বিরাট কোহলির জায়গায় রোহিত শর্মাকে ভারতীয় ওয়ানডে দলের অধিনায়ক করার ঘটনায় তোলপাড় পুরো ক্রিকেটবিশ্ব। আলোচিত এই সিদ্ধান্তে অবাক হয়েছেন অনেক ক্রিকেটপ্রেমীই। কোহলির বদলে রোহিতেই কি বদলাবে ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাস? এই বিরাট পরিবর্তন কতটা যৌক্তিক,তা নিয়েই চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
ক্রিকেটার কিংবা ব্যাটসম্যান কোহলি যে বিশ্বের অন্যতম সেরা,সেটি নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। যখন যেখানেই খেলেছেন,রানবন্যার ফুলঝুরি ছুটিয়েছেন। প্রায় প্রতি ম্যাচেই রেকর্ড ভেঙেচুরে নিজেই নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন। কঠোর পরিশ্রমী,নিবেদিতপ্রাণ ও আগ্রাসী চরিত্রের কারণেই মহেন্দ্র সিং ধোনির পর অধিনায়কত্বের দায়িত্ব তুলে দেয়া হয় কোহলির কাঁধে।
অধিনায়ক হিসেবে কোহলি কেমন? সেটি বোঝার জন্য পরিসংখ্যানই যথেষ্ট। ওয়ানডে দলকে নেতৃত্ব দেয়া ম্যাচে ভারতের জয়ের হার ৭০ শতাংশ! যেটি কিনা সকল ভারতীয় অধিনায়ক তো বটেই,বিশ্বের অন্য যেকোন অধিনায়কের তুলনায় সবচেয়ে বেশি। অধিনায়ক কোহলি যেন আরো এক পরিপক্ব ক্রিকেটার। প্রতিটি ম্যাচেই জেতার জন্য নিজের সাথে সাথে সতীর্থদের কাছ থেকে শতভাগ নিংড়ে বের করে আনার অনন্য গুণে গুণান্বিত তিনি। এখানেই নির্ভরতা খোঁজা হচ্ছে কোহলির বদলে রোহিতেই।
যার হাত ধরে এত সাফল্য রচিত হল,সেই কোহলিকেই কিনা এবার ছাড়তে হল ওয়ানডে দলের অধিনায়কত্ব? বলা ভাল,ছাড়তে বাধ্য করা হল। অন্তত ভারতীয় শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমগুলো তাইই বলছে। তারা বলছে,বরখাস্ত করা হয়েছে কোহলিকে। কিন্তু হঠাৎ কেন এই সোনার ডিম পাড়া হাঁসকে এভাবে ছেঁটে ফেলা হল অধিনায়কত্ব থেকে? কোহলির বদলে রোহিতেই বদল হল অধিনায়কত্ব?
এর পেছনে কারণ খুঁজতে গেলে দেখা যাবে যে,বৈশ্বিক আসর অর্থাৎ আইসিসি ইভেন্টগুলোতে কোহলির নেতৃত্বে একটি শিরোপাও জিততে পারেনি ভারত। যার মধ্যে রয়েছে- ২০১৫ বিশ্বকাপ,২০১৬ টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ,২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি,২০১৯ বিশ্বকাপ ও সর্বশেষ ২০২১ টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। তবে,ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের দিক দিয়ে এই আসরগুলোতে কোহলি ছিলেন বরাবরের মতই অনবদ্য। পরিসংখ্যানই তার হয়ে কথা বলছে।
৩টি ওয়ামডে বিশ্বকাপে ২৬ ম্যাচে প্রায় ৪৭ গড়ে ১০৩০ রান করেছেন কোহলি। ৪ টি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ২১ ম্যাচে প্রায় ৭৭ গড়ে রান করেছেন ৮৪৫। আর চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ১৩ ম্যাচে ৮৮ গড়ে রান করেছেন ৫২৯।
