বাংলা সিনেমা জগতে ঝড় উঠেছে তারকাদের বিয়ে আর বাচ্চা নিয়ে


বাংলা সিনেমা কিংবা প্রেক্ষাগৃহের সামনে দর্শকের ভিড়ভাট্টা আজ কোথায়?

‘চলিতেছে কি ছবি ?’ প্রশ্নটি শুনে হতভম্ব ছেলেটি। আস্তে করে ছেলেটি বলল, ‘জানি না’। পরবর্তী আকর্ষণ কি?
উত্তর ‘জানা নেই’। আসিতেছে কি ছবি? ছেলেটি একটু বিরক্ত হয়ে জবাব দেয়, ‘ভবিষ্যৎ অন্ধকার’। ‘ছবির পরিচালক কে?’ এ প্রশ্নটি করতেই ছেলেটির জবাব, ‘রেজওয়ান ঝন্টু’। প্রশ্নকর্তা ভাবল , রেজওয়ান ঝন্টু আবার কে?
এবার ছেলেটি দৌঁড় দিয়ে অন্যত্র চলে গেল।
তবে আজকাল কেউ আর ছবির নাম বলেন না, সবার মুখে এখন একটি কথা, ‘সাকিব খান’। কেউ কেউ বলেন, তিনি সুপারস্টার। বুবলিকে কেউ কেউ বলেন, ‘এ সময়ের আলোচিত নায়িকা’। কেউবা বলেন, ‘অপু বিশ্বাস ট্রাজেডি কুইন। তবে অভিনয়ের জন্য নন, তিনি গোপনে বিয়ে করে, গোপনে বাচ্চা জন্মদান করেছিলেন। আর অবশেষে বাস্তব জীবনে  ডিভোর্স হয়ে হয়েছেন তিনি ট্রাজেডি কুইন অফ পারসোনাল লাইফ’।
ঢাকার সিনেমার অবস্থা আজ এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে যে, এখন আর কেউ এ সময়ে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির নাম সম্পর্কে আর ততটা অবগত নন। যেন অজ্ঞাত।
তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় আর ইউটিউবে আজকাল নানান ধরনের লোকের ভিডিও পোস্টগুলি দেখলে মনে হয়, এরা সাকিব খান, অপু বিশ্বাস, পূজা চেরি, বুবলি সহ এ সময়ের চিত্রতারকাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আলোচনা করতে যেন অতি উৎসাহী। যেন তারা হয়ে গেছেন মহা পণ্ডিত, তারকাদের পারসোনাল লাইফ নিয়ে বক্তব্য দিতে দিতে। সেটা কতভাগ শুদ্ধ তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। ছবি দেখেন ক’জনে? ছবি দেখার চাইতে সবাই যেন ব্যতিব্যস্ত সোশ্যাল মিডিয়ায় তারকাদের নামে কুৎসা – গীবত গাইতে বা ছড়াতে । বানিয়ে বানিয়ে আপত্তিকর বিভ্রান্তিকর মন্তব্য করা যেন সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি চক্র যেন আজ উঠেপড়ে লেগেছে।
তারকাদের কুচরিত্র প্রচার প্রচারণায় সোশ্যাল মিডিয়া আজ সরব। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, সিনেমা দর্শকেরা কি এখন ছবি নিয়ে আলোচনা করার চাইতে তারকাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ঘাটাঘাটিটা কি বেশি পছন্দ করছেন?
