বাংলার নাট্য সংস্কৃতি বিকাশে কলকাতার জমিদারদের অবদান অসামান্য। এপর্যন্ত সেসবের কিয়দংশই এসেছে আলোচনায়। ১৯ শতকে কলকাতার জমিদারদের জানা অজানা কাহিনী নিয়ে লিখেছেন- লিয়াকত হোসেন খোকন
কলকাতার যে সব প্রসিদ্ধ জমিদার বাড়ির কথা আমরা শুনি তাঁদের প্রায় সবারই ভাগ্যোদয় হয়েছিল কোম্পানির রাজত্ব কায়েম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে।
বরিশার সাবর্ণ চৌধুরীদের আদিপুরুষ কেশবরাম রায় নবাব মুর্শিদকুলী খাঁর আদেশে ১৭১৬ সালে দক্ষিণবাংলার খাজনা আদায়ের ভার পেয়ে জমিদার নিযুক্ত হন।
কেশবরাম নাবালক ছিলেন বলে রুক্মিণীকান্ত দেবকে কেশবের সম্পত্তির পরিচালক নিযুক্ত করা হয়। রুক্মিণীকান্ত ছিলেন মহারাজা নবকৃষ্ণের পিতামহ।
কেশববরামের পুত্র সন্তোষ রায় কালীঘাটের বর্তমান মন্দির নির্মাণ করেন।
কলকাতা প্রেসিডেন্সীতে রূপান্তরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জমিদার পদ সৃষ্টি হয় এবং এই জমিদার কাউন্সিলের সদস্য বলে গণ্য হন। রাজস্ব আদায় করা ও বিচার করা ছিল তাঁর প্রধান কাজ। রাজস্ব আদায়কারী হিসাবে এঁর নিজের কাছারি ছিল। কলকাতা জমিদারির যেসব প্রজাদের রাজস্ব বাকী পড়ত তাদের কয়েদ করে রাখা হত এই কাছারিতে, বেত্রাঘাতও করা হত।
রাজস্ব সংক্রান্ত মামলা চালানোর দায়িত্বও ছিল এই জমিদারদের হাতে, যদিও এসব দায়িত্বের বেশির ভাগটাই পালন করতেন তাঁর প্রতিনিধি যাঁকে বলা হত ‘কালা জমিদার’। ১৭২০ থেকে ১৭৫৬ সাল পর্যন্ত এই কালা জমিদারের পদ অধিকার করেছিলেন গোবিন্দরাম মিত্র।
কালা জমিদার গোবিন্দরাম এতই অত্যাচারী ছিলেন যে অধীনস্থ প্রজারা তার নামে অভিযোগ পর্যন্ত করতে সাহস পেত না। তহবিল তছরুপের দায়ে হলওয়েল তাকে বরখাস্ত করেন কিন্তু ওপরমহলে গোবিন্দরামের এত প্রভাব ছিল যে তছরুপের টাকা মিটিয়ে তিনি আবার স্বপদে বহাল হন।
কলকাতার যে সব প্রসিদ্ধ জমিদারবাড়ির কথা ব্যাপকভাবে শোনা যায় তাদের প্রায় সবারই ভাগ্যোদয় হয়েছিল কোম্পানির রাজত্ব কায়েম হওয়ার সঙ্গে -সঙ্গে। এঁদের অনেকেই কোম্পানির সঙ্গে কর্মসূত্রে জড়িত ছিলেন, বংশগৌরব বলতে যা বোঝায় তার অভাব ছিল অনেকেরই।
প্রাচীন জমিদারদের অবস্থা বিপর্যয় আর উঠতিদের অভ্যুদয় সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে, ‘নবাবী আমল শীতকালের সূর্যের মতো অস্ত গ্যালো। মেঘান্তের রৌদ্রের মত ইংরাজদের প্রভাব বেড়ে উঠলো। বড় বড় বাঁশঝাড় সমূলে উচ্ছন্ন হলো। কঞ্চিতে বংশলোচন জন্মাতে লাগলো। নবো মুনসী, ছিরে বেনে ও পুঁটে তেলি রাজা হলো। সেপাই পাহারা, আসা সোটা ও রাজা খেতাব, ইন্ডিয়া রবরের জুতো ও শান্তিপুরের ডুরে উড়ুনির মত, রাস্তায় পাঁদাড়ে ও ভাগাড়ে গড়াগড়ি যেত লাগলো -। টাকা বংশগৌরব ছাপিয়ে উঠলেন’।
উনিশ শতকী কলকাতার উল্লেখযোগ্য জমিদার বংশগুলি হল –
শোভাবাজার দেববংশ ; বাদুড়বাগান রায়বংশ ; কুমারটুলি মিত্রবংশ ; পাথুরিয়াঘাটা ঘোষবংশ ; বাগবাজার ঘোষবংশ ; কলুটোলা শীলবংশ ; জানবাজার দত্তবংশ ; পটলডাঙা বসুবংশ ; বড়বাজার মল্লিকবংশ ; ঝামাপুকুর মিত্রবংশ ; চোরবাগান মল্লিকবংশ ; ঠনঠনিয়া লাহাবংশ ; বাগবাজার বসুবংশ ; পাথুরিয়াঘাটা রায়বংশ ; পাইকপাড়া সিংহবংশ ; ভূকৈলাস ঘোষালবংশ – ইত্যাদি।
