কিটো ডায়েটে কীভাবে দ্রুত ও কার্যকর পন্থায় ওজন কমাবেন?


কিটো ডায়েট মেনেও ওজন কমাতে গিয়ে গলদঘর্ম? মেপে মেপে ভাত, রুটি, সব্জি খাচ্ছেন। প্রতিদিন কমপক্ষে আধ থেকে এক ঘন্টা হাঁটছেন। কেউবা দৌড়াচ্ছেন। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। এই সমস্যায় আছেন অনেকেই। যারা এখনও শুরু করেননি, কিন্তু অনেক কিছুই শুনেছেন এই ডায়েটের ব্যাপারে। তারা শুরু করতে পারেন কিটো ডায়েট।

কিটো ডায়েট কি ও কেন?

কিটো ডায়েটের মুল কথা হচ্ছে খাদ্যতালিকা থেকে শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট একেবারে কমিয়ে এনে চর্বি বা ফ্যাটনির্ভর খাদ্যগ্রহণ করা। এই ডায়েটকে কিটোজেনিক ডায়েট বা সংক্ষেপে কিটো ডায়েট বলা হয়।

সাধারণত দীর্ঘ্যসময় না খেয়ে থাকলে আমাদের শারীরিক ব্যবস্থা শরীরে জমে থাকা চর্বি গলিয়ে আমাদের শক্তি যোগায়। শরীর যখন এই পর্যায়ে পৌঁছায় তখন তাকে কিটোন বডি বলা হয়। এই ডায়েট পদ্ধতিতে পরিকল্পনা মাফিক খাদ্যগ্রহণ করতে হয়। ফলে এর মাধ্যমে শরীরকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয় যাতে শরীরে জমে থাকা চর্বি গলতে থাকে। কিছুদিন এরকম পদ্ধতি অবলম্বন করলে শরীরের বাড়তি ওজন অনেকাংশেই কমিয়ে ফেলা সম্ভব। এটা পরিক্ষীত ও বৈজ্ঞানিকভাবে অনুমোদিত।

ওজন কমানোর অন্যান্য পদ্ধতিগুলোর চেয়ে কিটো ডায়েটে অতি সহজেই ওজন কমানো যায়। সেটা দ্রুততার সাথে। যেহেতু ওজন কমানোর জন্য আমরা কী খাচ্ছি সেটা গুরুত্বপূর্ণ। কিটো ডায়েটের খাবারগুলোয় শর্করা নেই বা খুবই কম। শর্করা শরীরে ইনসুলিন সঞ্চার করে। ইনসুলিন ওজন কমানোয় বাধা প্রদান করে। তাই শরীরে ইনসুলিন আসা নিরুৎসাহিত করতে শর্করা খাবার নির্ধারিত মাত্রায় খেতে হয়।

কিটো স্বাস্থ্য প্রণালীতে খাবারের মুলমন্ত্র হচ্ছে উচ্চমানের চর্বিগ্রহণ। এ প্রক্রিয়ায় প্রথমে শরীরকে চর্বিজাতীয় খাদ্যগ্রহণে অভ্যস্ত করতে হয়। তারপর দৈনন্দিন মোট খাবারের প্রায় সত্তর ভাগ চর্বি খেতে হয়। বাকি অংশের মধ্যে ২৫ভাগ আমিষ বা প্রোটিন এবং ৫ ভাগ শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট রাখতে হয়।

কিটো ডায়েটে

কিটো ডায়েট চার্ট বা রুটিন খাদ্য:

এই ডায়েট পদ্ধতি অনুসরন করতে গেলে প্রথমেই এই ডায়েটে কী খাওয়া যাবে এবং যাবে না তা বুঝে নেয়া জরুরী। প্রথমত: উচ্চমাত্রার চর্বিযুক্ত খাবারগুলো বেছে নিতে হবে। একই সাথে বাদ দিতে হবে যেসব শর্করাজাতীয় খাবার আমরা প্রতিদিন খাচ্ছি সেগুলো।

  কিটো অনেকটা পশ্চিমা জীবনযাপন প্রণালীর খাদ্যতালিকা অনুসারে প্রচলিত। তবে বাংলাদেশে ডা: জাহাঙ্গীর কবির আমাদের খাদ্যতালিকা অনুযায়ী একটি প্রণালী তৈরি করেছেন।

কিটো ডায়েট চার্ট জাহাঙ্গীর কবির:

ডা: জাহাঙ্গীর কবিরের ইউটিউব  এবং ফেসবুক ভিডিওগুলোতে   নীচের খাবারগুলো গ্রহণ করার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে:

