পেরু আদিবাসী সম্প্রদায় আর ইনকা সভ্যতার নিদর্শন নিয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে। পেরুর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আর সমৃদ্ধ অতীত পর্যটকদের মুগ্ধ করে। পর জনমে যেন আমার জন্ম হয় পেরুতে – এমন আকুলতা প্রকাশ করেছেন দুই বাংলার অন্যতম সেরা ভ্রমণ লেখক লিয়াকত হোসেন খোকন।
Table of Contents
দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরু। প্রশান্ত মহাসাগরের তীরবর্তী এ দেশটির ভূপ্রকৃতিতে চরম বৈপরীত্যের সহবস্থান পরিলক্ষিত হয়। পেরু দেশে আছে জনবিরল মরুভূমি, বরফাবৃত পর্বতমালা, উচ্চ মালভূমি আর গভীর উপত্যকা। আন্দিজ পর্বতমালা পেরিয়ে দেশের অভ্যন্তরে রয়েছে ঘন ক্রান্তীয় বনাঞ্চল।
পেরুতে জনবসতি তেমন ঘন নয়। প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে অবস্থিত লিমা শহরটি পেরু রাষ্ট্রের প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র ও রাজধানী। ১৫৩৫ খ্রিস্টাব্দে স্পেনিশ নাগরিক ফ্রান্সিসকো পিজারো লিমা আবিষ্কার করেন। এর আগে দক্ষিণ আমেরিকার বিস্তৃত ইনকা সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল পেরু।
পেরু কখন স্বাধীনতা লাভ করে?
১৬শ শতকে স্পেনের বিজেতাদের হাতে ইনকা সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। এখানের আন্দিজের স্বর্ণ ও রূপার খনির আকর্ষণে স্প্যানিশরা খুব শীঘ্রই পেরুকে দক্ষিণ আমেরিকাতে তাদের সম্পদ ও শক্তির কেন্দ্রে রূপান্তরিত করে। ঊনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে স্থানীয়রা স্প্যানিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ১৮২১ সালের ২৮শে জুলাই স্বাধীনতা লাভ করে।
পেরুর আয়তন
পেরুর মোট আয়তন ১২ লাখ ৮৫ হাজার ২১৬ বর্গকিলোমিটার।
পেরুর নাজকা মরুভূমিতে যদি একটি বিমান নিয়ে উড়ে যাওয়া যায়, তাহলে হয়তো অপেক্ষা করবে এক অপার বিস্ময়। ককপিট থেকে দেখা যাবে মরুভূমির বুকে আঁকা অসংখ্য আঁকিবুঁকি, জ্যামিতিক নকশা আর পশু -পাখির ডিজাইন।
পেরুতে গিয়ে প্রথমে সে দেশের রাজধানী শহর লিমা ঘুরে দেখুন। এখানের অন্যতম দর্শনীয় স্থান হল সপ্তদশ শতাব্দীর স্থাপত্যের নিদর্শনগুলো। পুরনো আমলের সিটি অফ কিংস -এ রকম বহু নিদর্শন আছে। পরদিন লিমা থেকে কুজকো যাত্রা করুন।
পথে দেখে নিবেন সিক্রেট ভ্যালিতে ইনকাদের শহর। এখানকার পিসাক মার্কেটে স্থানীয় শিল্পীদের হস্তশিল্পের পসরা অবশ্যই দেখবেন। লাঞ্চ করবেন উরুবাম্বা নামক উপত্যকা শহরে। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বড়ই নয়নাভিরাম। নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতে দেখতেই কুজকো পৌঁছে যাবেন। রাতে সেখানেই বিশ্রাম নিন।
মাচুপিচু
পরদিন মাচুপিচু যাত্রা করুন। মাচুপিচুতে ইনকা সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ দেখতে গোটা দিনই লেগে যাবে। আন্দিজ পর্বতমালার পেরুর অংশে একটি পর্বতের চূড়ায় অবস্থিত ইনকাদের হারানো শহর মাচুপিচু। সুরক্ষিত শহরটি পর্বতের চূড়া থেকে একেবারে খাড়া উঠে গেছে আরও কয়েক হাজার ফুট উঁচুতে। দুই দিক দিয়েই নিরাপদ মাচুপিচু শহরটিকে ইনকাদের প্রাচীন দুর্গনগরী নামেও ডাকা হয়।
পেরুর আজকের স্থানীয়দের বেশির ভাগই ইনকা বা অন্য আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত। ইনকাদের ভাষা কেচুয়া। এর সঙ্গে সম্পর্কিত আরেকটি ভাষা আইমারা স্প্যানিশ ভাষার পাশাপাশি দেশটির সরকারি ভাষার মর্যাদা লাভ করেছে।
মাচুপিচুর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলি আবিস্কৃত হয় ১৯১১ খৃষ্টাব্দে। এটি আবিস্কারের আগে ওয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রীয় ঐতিহাসিক ও অধ্যাপক হিরাম বিংহাম পেরুর প্রাচীন ভিলকাবাম্বা ধ্বংসাবশেষের গুজবের তদন্তে ঘন অরণ্যের মধ্যে গিয়েছিলেন। তাদের দলে নেতৃত্বে থাকা একজন ব্যক্তি বৃহৎ প্রত্নতাত্ত্বিক এই স্থানটিতে গিয়ে হোঁচট খায়। এর পরই মাচুপিচুর উদঘাটন শুরু হয়। পাহাড়ের ওপরে এখানের দুর্গটি কোনও চুন -বালি মিশ্রণ ছাড়াই পাহাড়ের ঢাল কেটে নির্মিত হয়েছিল। যা কি-না এখনকার পর্যটকদের কাছে রীতিমতো বিস্ময়কর।
