গ্রীষ্মের মধ্য লগ্নে বৃটেনের বৃক্ষমন্জরী সবুজ পত্রপল্লবের শোভা আর নানা রঙের ফুলের উজ্জল আলোকচ্ছটায় মাতিয়ে দেয় প্রকৃতির রূপ। ট্রেনে কিংবা হাইওয়েতে এ সময়কালে ভ্রমণে মাইলের পর মাইল লং ড্রাইভে এমন নয়ন মনোহর নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখলে প্রকৃতির প্রেমে পড়বেন যে কেউই। চোখে পড়বে সবুজ মাঠে ঘাস খাচ্ছে ভেড়ার পাল, ঘোড়া কিংবা গরু। কখনো দেখবেন ফসলের মাঠে ছড়িয়ে রয়েছে সোনালী ফসল।
যান্ত্রিক আশির্বাদে ফসলের মাঠ থেকে কৃষক কিংবা কিষাণী কায়িক পরিশ্রমে নিজেদের ফলন আর সংগ্রহ করেন না। যেমনটি আগে করতেন নিতান্তই আনমনে নিরলসভাবে। কখনো গুনগুন করে গান গেয়ে। ফসলের মাঠে কাজের সমান্তরালে কৃষকের আপন মনে গেয়ে যাওয়া মিষ্টি সুর কখনো কখনো আমাদের মনে ভীষন আলোড়ন তুলে। তেমনি আলোড়ন তুলেছিল আজ থেকে আড়াইশ বছর আগে জন্ম নেয়া ইংরেজ কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের চিত্তে।
ছাত্রজীবনে পাঠ্যপুস্তকে দ্য সলিটারি রিপার কিংবা ড্যাফোডিল কবিতাদ্বয় যারা পড়েছেন তারা নিশ্চয়ই কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা রাখেন। এই ইংরেজ কবি প্রকৃতির নৈসর্গিক শোভায় বিমুগ্ধ জীবন ও রোমান্টিকতাকে অনবদ্য কাব্যে বর্ণনা করে অমর হয়ে আছেন। পরিচিতি পেয়েছেন প্রকৃতির কবি হিসাবে। প্রথমোক্ত কবিতাটি ওয়ার্ডসওয়ার্থ লিখেছিলেন স্কটল্যান্ড ভ্রমণকালে কাল্পনিক এক পাহাড়ী কিষানীর শস্য আহরণকালের গান নিয়ে।
যে গানের ভাষা তিনি বুঝেননি, তার সুরে মুগ্ধ হয়েছিলেন। যে সুর পাপিয়া কিংবা কোকিলের সুমধুর কুহতান থেকেও সুরেলা ছিল।
করোনার প্রাদুর্ভাবে এবারের গ্রীষ্মে কোথাও ঘুরে বেড়ানো হয়নি। হঠাৎ একটি বিশেষ কাজে দরকার পড়ল ম্যানচেষ্টার যাবার। এডিনবরা থেকে ম্যানচেষ্টার প্রায় চার ঘন্টার ড্রাইভ। পথে অবশ্য সুযোগ আছে কিছু আকর্ষণীয় জায়গা ঘুরে বেড়ানোর। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত লেক ডিস্ট্রিক্ট এবং ব্ল্যাকপুল এর অন্যতম। লেক ডিস্ট্রিক্টের ককারমাউথ নামক জায়গায় উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের বাড়ি।
উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের বাড়িতে যাচ্ছি শুনে যেতে আগ্রহী হলেন এডিনবরায় বসবাসরত টিভি সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী হুমায়ুন কবির।
ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ড যুক্তরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলেও দুইদেশের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তর সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য রয়েছে। দুই দেশের সীমান্ত পেরোলেই ঘর বাড়ির নকশা ও কারুকাজের পার্থ্যক্য সহজেই বোধগম্য হয়। মোটরওয়েতে অনেক ক্ষণ গাড়ি চালানোর পর বাড়িঘরের দৃশ্যমান পার্থক্যে আমরা সহজেই বুঝে গেলাম ইংল্যান্ডে চলে এসেছি।
ঝকঝকে রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিন। ক্রেতাদের আনাগোনায় মধ্যপ্রহরে এখানকার পাব আর রেঁস্তোরাগুলো চেয়ার টেবিলে পসরা সাজিয়ে রেখেছে তাদের বারান্দায়। রৌদ্রস্নানের সাথে পান আহার বৃটিশদের চিরায়ত ঐতিহ্য। বাংলাদেশ কিংবা ভারতীয় উপমহাদেশে গরমের তীব্রতার কারনে দুপুরের সৌরালোক উপেক্ষা করতে বলা হয়। এখানে তার উল্টো। একে সূর্যের আলো মিষ্টি। দ্বিতীয়ত এখানে জ্বলমলে সূর্যের আলো পাওয়া যায় এমন হাতেগুনা দিন শুধুমাত্র গ্রীষ্মেই মিলে।
