১৯৪৭ খৃষ্টাব্দে উপমহাদেশ ভাগাভাগির সময় অসংখ্য মুসলিম প্রধান এলাকা জিন্নাহ’র দলের লোকেরা ভারতকে দিয়ে চলে আসে। তেমনি একটি মুসলিম জনপদ হল জৌনপুর। এটিও ছেড়ে দিয়েছিল জিন্নাহ ও তাঁর সহযোগীরা।
একবার জৌনপুর ভ্রমণে গিয়ে ওখানকার লোকজনের সঙ্গে আমার আলাপ হয়।
জৌনপুর ছেড়ে দেওয়ার জন্য ওখানকার লোকজন জিন্নাহ ও তাঁর দলের লোকদেরকে ছেড়ে কথা বলেননি। জিন্নাহকে গালিগালাজ পর্যন্ত দিয়েছিল।
জৌনপুর দুর্গটি ভারতের উত্তর প্রদেশের জৌনপুর শহর থেকে প্রায় সোয়া ২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
জৌনপুর দুর্গটি ফিরোজ শাহ তুঘলকের সর্দার ইব্রাহিম নায়েব বারবাক নির্মাণ করেছিলেন।
উত্তর প্রদেশের বারানসী বিভাগের একটি অংশ এই জৌনপুর। জৌনপুর তার সমৃদ্ধ সংস্কৃতি এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বের জন্য পরিচিত। শহরটি ১৪ শ শতকে ফিরোজ শাহ তুঘলক দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যিনি তাঁর চাচাতো ভাই মুহাম্মদ বিন তুঘলকের স্মরণে এটির নামকরণ করেছিলেন জৌনপুর। যিনি তাঁর কাছে স্নেহভাবে জাওনা খান নামে পরিচিত।
১৫৬৭ খৃষ্টাব্দে আলী কুলি খান বিদ্রোহ করলে সম্রাট
আকবর নিজেই জৌনপুর আক্রমণ করেন এবং আলী কুলি খান যুদ্ধে নিহত হন। সম্রাট আকবর জৌনপুর বেশ কিছুদিন অবস্থান করেন। এরপর তিনি সরদার মুনিম খানকে শাসক নিযুক্ত করে ফিরে যান। সম্রাট আকবরের রাজত্বকালেই জৌনপুরের শাহী পুল নির্মিত হয়েছিল।
জৌনপুর শহরটি ১৩৯৪ থেকে ১৪৭৯ খৃষ্টাব্দের মধ্যে শার্কি রাজবংশের স্বাধীন মুসলিম রাজ্যের রাজধানী ছিল। এটি ১৫৫৯ খৃষ্টাব্দে মোগল সম্রাট আকবর দ্বারা জয় হয় – তবে ১৭৭৫ খৃষ্টাব্দে ব্রিটিশ শাসনের অধীনে চলে যায় জৌনপুর।
পিরোজপুরের হাফেজ সাহেবের আদি বাসস্থান ছিল জৌনপুর – জৌনপুর বর্তমানে ভারতের উত্তরপ্রদেশের জেলা শহর। এলাহাবাদ দেখার পরে জৌনপুর গিয়েছিলাম পিরোজপুরের হাফেজ সাহেবের কথা মনে করে, তাঁর আদি বাসস্থান জৌনপুর – এই কথা স্মরণ করে। আমার সফরসঙ্গী ছিল হাফেজ সাহেবের এক নাতি। সেই নাতির পৈত্রিক নিবাস হল উত্তরপ্রদেশের সুলতানপুর।
এলাহাবাদ থেকে জৌনপুরের দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার। সড়ক পথে বাসে যেতে সময় লেগেছিল প্রায় ৪ ঘন্টা।
জৌনপুর দেখার স্মৃতি –
যৌবনে বহু জায়গায় ভ্রমণ করেছি, অসংখ্য শহর, গ্রাম, বন্দর দেখেছি।
কিছু কিছু স্মৃতি আজ চোখের পাতায় হঠাৎ হঠাৎ ভেসে ওঠে।
জৌনপুর শহরে গিয়েছিলাম ১৯৯০ এর দশকে। প্রথমে যে হোটেলে উঠবার জন্য গিয়েছিলাম, সেই হোটেল কর্তৃপক্ষ জানাল, তাদের ওখানে বিদেশিদের রাখার অনুমতি নেই। তারা একটি হোটেলের নাম বলে দিয়ে এক রিকশাওয়ালাকে বলে দিল, হোটেলে পৌঁছে দিতে। সত্যিই মুগ্ধ হয়েছিলাম হোটেল কর্তৃপক্ষের ব্যবহারে। রিকশা পর্যন্ত তারা ঠিক করে দিলেন। তা ক’জনেই বা করেন।
