অধিনায়ক মাশরাফির যে বিশেষ গুণাবলি তাঁকে করেছে ব্যতিক্রম


বিপিএলে সাধারণ মানের একটি দল সিলেট। খেলোয়াড় সংগ্রহের তালিকায়ও নেই হেভিওয়েট নাম। বিশেষ করে সমকালীন জাতীয় দলের পরীক্ষিত ও দুর্দান্ত তারকাদের তেমন কেউই নেই। তারপরও এই দলটি রানর্সআপ পদক পেয়েছে। এর নেপথ্য কুশলী অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা।

কালে কালে কত অধিনায়কই না দেখেছে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল। কিন্ত অধিনায়ক মাশরাফি যেন এক জাদুকরের নাম। যার জাদুর ছোঁয়ায় বাংলাদেশ দল তো বটেই,দেশের গোটা ক্রিকেট সংস্কৃতির মোড়টাই যেন ঘুরে গিয়েছিল। কি এমন মন্ত্র জানা ছিল মাশরাফির,যাতে রাতারাতি সব সাফল্য এসে ধরা দিয়েছিল?

বাংলাদেশ দল কখনোই বড় কোন ক্রিকেট পরাশক্তি ছিল না। এখনও ওয়ানডেতে বাংলাদেশ মোটামুটি মধ্যম সারির দল হিসেবেই বিবেচিত হয়। আর টেস্ট ও টি টোয়েন্টিতে তো বাংলাদেশের অবস্থা আরো নাজুক। সুতরাং,বলাই যায় যে,বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশের যতটুকুই সাফল্য এসেছে,সেগুলো দল হিসেবেই খেলতে পারার ফল। পুরোপুরি একটা দলীয় পারফরম্যান্সের জেরেই জয়গুলো ধরা দিয়েছে। আর গোটা দলকে এক সুতোয় বাঁধার দায়িত্বটা সবচেয়ে বেশী পালন করতে হয় দলের অধিনায়ককে। তাঁর ওপরই যে অর্পিত থাকে গুরুদায়িত্ব। আর এই কাজটিই সবচেয়ে সফলভাবে করেছেন অধিনায়ক মাশরাফি বিন মোর্ত্তজা। এ কারণেই তিনি ওয়ানডেতে বাংলাদেশের সবচেয়ে সফলতম অধিনায়ক।

অধিনায়ক মাশরাফির কতটা সফল,সেটি পরিসংখ্যান ঘাঁটলেই বোঝা যায়।

টেস্ট ফরম্যাটে মাশরাফি শুধুমাত্র একটি ম্যাচেই অধিনায়কত্ব করতে পেরেছিলেন। দূর্ভাগ্যজনকভাবে ইনজুরির কারণে পুরো ম্যাচটি না খেলেই ম্যাচের মাঝপথেই মাঠ ছাড়তে হয় তাঁকে। তবে সেই ম্যাচটিতে কিন্তু জয়লাভ করেছিল বাংলাদেশ। সুতরাং,বলাই যায় যে,টেস্ট ক্রিকেটে অধিনায়ক মাশরাফির জয়ের হার ১০০%! ওয়ানডেতে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ ম্যাচে অধিনায়কত্ব করা ও সর্বোচ্চ সাফল্যের হার একমাত্র অধিনায়ক মাশরাফিরই!

 

Mashrafi

ওয়ানডে ফরম্যাটে মাশরাফির অধীনে সর্বোচ্চ ৮৮টি ওয়ানডে খেলেছে দল। তার মধ্যে ৫০ টি ম্যাচে জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ,জয়ের হার প্রায় ৫৭%!

টি টোয়েন্টি ফরম্যাটে মাশরাফির অধিনায়কত্বে ২৮ টি ম্যাচ খেলে ১০ টিতে জয় পেয়েছে বাংলাদেশ।

এছাড়া বৈশ্বিক আসরে মাশরাফির অধীনে ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল ও ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমি ফাইনালে খেলে বাংলাদেশ। এছাড়া আয়ারল্যান্ডে ত্রীদেশীয় টূর্ণামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়ে বাংলাদেশেকে প্রথম কোন টূর্ণামেন্টের শিরোপা এনে দেন মাশরাফি। তাঁর অধীনেই বাংলাদেশ দল সিরিজ জয় করে ভারত,পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকার মত পরাশক্তিদের বিরুদ্ধে। এছাড়া বাংলাদেশ অসংখ্য দ্বি-পাক্ষিক সিরিজ জিতেছে মাশরাফির অধীনেই। ঘরোয়া টূর্ণামেন্টগুলোতে মাশরাফি ধরে রেখেছেন সেই ধারাবাহিকতার ছাপ। সুতরাং,পরিসংখ্যানই অধিনায়ক মাশরাফিকে বারবার সবার ওপরেই স্থান দেয়।

ইনজুরির থাবায় বারবার জর্জরিত মাশরাফি অধিনায়কত্বের সবচেয়ে বেশি সুযোগ পেয়েছেন ওয়ানডে ফরম্যাটেই। আর সেখানেই তিনি দেখিয়েছেন তাঁর চূড়ান্ত মুন্সিয়ানা। তাহলে ঠিক কি কি কারণে তিনি এতটা সফল হওয়ার সূত্র পেয়েছিলেন? তাঁর মধ্যে এমন কি কি বিশেষ গুণাবলিই বা ছিল,যা তাকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়?