কলকাতাবাসী রাজা রামমোহন রায়কে তৎকালীন বাংলার প্রধান প্রাণপুরুষ বললে ভুল হবে না। সামাজিক ভূমিকা ছাড়াও বাংলা গদ্যের ক্রমবিকাশে তাঁর স্থান সুনির্দিষ্ট। রামমোহনের সঙ্গে -সঙ্গে যে নামটি এসে পড়ে তা হল ‘রাজা’ রাধাকান্ত দেব। কোন কোন বিষয়ে ঘোর প্রাচীনপন্থী হওয়া সত্ত্বেও শোভাবাজার রাজবাড়িতে বালিকাদের শিক্ষাদানের জন্য পাঠশালা স্থাপন তাঁরই কীর্তি।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী এবং তাঁর ধর্মসম্বন্ধীয় ভাষণগুলি বাংলা সাহিত্যের গৌরব। মহর্ষির মধ্যম ভ্রাতা ‘বায়ুনাটক’ নামে একটি প্রহসন রচনা করেছিলেন। তাঁর দুই পুত্র গণেন্দ্রনাথ ও গুণেন্দ্রনাথ সাহিত্যচর্চায় বিশেষ উৎসাহী ছিলেন। মহর্ষির পুত্রদের মধ্যে দ্বিজেন্দ্রনাথের দার্শনিক প্রবন্ধগুলি বিশেষ মূল্যবান। তাঁর ‘গীতাপাঠের ভূমিকা’ শৈলীর ঋজুতায় অনবদ্য।
সত্যেন্দ্রনাথ বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে বাংলায় সুলিখিত প্রবন্ধ লেখেন। ‘বাল্যকথা’ বাংলা সৃজনশীল গদ্যের ক্ষেত্রে তাঁর অন্যতম অবদান। এছাড়াও তিনি বহু ব্রহ্মসংগীত রচনা করেন।
জ্যোতিন্দ্রনাথ নাট্যরচনায়, সংগীতে ও অনিবাদসাহিত্যে স্থায়ী কীর্তির অধিকারী। মহর্ষির চতুর্থ কন্যা স্বর্ণকুমারী দেবী সেকালের অন্যতম লেখিকা – উপন্যাস ও গল্পে তাঁর কৃতিত্ব অসাধারণ। আর গুণেন্দ্রনাথের পুত্র অবনীন্দ্রনাথের চিত্রময় লেখনশৈলী আপন বৈশিষ্টে ভাস্বর।
আরও পড়ুন: তাজমহল:পূর্ণিমার রাতে নক্ষত্রের আলোয় অপরূপ সৌন্দর্যের খোঁজে
পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুরবাড়িতেও সাহিত্যচর্চা পুরোদমে চলত। যতীন্দ্রমোহন ও শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর উৎসাহী ছিলেন নাটক রচনায়। যতীন্দ্রমোহনের কন্যা মনোরমা দেবী পাঁচটি নাটক ও গীতিনাট্য রচনা করেন। এছাড়া গদ্য -পদ্য মিশিয়ে তিনি ‘পিতৃদেবচরিত’ নামে যতীন্দ্রমোহনের একটি জীবনীও লেখেন।
কলকাতার সাহিত্যিক জমিদারদের মধ্যে কালীপ্রসন্ন সিংহের নামটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি অষ্টাদশ পর্ব মহাভারত বাংলায় অনুবাদ করেন এবং করান। এই মহাভারতের প্রতিটি খন্ড তিনহাজার কপি করে ছাপানো হয় এবং সমগ্র গ্রন্থ বিনামূল্যে ও বিনামাশুলে বিতরণ হয়েছিল।
বাংলা সাহিত্যের মতো বাংলা নাট্যশালাও কলকাতার জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিল। পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রভাবে বাঙালির রুচি সেসময়ে পরিবর্তিত হচ্ছিল – যাত্রা, পাঁচালী, কবিগান ইত্যাদি আর ইংরাজি শিক্ষিত বাঙালির মানসিক চাহিদা মেটাতে পারছিল না।
ইউরোপীয় ছাঁদে বাংলা নাট্যশালা স্থাপনের কল্পনা শিক্ষিত বাঙালির মনে এল। প্রসন্নকুমার ঠাকুরের উদ্যোগে ‘হিন্দু থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠিত হল এবং ১৮৩১ সালের ২৮ ডিসেম্বর এখানে প্রথম নাটক মঞ্চস্থ হল। তখন অভিনয়যোগ্য বাংলা নাটক ছিলই না, তাই শেকসপিয়ারের জুলিয়াস সীজারের নির্বাচিত অংশ দিয়ে এখানে অভিনয়ের সূত্রপাত হল। নাটকটি দেখার জন্য বিশিষ্ট দর্শকদের মধ্যে রাধাকান্ত দেবও ছিলেন।