মাচুপিচু শহরে বেড়াতে গিয়ে ট্রেনেই লাঞ্চ করবেন। সারাদিন ঘুরেফিরে দেখার পর ট্রেনেই কুজকো ফিরবেন। পরদিন ফের ট্রেন যাত্রা করুন টিটিকাকা হ্রদ দেখবার জন্য। টিটিকাকার কাছে পুনো শহরে পৌঁছে হোটেলে চেক -ইন করুন। নিজের মতো বৃহদায়তন লেকের আশেপাশে ঘুরে বেড়িয়ে দিন কাটান। প্রয়োজনে টিটিকাকা লেকে এক্সকারশন করুন। দেখবেন লেকটাউন বা উরোস আইল্যান্ড, চাকিল আইল্যান্ড ইত্যাদি। এখানকার আদিবাসীদের জলের ধারের জীবনযাপন ও তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয়ও হবে। রাতে থাকবেন পুনোতেই।
রাজধানী লিমা থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দক্ষিণে নাজকা এবং পালমা শহরের মাঝামাঝি স্থানে প্রায় ৫০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এখানের অসাধারণ শিল্পকর্ম। এখানে আঁকা চিহ্নগুলোর মধ্যে রয়েছে জ্যামিতিক নকশা, হামিংবার্ড, মাকড়সা, বানর, হাঙ্গর আর নানা ধরনের সরীসৃপের রেখাচিত্র। নাজকা লাইনের বহু চিত্রের মধ্যে এক অন্যতম হল কোন্ডোর। নাজকা লাইনস গবেষকদের জন্য একটি রহস্য , দর্শকদের জন্য একটি বিস্ময়কর সৌন্দর্য এবং ঐতিহাসিকদের জন্য একটি উৎসাহী প্রতিদ্বন্দ্বিতা তো বটেই।
ভ্রমণ নিয়ে আরও পড়ুন: কৃষিপ্রধান দেশ আর্জেন্টিনার যত নাম মেসিকে ঘিরে
চিত্রগুলো বিমান থেকে বা স্যাটেলাইটে স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। প্রায় ১৮০ টির মতো নকশা রয়েছে এখানে। শ’খানেক জ্যামিতিক চিত্র বাদে বাকিগুলো পশু -পাখিদের প্রতিলিপি। ১৯৩০ এর দশকে সর্বপ্রথম বিমানযোগে ওই মরুভূমি পার হওয়ার সময় এ লাইনগুলো আবিস্কৃত হয়। এরপর থেকে এ নিয়ে চিন্তা ও গবেষণার শেষ নেই।
গবেষকদের ধারণা, নাজকা সম্প্রদায়ের লোকেরা কাঠ ও কাঠজাতীয় সরঞ্জামাদি দিয়ে এ রেখাগুলো এঁকেছে। অনেকগুলো রেখার শেষপ্রান্তে কিছু কাঠের উপকরণ পাওয়া গিয়েছে, যা থেকে কার্বন টেষ্টের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা ওই রেখা অঙ্কনের সময়কাল বের করেছেন।
ইউনেস্কো ১৯৯৪ সালে পেরুর এই নাজকা লাইনসকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করেছে। সারা পৃথিবীর অসংখ্য ট্যুরিস্ট আজও আসেন এ বিস্ময়কীর্তি দেখার জন্য।
পেরুর হুয়াকাচিনার মরুদ্যান শহর হুয়াকাশিনা একটি মরুদ্যান যা বায়ু দ্বারা সৃষ্ট বালিয়াড়ির কেন্দ্রে অবস্থিত। এই মরুভূমি উপহ্রদ বৃত্তাকার ভাবে পামগাছ দ্বারা পরিবেষ্টিত যা বালিয়াড়ির মধ্যে অবস্থিত সাহারা মরুভূমিরই এক অংশ। এখানে রাত কাটানোর সুব্যবস্থা রয়েছে। যদিও এখানে থাকা ও খাওয়ায় অনেকটা ব্যয়বহুল, তবে বেশ আনন্দ সহকারে রাত পার করতে পারবেন। যা কি-না আপনার জীবনে স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে।
পেরু দেশটির রেলপথ গিয়েছে আন্দিজ পর্বতমালার ৪,৮৩০ মিটার উঁচু দিয়ে – এটিই পৃথিবীর সর্বোচ্চ রেলপথ
পেরুর উল্লেখযোগ্য শহরগুলি হল – লিমা, ইকুইটোস, পিউরা, পেইতা, চিকলায়ো, চিম্বোতে, কুজকো, টুজিল্লো, আরেকুইপা, ট্রুজিলো, ইকুতস, কোস্কো, হুয়ানুকো, আইকা, জুলিয়াকা, পুকল্লপা, সুলানা, কাজামারকা, হুরাজ, তারাপোটো, পুও, আয়াকুচি, সুলানা, টাকনা ইত্যাদি।
জীবনে কখনও যদি কোনো দেশে ভ্রমণ করেন, তবে একটিবারের জন্য হলেও পেরুতে যাবেন। মনে রাখবেন, পেরু এমন একটি জীববৈচিত্র্যের দেশ যা একটি দেশের সীমার মধ্যে খুব কমই দেখা যায়। পেরুর উপকূলীয় মরুভূমি, আন্দিজের বরফের চূড়া, বনভূমি, বন্যপ্রাণী, কয়েক ডজন সতন্ত্র আদিবাসী গোষ্ঠী – এ সব কিছু সহজেই মন ভুলিয়ে দিতে পারে। পেরুর বিভিন্ন এলাকার নিজস্ব বর্ণিল ঐতিহ্য আর নানান ধরনের খাবার খেতে খেতে মুগ্ধ হয়ে হয়তো বলবেন, পরজনমে যেন আমি পেরুতেই জন্মগ্রহণ করতে পারি।