তবে,বৈশ্বিক আসরগুলোর নক আউট পর্বের ম্যাচগুলোতে নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি কোহলি। করেছেন সাদামাটা পারফরম্যান্স। হয়তোবা সেটা চাপের কারণেই। যার মধ্যে সর্বশেষ টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের কাছে রীতিমতো বিধ্বস্ত হওয়া,এরপর নিউজিল্যান্ডের কাছেও হেরে গিয়ে ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথমবারের মত সুপার টুয়েলভ থেকেই বাদ পড়ে যাওয়াটা কোনভাবেই মেনে নিতে পারেননি ভারতীয় সমর্থকরা। যদিও বিশ্বকাপের আগে কোহলি নিজেই জানিয়েছিলেন বিশ্বকাপের পর তিনি আর টি টোয়েন্টি দলের দায়িত্বে থাকছেন না। কিন্তু বিশ্বকাপের এমন ভয়াবহ ভরাডুবির মাশুল গুনতে হল এবার ওয়ানডে অধিনায়কত্ব হারিয়ে। কোহলির বদলে রোহিতেই ইতি টানা হল অধিনায়কত্বের।
সব মুদ্রারই এপিঠ-ওপিঠ দুটিই থাকে। কাজেই উপরোক্ত ব্যর্থতার পেছনে কোহলির যেমন দায় আছে,তেমনি সেসব পরিস্থিতিতে তার সতীর্থরাও পর্যাপ্ত সঙ্গ দিতে পারেননি-এটিও শতভাগ সত্য। আর ঠিক এ কারণেই বোধহয় কোহলি স্বেচ্ছায় ওয়ানডে অধিনায়কত্ব ছাড়তে চাননি। তাকে অধিনায়কত্ব থেকে একপ্রকার বরখাস্তই করেছে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড। কোহলির বদলে রোহিতেই ভরসা খুঁজছেন তারা।
কোহলির বদলে রোহিতেই সমাধান দেখছেন ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড। যেটি ভারতীয় ক্রিকেট সমর্থকদের অনেকদিনের দাবি। আইপিএলে সবচেয়ে বেশি ৫ বার শিরোপাজয়ী অধিনায়ক রোহিত। এছাড়া কোহলির অনুপস্থিতিতে অধিনায়কের দায়িত্বটা রোহিতই সামলান। ফলে,নতুন দায়িত্বটা তার কাঁধে যাওয়াটা বেশ অনুমেয়ই ছিল। তবে নতুন অধিনায়ক রোহিত শর্মার নেতৃত্বে বৈশ্বিক আসরে ভারত কোন শিরোপা জিতবেই- এমনটা জোর দিয়ে বলার কোন সুযোগ নেই। কেননা বৈশ্বিক আসরে যেখানে কোহলির মত ইস্পাত-কঠিন মনোবলের অধিনায়কও চাপের মুখে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন,সেখানে রোহিত শর্মা কতটা চাপ সামাল দিতে পারবেন,সেটিই দেখার বিষয়।
আরও পড়ুন: যুবা টাইগারদের হাত ধরেই আবার ঘুরে দাঁড়াক দেশের ক্রিকেট
আরও পড়ুন: সাকিব আল হাসান যেসব রেকর্ড গড়লেন নতুন করে
ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের এমন আচমকা সিদ্ধান্তে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে ক্রিকেট বিশ্লেষক ও সমর্থকদের মধ্যে। অনেকেই বলছেন,এটি মোটেই কোন সৌজন্যমূলক সিদ্ধান্ত হয়নি। কেননা,এটি কোহলির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে,যার প্রভাব পড়তে পারে তার পারফরম্যান্সেও। কোহলির মত কিংবদন্তি ক্রিকেটার আরো বেশি সম্মান পাওয়ার দাবিদার। তাকে এভাবে হঠাৎ অধিনায়কত্ব হতে ছাঁটাই করা বেশ দৃষ্টিকটু। আবার আরেকদল মনে করেন যে,এই পরিবর্তনটি ভারতের জন্য অত্যাবশ্যক ছিল। কোহলির বদলে রোহিতেই আস্থা ও নির্ভরতা রাখাটা সঠিক সিদ্ধান্ত।
এই আলোচিত সিদ্ধান্ত ভুল নাকি সঠিক,তা সময়ই বলে দেবে। তবে পুরো প্রক্রিয়াটি আরো স্বচ্ছ ও দৃষ্টিনন্দনভাবে বাস্তবায়ন করা যেত কিনা,সেই প্রশ্ন কিন্তু রয়েই গেলে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের কাছে ।