একটা সময় গেছে, দর্শকের মুখে মুখে ছিল আজিম –
সুজাতা অভিনীত ‘মধুমালা’, ‘রাখাল বন্ধু’, ‘ডাকবাবু’, ‘আমির সওদাগর ও ভেলুয়া সুন্দরী’, ‘সাইফুল মুলক বদিউজ্জামাল’, ‘মেঘ ভাঙা রোদ’ ; রহমান -শবনম অভিনীত ‘হারানো দিন’, ‘চান্দা’, ‘তালাশ’ ; রাজ্জাক – কবরী অভিনীত ‘রংবাজ’ ; রাজ্জাক – সুচন্দা অভিনীত ‘জীবন থেকে নেয়া’, ববিতা অভিনীত ‘অশনি সংকেত’, ‘অনন্ত প্রেম’, ‘বসুন্ধরা’, ‘ডুমুরের ফুল’ সহ শতাধিক ছবির কাহিনী, তারকাদের অভিনয়, গানের শিল্পীদের নিয়ে আলোচনা -সমালোচনার ঝড় বয়ে যেত ।
চলচ্চিত্রের সেদিন আর নেই! নেই গুলিস্তান – শাবিস্তান।
ঢাকার সিনেমার নায়িকাদের ছবি দেখা নিয়ে আজ দর্শকদের আগ্রহ কোথায়? শুধু আগ্রহ কি কার ক’টা বিয়ে হয়েছে? কার ক’টা বাচ্চা হয়েছে — এই নিয়ে কি?
আশা – আকাঙ্খা থাকে কিন্তু এ প্রজন্মের চিত্র
নায়ক -নায়িকারা কি ফুল হয়ে সিনেমা দর্শকদের কি সুভাস ছড়িয়ে দিতে পারছেন? হতে কি পারছেন ফুটন্ত ফুল! দর্শক তো আগের মতো আর নেই – এ প্রজন্মের নায়ক -নায়িকারা বিকশিত হওয়ার সুযোগই তো পাচ্ছেন না। আবার কিনা সুপারস্টার?
একটা যুগ গেছে সুজাতা, কবরী, শাবানা, ববিতা, রাজ্জাক, সোহেল রানা, উজ্জ্বল  নাম শুনতেই জনতার ঢল নামত প্রেক্ষাগৃহের সামনে।
জনতা আজও কি ভুলতে পেরেছে – প্রতিনিধি, জীবন মরণ, অবুঝ মন, টাকার খেলা, মেঘ ভাঙা রোদ, আলিবাবা, সাহেব বিবি গোলাম, অশ্রু দিয়ে লেখা, লাল কাজল, ভাত দে, গোলাপি এখন ট্রেনে, নয়নমণি, কাজলরেখা, বন্ধু, সমাধি, পাগলা রাজা, মৌচোর আরও কত কি ছায়াছবির কথা!
সেদিনের কিছু তারকার  নাম বাঙালি সিনেমা দর্শকদের
হৃদয়ে এক একটি ফুল হয়ে গেঁথে রইল। আজও অনেকে বলেন, হৃদয়ের অতল গভীরে গোলাপ নয়তো  সূর্যমুখী বা  রজনীগন্ধা হয়ে ফুটে রইল – চিত্রতারকারা। তারাই ছিলেন সত্যিকার অর্থে অভিনেতা  – অভিনেত্রী
ও তারকা। জীবনের পড়ন্ত বেলায় এফডিসির পানে তাকালে মনে হয় – সুজাতা, কবরী, সুমিতা দেবী, রহমান, শওকত আকবর, আজিম, রাজ্জাক, উজ্জ্বল, ফারুক, আলমগীর, সোহেল রানা নামের ফুলগুলি ফুটে অতীতের
গৌরবময় সাফল্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে কি
যাচ্ছে না!