সবুজ শাকসব্জি। যেকোন প্রকারের শাকে বিধিনিষেধ নেই। তবে সব্জির মধ্যে ফুলকপি, বাধাকপি, ব্রুকলি, স্প্রাউট, ক্যাপসিকাম, পার্সনিপ, সুইড কিংবা রুটাবাগা,লেটুস, শসা এবং টমেটো ও গাঁজর (অল্প পরিমানে) ইত্যাদি। এগুলোতে বিধিনিষেধ নেই। ভাতের মতই পেটভরে খেতে বলা হয়েছে।

ফল: কিটো ডায়েটে কোন প্রকার মিষ্টি ফল খেতে পারবেন না। তবে টক ফল খেতে বাধা নেই। যেমন, টক বরই, জলপাই, আমলকী, বেরী জাতীয় ফল যেমন ব্লুবেরী, রাসবেরী, ষ্ট্রবেরী (অল্প পরিমানে) ইত্যাদি। এছাড়া অ্যাভোকেডো খেতে পারবেন।

keto fruit

ডিম: দেশী হাঁস-মুরগীর ডিম। ফার্মের মুরগীর ডিম হলেও সমস্যা নেই। ঘি দিয়ে ভেজে খেতে হবে। কুসুম কিছুটা নরম রাখতে বলা হয়েছে।

যেকোন প্রকার মাছ এবং মাছের ডিম। তবে সামুদ্রিক মাছ হলে ভাল। উচ্চ চর্বিযুক্ত মাছ কিটো ডায়েটে আদর্শ।

দেশী মুরগীর মাংস, দেশী গরু, ছাগল, ভেড়া ও মহিষের মাংস যেগুলো ঔষধ দিয়ে মোটাতাজা করা হয়নি। প্রাকৃতিকভাবে বড় হয়েছে।

বাদাম খেতে পারবেন যেকোন প্রকারের। তবে কাজু বাদাম ছাড়া। কারন এটাতে কার্বোহাইড্রেট তুলনামুলকভাবে বেশি আছে। চর্বির পরিমান বাড়ানোর জন্য বাদাম অবশ্যই ঘি দিয়ে ভেজে নিবেন। কিটো খাবার নিয়ে দেখুন আমাদের আরেকটি প্রতিবেদন।

কিটোতে প্রতিদিনের রান্নায় কী তেল ব্যবহার করবেন?

কিটো ডায়েট প্রণালীতে সয়াবিন কিংবা উচ্চ তাপমাত্রায় তৈরি ভেজিটেবল অয়েল অথবা বাজারের তৈরি সরিষার তেল রান্নায় ব্যবহার করা যাবেনা। এক্ষেত্রে রান্নায় ব্যবহার করতে হবে এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল, এক্সট্রা ভার্জিন নারিকেল তেল, খাঁটি ঘি, বাটার, কলু কিংবা ঘানিতে তৈরি সরিষার তেল ইত্যাদি।

 

কিটো ডায়েট

 

এ প্রণালীতে বেশিরভাগ সময় অভূক্ত থাকার নির্দেশনা রয়েছে। আমাদের শরীর সাধারনত ১৪ ঘন্টার পর কিটোন বডিতে বা চর্বি গলানোর পৌঁছায়। তাই প্রাথমিক অবস্থায় বিশেষ নাস্তা খেতে নিরুৎসাহিত করা হয়। তবে যা খাওয়া যাবে তাহল:

এক চামচ এক্সট্রা ভার্জিন আপেল সাইডার ভিনেগার কিংবা এক্সট্রা ভার্জিন কোকোনাট ভিনেগার মিশ্রিত এবং লেবুর রসযুক্ত এক গ্লাস কুসুম গরম পানি খেতে হবে নাস্তার সময়। কিছুক্ষণ পরে বুলেট কফি খেতে পারেন। বুলেট কফিতে কফি, এক চামচ এক্সট্রা ভার্জিন নারিকেল তেল, এক চামচ বাটার কিংবা ঘি মিশিয়ে ব্লেন্ডারে ব্লেন্ড করে নিতে হবে। এই কফি খেলে কয়েক ঘন্টার জন্য ক্ষুধা লাগবে না। তদুপরি শরীর কিটোন বডিতে পৌঁছাবে।

এছাড়া গ্রীণ টি খেতে পারবেন। গ্রীণ টি পাওয়া না গেলে রংচা দুধ চিনি ছাড়া। সামান্য লবণ দিতে পারবেন। সেটা হিমালয়ান পিংক সল্ট হলে ভাল। চায়ের মধ্যে লেবু কিংবা আদার রসও মেশাতে পারলেও ভাল।