জৌনপুর হল ভারতের উত্তরপ্রদেশের একটি জেলা শহর। শহরটি গোমতী নদীর তীরে অবস্থিত। লখনৌ শহর থেকে জৌনপুরের দূরত্ব ২২৮ কিলোমিটার দক্ষিণ -পূর্বদিকে অবস্থিত।
জৌনপুরের দর্শনীয় স্থান হল জৌনপুর দুর্গ, এটি শাহী কিল্লা বা রয়েল দুর্গ নামে পরিচিত। এটি গোমতী নদীর উপরে শাহী ব্রিজের কাছে অবস্থিত। জৌনপুরের এই শাহী কিল্লা বা দুর্গটি সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের সর্দার ইব্রাহিম নায়েব বারবাক নির্মাণ করিয়েছিলেন। এর কাছেই রয়েছে একটি মসজিদ। এটি হলুদ এবং নীল রঙের টাইলস দিয়ে সজ্জিত। দুর্গের দেয়াল ও গেটগুলোও দেখার মতো। গেটওয়েটির কাছে গিয়ে অনেকেই ছবি তোলেন – দুর্গটি জৌনপুর মূল শহর থেকে ২ কিলোমিটার দূরে।
এছাড়া আরও দর্শনীয় হল – আটালা মসজিদ, লাল দরজা মসজিদ, জামে মসজিদ, ঝাঁঝিরি মসজিদ,
শাহী পুল।
ফিরোজ শাহ তুঘলকের আমল থেকেই জৌনপুর শহর গড়ে উঠতে শুরু করে।
জৌনপুর জেলায় লোকসভার আসন সংখ্যা ২টি এবং বিধানসভা আসন সংখ্যা রয়েছে ৯টি।
লোকসভা কেন্দ্র ২টি হল – জৌনপুর ও মছলিশহর।
জৌনপুর জেলার মহকুমাগুলি হল –
বদলাপুর, জৌনপুর, শাহগঞ্জ, মাছলিশহর বা মাচালি , মারিয়াহু, কেরাকাত।
জৌনপুর জেলার লোকজন বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে যেমন – উর্দু, হিন্দু, ভোজপুরী, আওধি।
এছাড়াও আছে – বরুণা, বাসুহি, পিলি মামুর ও গাঙ্গি।
জৌনপুর জেলার উন্নয়ন ব্লকগুলি হল –
সন্ধি বা শাহগঞ্জ, সইঠাকালা, খুথান, করঞ্জকালা, বদলাপুর, মহারাজগঞ্জ, বাকশা, মুংরা বাদশাহপুর, মাচালিশাহর, মারিয়াহু, বার্সাথী, রামপুর, রামনগর, জালালপুর, কেরাকাত, দোবি, মুফতিগঞ্জ, ধর্মপুর, বিজোর, সিরকোনি।
জৌনপুর জেলার উল্লেখযোগ্য থানাগুলি হল –
লাইনবাজার, জাফরাবাদ, খেতাসরাই, শাহগঞ্জ, সরপাটহান, চান্দওয়াক, সরাই খাজা, গৌড়া বাদশাহপুর, সিংড়া, মীরগঞ্জ, বাকশা, সুজনগঞ্জ, জাংহাই, কাসেরওয়ান, বাসরওয়ান, সুরেরি, নেভাধিয়া, রামপুর, পাওড়া, সিকারা।
জৌনপুর জেলা শহর দেখে মনে হয়েছিল, এ শহর তো মুসলিম কীর্তিতে ভরপুর। তবে জিন্নাহ আর নেহরু কোন দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ ভাগ করেছিলেন? দেশ ভাগ করলে একজন এক দেশের, আরেকজন আরেক দেশের প্রধান শাসক হবেন, এই জন্যই কী?
জৌনপুর শহর জিন্নাহ হিন্দুস্থানে ফেলে রেখে এসেছিলেন কেন? এর জবাব কে দিবে?
জিন্নাহ ও নেহরুর উপমহাদেশ ভাগাভাগি এবং মহাত্মা গান্ধীর সহযোগিতা কি চিচিং ফাঁক ছিল না ? সেই যন্ত্রণা নিয়ে কি আমরা আজও জ্বলছি? এর শেষ কোথায়!
আরও পড়ুন: যে দেশের প্রাচীন সভ্যতা হরপ্পা ও মহেন্জোদারো
নাগাল্যান্ড আজও নিজস্ব সংস্কৃতিতে সমুজ্জ্বল