গুগল ম্যাপ আমাদের নিয়ে গেল একেবারে উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ হাউজের দোরগোড়ায়। ছোট একটি গলি দিয়ে গাড়ি প্রবেশ করিয়ে কিছুটা বেকায়দায় পড়ে গেলাম।
কারন নির্দিষ্ট পাস ছাড়া গাড়ি রাখার জায়গা নেই এবং ঘোরানোরও সুযোগ নেই। অগত্যা পার্শ্ববর্তী একটি ভবনের আঙিনায় গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে আসলাম পার্কিংয়ের তালাশে। কিছুটা দুরে গিয়ে পেলাম বিশাল এক পার্কিং। সেখানে পার্কিংয়ের জন্য যখন টিকেট কেনার প্রস্তুতি নিচ্ছি তখনই এক দম্পতি এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন তাদের টিকেটে এখনও ঘন্টা দুয়েক সময় আছে এবং যেহেতু তারা চলে যাচ্ছেন আমরা চাইলে তাদের টিকেট নিতে পারি। যদিও টিকেটের ঘন্টা প্রতি রেট খুব বেশি ছিল না তবুও তাদের এমন উদারতায় আমরা ধন্যবাদ সহকারে টিকেটটি নিয়ে নিই।
মাত্র কয়েক মিনিট হেঁটেই আমরা পৌঁছে গেলাম উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের বাড়ির সামনে। একপাশে ওয়ার্ডসওয়ার্থ হাউজ নামে একটি স্মারক সামগ্রী বিক্রির দোকান। আপাতত খোলা নেই। বাড়ির মুল প্রবেশদ্বারও বন্ধ। যদিও সেখানে এর কারন বলা নেই তবুও করোনা মহামারীই যে এর একমাত্র কারন তা সহজেই অনুমেয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, আজ থেকে আড়াইশ বছর পূর্বে এই বাড়িটিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ যা এখনকার ওয়ার্ডসওয়ার্থ হাউজ। বাড়িটি নির্মিত হয় ১৭৪৫ সালে এখানকার কাম্বারল্যান্ড প্রদেশের প্রধান বিচারপতি জশোয়া লুককের জন্য। পরবর্তীতে স্থানীয় একজন জমিদার জেমস লাওদার বাড়িটি কিনে নেন। তিনি এখানে বিনা ভাড়ায় থাকতে দেন জন ওয়ার্ডসওয়ার্থকে, যিনি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের পিতা এবং লাওদারের প্রতিনিধি।। এই বাড়িতে অবশ্য কবি বাস করেছিলেন শৈশব কালিন সময়ে। ৮ বছর বয়সে মাকে হারালে তারা আর এই বাড়িতে থাকেন নি। আরো পাঁচ বছর পর কবির বাবাও মারা যান। তখন খালি হয়ে যায় এই বাড়ি।
পরের দেড়শ বছর বাড়িটি ব্যক্তি মালিকানাধীন বসতভিটা ছিল। এর অবস্থান শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে হওয়ায় ১৯৩০ সালে স্থানীয় একটি বাস কোম্পানী সেটি কিনে নেয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাড়ি ভেঙ্গে সেখানে একটি বাস ষ্টেশন নির্মান করবে। একই সময়ে স্থানীয় একটি লাইব্রেরীও চেষ্টা করেছিল বাড়িটি কিনে নিতে। কিন্তু তাদের ফান্ডে পর্যাপ্ত টাকা ছিল না। বিষয়টি রেডিও এবং সংবাদপত্রে ব্যাপক প্রচার পায়। ফলে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থা অনুদান প্রদান করলে বাড়িটি কিনে নেয়া হয় লাইব্রেরীর পক্ষ থেকে। প্রদান করা হয় জাতীয় ট্রাষ্টে। তাদের তত্বাবধানে ১৯৩৯ সালের ৩০শে জুন থেকে এটি ওয়ার্ডসওয়ার্থ মেমোরিয়াল হিসাবে পরিচিতি পেয়ে আসছে।
২০০৪ সালে বাড়িটিতে আরও সংস্কার করা হয় এবং উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের ছোটবেলায় যে রকম ছিল সেভাবেই সাজানো হয়। অষ্টাদশ শতকের প্রথায় বিন্যস্ত রান্নাঘর, বাচ্চাদের শয়নকক্ষ, কবির পিতার অফিস কক্ষ এবং পরিবারের ব্যবহার্য অন্যান্য কক্ষগুলোও অতীতের সাজশয্যায় ফিরিয়ে নেয়া হয়।