১৮৪৭ সালে সাতুবাবুর বাড়িতে নন্দকুমার রায় লিখিত অভিজ্ঞান শকুন্তলা নাটকের অভিনয় হয়।
১৮৫৮ সালে কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘সাবিত্রী সত্যবান’ নাটক প্রকাশিত হল। ওই বছরই ৫ জুন তারিখে বিদ্যোৎসাহিণী সভার রঙ্গমঞ্চ কালীপ্রসন্ন সিংহের উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত। কালীপ্রসন্ন সিংহ স্বয়ং বেণীসংহার নাটকের অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেন। এই অভিনয়ের সাফল্যে তিনি নাটক রচনায় উৎসাহী হন এবং ১৮৫৭ সালে কালিদাসের ‘বিক্রমোর্ব্বশী’ নাটকের বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করেন। নাটকটি মহা সমারোহে সে-বছরই বিদ্যোৎসাহিণী মঞ্চে অভিনীত হয়। সুদর্শন কালীপ্রসন্ন সিংহ স্বয়ং পুরূরবার ভূমিকায় অভিনয় করেন।
১৮৫৮ সালে বেলগাছিয়া নাট্যশালা প্রতিষ্ঠা বাংলা রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। পাইকপাড়ার রাজা প্রতাপচন্দ্র ও ঈশ্বরচন্ত্র সিংহের উদ্যোগেই এই নাট্যশালার প্রতিষ্ঠা।
কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ১৮৮৪ সালে প্রকাশিত হুতোম প্যাঁচার গান বা কলির শহর কলকাতা নামে অনবদ্য ব্যঙ্গ কবিতায় তিনি মেকি রাজাদের সম্পর্কে যথেষ্ট বিদ্রুপ এবং শ্লেষ প্রয়োগ করেছেন। একটি কাল্পনিক মজলিসে কবি কলকাতার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের আহ্বান করে তাঁদের বিচার করে দুই ভাগে বিভক্ত করেছিলেন। প্রথম ভাগ হচ্ছে ‘কলকাতার কল্কা পরার দল’।
মহারাজ যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরকে দিয়ে বর্ণনার আরম্ভ –
এসো এসো সবার আগে ঠাকুরবাড়ির চাঁই,
বুলবুলি পাগ শিরে বাঁধা তালপাতা সেপাই।
পাথরঘাটায় রাজগী জারি ‘সার’ মহারাজ নাম,
মুন্সীআনায় জেঁকে গেছে ছ্যাতলাধরা থাম।
সিঁতির মাঠে কুঞ্জবিহার দীপ্ত মরকত
কুঞ্জমাঝে গ্রটোর্ণ গহর মাটিতে পর্বত।
বংশ যশে লেজিসলেটিভ রংমহলে চড়ে
রাজ -মহারাজ নাগরা পিঠে মাথায় পগগ নেড়ে।
মিষ্টি বোলে মিছরি ঘোঁটা সবটুকু সে ছাঁকা ;
যার অভ্যুদয়ের ছায়া লেগে শহরখানা ঢাকা।
এসো এসো ভারত মাজী কসে ধরো হাল,
বিলিতি বাতাসে ভ্যালা উড়ায়েছ পাল।
‘মনের রাজা’ বলে কবি দ্বিতীয় দলকে চিহ্নিত করেছেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছাড়া এই দলে আছেন তারানাথ তর্কবাচম্পতি, মহেশ চন্দ্র ন্যায়রত্ন, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, ভূদেবচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং তারকনাথ প্রামাণিক। এঁদের গুণ বর্ণনা করতে গিয়ে কবি ‘সাহেব চাটা’, ‘কেদাবধারী’, ‘রাংতা জরি চাকতিমারা নকিবপুকার’, ‘পুতুল রাজাদের’ ধিক্কার দিয়েছেন। ১৮৮৪ সালের এই মূল্যায়ন। পরবর্তী কালে যখন রাজনৈতিক চেতনার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে গণতান্ত্রিক চিন্তার বিকাশ ঘটল তখন এই রাজা -জমিদারদের ভাবমূর্তি স্বভাবতই সাধারণের অপ্রিয় হয়ে দাঁড়াল।
-লিয়াকত হোসেন খোকন: চলচ্চিত্র, ভ্রমণ ও ইতিহাস বিষয়ক লেখক-বিশ্লেষক।