ইদানিং হলুদ পাউডার কিংবা কাঁচা হলুদের নির্যাস মিশ্রিত চা খেতেও বলা হচ্ছে। এতে আরও মেশানো যাবে খাঁটি মধু এবং সামান্য পরিমানে পেপার। এই চায়ের অন্য উপকারও রয়েছে।

কিটো ডায়েটে যা খেতে পারবেন না:

খাবার তালিকায় আমুল বিপ্লব আনতে হবে। শর্করা জাতীয় সব খাবার বাদ দিতে হবে। যেমন: ভাত, রুটি, বিস্কুট, নুডলস, পাস্তা, সর্বপ্রকার মিষ্টি জাতীয় খাবার বর্জন করতে হবে। আলু, মুলা, ডালসহ শর্করাযুক্ত সব সব্জি খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।

রান্নায় সয়াবিন তেল কিংবা বাজারে প্রচলিত ভেজিটেবল অয়েল কিংবা সূর্য্যমুখী তেল, উচ্চতাপমাত্রায় প্রস্তুতকৃত সরিষার তেল কিটো ডায়েটে ব্যবহার করা যাবে না।

দুধ খাওয়া যাবে না। দই, টক দই প্রাথমিক অবস্থায় বাদ দিতে হবে।

 

কিটো ডায়েট

 

প্রতিদিন রোদের আলোয় হাঁটতে হবে কমপক্ষে আধা ঘন্টা। রাতে বিছানায় যেতে হবে দশটা কিংবা বেশী হলে এগারটার মধ্যে। এর চেয়ে দেরী করা যাবে না।

কিটো ডায়েটে সম্পূর্ণ খাবার খেতে হবে চার থেকে ছয় ঘন্টার মধ্যে। অর্থাৎ বেলা একটায় দুপুরের খাবার খেলে রাতের খাবার খেয়ে নিতে হবে সন্ধ্যা সাতটার আগেই। এরপরে পানি কিংবা গ্রীণ টি ছাড়া অন্য কিছু খাওয়া যাবে না।

হিমালয়ান পিংক লবন খেতে হবে। ডায়েটে করাকালীন সময়ে পানির সাথে সামান্য হিমালয়ান পিংক লবণ মিশিয়ে নিলে মাথাধরা, মাইগ্রেইন কিংবা মাথা ঝিম ধরবে না।

খাবার গ্রহণের সময় কচি ডাবের পানি খেতে পারলে ভাল। শরীরে পটাশিয়ামের অভাব হবে না।

উপরে উল্লিখিত পন্থাগুলো অবলম্বন করতে হবে শরীরে ফ্যাট অ্যাডাপ্টেশন কিংবা চর্বিতে অভ্যস্ত হওয়া পর্যন্ত। কিটো ডায়েটে এটা কারো ক্ষেত্রে এক সপ্তাহ আবার কারো ক্ষেত্রে দুইসপ্তাহও হতে পারে।

এরপর শরীর পুরোপুরি চর্বিগলিয়ে চলতে শুরু করলে খেতে হবে দিনে একবেলা। এই ডায়েট অনুযায়ী যেসব খাবার আপনার পছন্দ সগুলো খেতে হবে একঘন্টার মাধ্যে। বাকি সময় রোজা রাখতে পারেন কিংবা পানি খেয়ে কাটিয়ে দিতে পারেন। ক্ষিধে লাগবে না একদমই। তবে রোজা রাখলে শরীর থেকে চর্বি কমবে দ্রুত। কম সময়েই আপনার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবেন। ওয়াটার ফাস্টিং কিংবা শুধু পানি খেয়ে সময় কাটানোকে বলা হয় ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং। এই অবস্থায় সপ্তাহ দুয়েক কাটিয়ে দিতে পারলে ওজন কমানোটা আয়ত্বের মধ্যে চলে আসবে।

ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং করলে গ্রীণ টি, বুলেট কফি পান করতে পারবেন। এছাড়া লবণ মেশানো পানিও পান করতে পারবেন।

শেষ কথা:

আমাদের দেহঘড়ি একেক জনের জন্য একেক রকম। তাই একজনের বেলায় দ্রুত ওজন কমলেও আরেক জনের ক্ষেত্রে সেরকম কাজ নাও করতে পারে। তবে হতাশ হলে চলবে না। কিটো ডায়েটে পুরো নিয়ম মেনে চললে সবার ক্ষেত্রেই ওজন কমবে।

যা অবশ্যই মনে রাখবেন:

আপনার শরীরে যদি আগে থেকেই রোগব্যাধি থাকে তাহলে সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কিটো ডায়েট শুরু করবেন না। চিকিৎসক এ ব্যাপারে আপনাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করবেন।