বাড়ির পিছনের বাগান যা ডারউইন্ট নদীর তীরে অবস্থিত সেটিকেও অষ্টাদশ শতকের সৌষ্টবে রাখা হয়েছে। নদীর কলকল কলরবে সেখানে অপূর্ব এক নৈসর্গিক আবহ বিরাজ করছে। এ বাড়িটির অপরূপ প্রাকৃতিক শোভাই হয়তো কবির অবচেতন মনে নিসর্গ প্রেম কে তাঁর কাব্যের অন্যতম এক অনুপ্রেরণা হিসেবে উদ্দীপিত করেছে।
উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ হাউজের বিপরীত দিকেই রয়েছে নানা বৈচিত্র্যময় ফুলের সমারোহে সাজানো একটি বাগান। ভিতরে কবির একটি আবক্ষ ভাস্কর্য। যেন একান্ত নিভৃতে নিসর্গকে অবলোকন করছেন কবি! দেখে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগবে ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি? মনোরম পরিবেশের এই বাগানটি ওয়ার্ডসওয়ার্থ মেমোরিয়াল নামেই পরিচিত।
আরও পড়ুন: তাজমহল:পূর্ণিমার রাতে নক্ষত্রের আলোয় অপরূপ সৌন্দর্যের খোঁজে
কবির বাড়ি থেকে বের হয়ে আমরা রওনা হলাম ককারমাউথ নামক শহরের মধ্য দিয়ে নিকটবর্তী সমুদ্র উপকূলের উদ্দেশ্যে। শহরের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন নান্দনিক কারুকাজ আর সাজানো ফুলবাগানের ছবি নেয়ার জন্য ক্যামেরা হাতে নিয়ে ছবি তুলছি। গাড়ি চালাচ্ছেন হুমায়ুন কবির ভাই। একটি চৌরাস্তায় গাড়ির জিপিএসের সিগন্যালের হেরফেরে আমরা পথভুলে প্রবেশ করলাম ছোট একটি গলিতে। দুই পাশে অনেকগুলো কার কিছুটা অবিন্যস্তভাবে রাখা। গাড়ি ঘুরিয়ে আনার জন্য কিছুটা সামনে যেতে হল। কিন্তু একি! আমরা পথভ্রমে চলে এসেছি একেবারে পুলিশ অফিসে। পড়বি পড় মালির ঘাড়ে!
গাড়ি ঘুরিয়ে যেই একটু সামনে এগিয়েছি, অমনি বিপরীত দিক থেকে একটি সাদা রঙের কার প্রায় ত্রিশ ফুট দূরত্বে আমাদের পথ রুদ্ধ করে দাঁড়াল। কয়েক মুহুর্ত কাটল নিরবতায়। এরপর বিশাল দেহী পুলিশের এক কর্তা ব্যক্তি আমাদের দিকে এগিয়ে আসলেন। তিনি সাধারন ইউনিফর্মধারী পুলিশ নন। পুলিশের বিশেষ বিভাগের বড় পদ নিয়ে আছেন তা তার ইউনিফর্ম দেখেই বুঝা যাচ্ছে।
নিরবতা ভেঙ্গে হুমায়ুন ভাই বললেন, হ্যালো:
এবার কাছে এসে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, পুলিশ অফিসের দিকে কেন এসেছেন?
হুমায়ুন ভাই বললেন, এখানে শহরটি একটু ঘুরে দেখছি। হঠাৎ ভুলক্রমে এখানে এসে পড়েছি।
পুলিশ কর্তা ভুরু কুঁচকে বললেন, হুম। তাহলে ক্যামেরা, পুলিশ ষ্টেশনে?
তখন হুমায়ুন কবির ভাই বললেন, আমরা মাত্রই এসেছি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের বাড়ি থেকে। সেখানে কিছু ছবি তুলেছি। এখন যাচ্ছি ম্যানচেষ্টার।
পুলিশ কর্তা পাল্টা জিজ্ঞেস করলেন কার বাড়ি? উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের?
আমরা বললাম, হ্যাঁ। কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ।
পুলিশ কর্তা আর কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করলেন না। ইশারায় ইঙ্গিত করলেন চলে যেতে।
আমরাও ক্ষনিকের অস্বস্তিদায়ক মুহুর্তগুলোকে পিছনে ফেলে এগিয়ে চললাম ম্যানচেষ্টারের দিকে। উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের বাড়ির রেফারেন্সে বেশ স্বচ্ছন্দভাবেই বেরিয়ে এলাম পুলিশের ডেরা থেকে।
বদরুল হোসেন বাবু: যুক্তরাজ্যের এডিনবরায় বসবাসরত ফ্রিল্যান্স লেখক ও ব্লগার।