কে শ্রেষ্ঠ ববিতা না শাবানা ? দর্শকরা ছবি দেখে এই নিয়ে আলোচনায় সরব হয়ে উঠত প্রেক্ষাগৃহের সন্মুখে -সন্মুখে।
কখনওবা হোটেলে -রেস্তোরায় টেবিলে স্ব জোরে
হাত চাপিয়ে চাপিয়ে।
অবুঝ মন
কাজী জহির পরিচালিত অবুঝ মন ছবির পোষ্টার
কাজী জহির পরিচালিত অবুঝ মন ছবিটির কথা আজও অনেকে ভুলতে পারেননি বোধহয়।  ছবিটি সুপার ডুপার হিট হয়েছিল – এই ছবি দেখে বিশেষ করে মহিলা দর্শকরা প্রেক্ষাগৃহে বসে দুই নয়নের জল মুছে ছিলেন। সেদিন দর্শকের মুখে মুখে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল, ছবির কাহিনী নিয়ে। ছবিতে সুজাতার অসাধারণ অভিনয় আজও অনেকের স্মৃতিতে জ্বল জ্বল করছে। তিনি ছিলেন রাবেয়ার চরিত্রে। চিত্রা জহির প্রযোজিত অবুঝ মন ছবিতে অভিনয় করেছিলেন – রাজ্জাক, সুজাতা, শাবানা, শওকত আকবর, নারায়ণ চক্রবর্তী, হাসমত, খান জয়নুল, সাইফুদ্দিন, খলিল, তেজেন চক্রবর্তী, জাভেদ রহিম, মজিদ, দীন মোহাম্মদ, শেখ ফজলু, ওয়াহিদা, এ টি এম শামসুজ্জামান। এই সব তারকার নাম তখন সবার মুখে প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সুরকার আলতাফ মাহমুদ অসাধারণ সুর সৃষ্টি করেছিলেন বলে তাঁকে নিয়েও আলোচনা হতো।
গীতিকার – ডঃ মনিরুজ্জামান ও গাজী মাজহারুল আনোয়ারও ছিলেন আলোচনার টেবিলে টেবিলে।
‘শুধু গান গেয়ে পরিচয় চলার পথে ক্ষণিক দেখায়’ –
এই গানটি সহ সেদিনের কত গান তখন ছিল সবার মুখে মুখে। ‘অবুঝ মন’ ছবিতে রাজ্জাক ছিলেন মাসুমের চরিত্রে। ছবির নায়ক মাসুম তার বন্ধু বিজয়ের সাহায্যে পড়াশোনা করে ডাক্তারি পাস করে গ্রামে যাবে ডাক্তারি করার জন্যে। গ্রামে যাওয়ার পথে ট্রেনে মাসুমের পরিচয় হয় জমিদারের মেয়ে মাধবীর সঙ্গে – তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক। মাধবীর বাবা জমিদার, তাই এই প্রেমে বাধা হয়ে দাঁড়ালেন জমিদার। নিরুপায় হয়ে এক সময় মাসুম গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। সেই সুযোগে জমিদার তার কন্যা মাধবীকে বিয়ে দেয় বিজয়ের সঙ্গে – এ ভাবে ছবির গল্প এগিয়েছিল বলে আজও অনেকে
মনে করেন ‘অবুঝ মন’।
দর্শকরা ছবি দেখে ছবিটি ভাল হয়েছে না মন্দ হয়েছে – এ নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করত। সেদিন কোনো দর্শক তারকার চরিত্র নিয়ে টানাহেঁচড়া করেনি।
আজ ছবি নিয়ে কোনো আলোচনার ঝড় ওঠে না ; প্রেক্ষাগৃহের সামনে ভিড়ও দেখা যাচ্ছে না। ছবি দেখা, ছবির গল্প নিয়ে আলোচনা যেন থমকে গেছে।
ছবি হিট তখনই হয়, যখন দেখা যায় দর্শকরা ধাক্কাধাক্কি করে টিকিট কেটে প্রেক্ষাগৃহে প্রবেশ করে। কিন্তু তা আজ কোথায়?
ছবির সমালোচনা করা ; ভালমন্দ নিয়ে তর্কবিতর্ক করা তো দূরের কথা – সবাই যেন সোশ্যাল মিডিয়ায়
এক একটা ফলোয়ার খুলে ; কেউবা একটা চ্যানেল সৃষ্টি করে বা ইউটিউবের মাধ্যমে তারকাদের সম্পর্কে একটু খুঁত পেলে তা নিয়ে অসত্য কথা জুড়ে দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াকে আজ পচিয়ে কি দিচ্ছে না? যার খুশি সে তার পছন্দের একজনকে সুপারস্টার বলে যাচ্ছে,  সে যা নয় তার বেশি প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
তবে কি সোশ্যাল মিডিয়া হয়েছে আজ তারকাদের চরিত্র হনন ও গুজবের শক্তিশালী মাধ্যম?