারা।

আরও পড়ুন:
ধারাবাহিক নাটক: রাম রহিমের প্রেম

মুরাদ – চারিদিকে নির্যাতন, চারিদিকে অপপ্রচার – একজন মুসলিম মন্দিরে কোরান রেখে হিন্দুদের নামে অপবাদ দেয়, ফেসবুকে প্রচার করে গুজব ছড়িয়ে দেয়। সেই গুজবের ঠ্যালায় অসভ্যের মতো সনাতন ধর্মের মানুষের বাড়িঘর লুটপাট করে অগ্নিসংযোগ করে মানুষ পুড়িয়ে মারে।

রাকিব – সবখানে রয়েছে কতিপয় অমানুষ, তাদের জন্যই বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয় – সেখানে গড়ে তোলা হয় রামমন্দির। কেন মসজিদটি থাকলে কি সমস্যা হত , পাশে না হয় রামমন্দির স্থাপন করা যেতো। আসলে ভাঙাভাঙি করে একদল গড়েছে তীর্থ হাটের হাতিয়ার – সেই তালিকায় উন্নাও, হাথরস, আগ্রা, কানপুরের সঙ্গে যুক্ত হল

প্রয়াগরাজ – তীর্থের নাম যোগীতীর্থ।

ভালবাসার টানে লখনৌতে

 

মুরাদ – আরেক দল করছে  অত্যাচার, নির্যাতন।

ভয় -ভীতি দেখিয়ে দেশ ছাড়া করতে বাধ্য করছে। যে জন্য ৩৩ পার্সেন্ট থেকে আজ ৮ পার্সেন্ট। যারা চলে গেছে তাদেরকে ফিরিয়ে আনলে কেমন হতো! সত্যি যদি এমন হতো!

রাকিব – যৌতুকের জন্য স্ত্রীর গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন, স্বামী গ্রেফতার। কি হবে?

মুরাদ – কয়েকদিন পর এ-ও তো হতে পারে, জামিন নিয়ে নতুন বিয়ে করে আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আবার মেয়রও হয়ে যেতে পারে। সবই সম্ভব।

রাকিব – গরমের তাপদাহে অস্থির লাগছে। চল যাই, দূরের কোথাও মরা নদীর ঘোলা পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ি। খাল তো আর নাই, যেখানে ছিল খাল সেখানে এখন বড় বড় দুর্নীতিবাজ সাহেবদের অট্টালিকা।

মুরাদ – হায়রে পানির বড় অভাব।