প্রথমত,একজন অধিনায়কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যোগ্যতা হল সবসময় ভাল পারফর্ম করে যাওয়া। কেননা,অধিনায়কের পারফরম্যান্সের ওপরই দলের বাকি খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স ও আত্নবিশ্বাসের গ্রাফ ওঠানামা করে। দলের বাকি সব খেলোয়াডও যদি বাজে পারফরম্যান্স করে,তবু অধিনায়ককে ভাল পারফরম্যান্স করতেই হবে। কেননা,দিনশেষে দলের কাণ্ডারী হিসেবে তাঁকেই জবাবদিহিতা করতে হয়।

অধিনায়ক মাশরাফি আর বোলার মাশরাফি যেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই পারফর্ম করে গিয়েছেন পুরোটা সময় জুড়ে ২০৯ ম্যাচে ২৬৫ উইকেট নেওয়া বাংলাদেশের সর্বকালের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী পেসার হিসেবে মাশরাফির নামটি যেন সেটিই প্রমাণ করে। ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে নিজ হাতেই তুলে নিয়েছেন বল। পরিস্থিতি অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ উইকেট তুলে নিয়ে কিংবা ডট বল করে ব্রেক থ্রু এনে দিয়ে পুরো ম্যাচের মোড়ই ঘুরিয়ে দিয়েছেন অসংখ্যবার। পুরো বোলিং বিভাগকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেছেন প্রত্যেকবার। সুতরাং,অধিনায়কত্বকালীন সময়ে বোলার মাশরাফি ব্যাক্তিগত পারফরম্যান্সে ছিলেন অনবদ্য।

Mashrafi

অধিনায়কের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল,মাথা খাটিয়ে ম্যাচের পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া। সেটি হতে পারে ট্যাকটিকাল বিষয়,একাদশ নির্ধারণ,ব্যাটিং অর্ডার নির্ধারণ,বোলারদের সঠিক ব্যবহার,ফিল্ড সেটিং নির্ধারণ,পরিস্থিতি অনুযায়ী ক্যালকুলেটিভ রিস্ক নেয়া,মাথা ঠান্ডা রেখে প্রতিপক্ষের ট্যাকটিকস পড়ে ফেলে সেটির জবাব হিসেবে নতুন চাল চালা ইত্যাদি ইত্যাদি।

অধিনায়ক মাশরাফি এখানেও ছিলেন চূড়ান্ত সফল। ম্যাচের প্রতিপক্ষ ও কন্ডিশন অনুযায়ী সেরা একাদশ বেছে নেয়া,কোন ট্যাকটিক্স এ এগোতে হবে সেটি পূর্বেই ঠিক করে নেয়া ছিল তাঁর চূড়ান্ত পারদর্শিতা। দু এক ম্যাচ পরপরই একাদশে পরিবর্তন না এনে খেলোয়াড়দের পর্যাপ্ত সুযোগ দেয়ার সাথে সাথে নতুনদেরও ঝালিয়ে নিতেন তিনি। প্রচুর পরিমাণে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার দরুণ তার অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার ছিল পরিপূর্ণ। সেটিকে কাজে লাগিয়েই মাঠে সাজাতেন পরিকল্পনা।

যখন পরিস্থিতি কোনভাবেই অনুকূলে আনা যেত না,তখন মাশরাফি এক বিশেষ ধরণের “গ্যাম্বলিং” করতেন। এটি ছিল চূড়ান্ত সাহসিকতা ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। কেননা এর ফলাফল হিসেবে হয় চূড়ান্ত সফলতা আসবে,নতুবা পুরোটাই হয়ে যাবে ব্যর্থ। তবে বেশিরভাগ সময়ই মাশরাফি সফল হতেন। গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে কখনোবা পরিবর্তন আনতেন পূর্ব নির্ধারিত ব্যাটিং লাইন-আপ এ। বোলিংয়ে হুট করেই নিয়ে আসতেন অনিয়মিত কোন বোলারকে। অস্বাভাবিক জায়গায় ফিল্ডার দাঁড় করিয়ে অস্বস্তিতে ফেলতেন ব্যাটসম্যানকে। তাঁর এসব ভিন্নধর্মী “গ্যাম্বলিং”ই চূড়ান্ত চাপে ফেলে ভজকট পাকাতে বাধ্য করত প্রতিপক্ষকে।

একজন পরিপূর্ণ অধিনায়ক হতে হলে তাঁকে মাঠের ভেতরে ও মাঠের বাইরে- দু জায়গাতেই সমান অবদান রাখতে হয়। দুটির মধ্যে একটিতে আনাড়ি হলেও কেউ পূর্ণাঙ্গ অধিনায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনা। অধিনায়ক মাশরাফি মাঠের ভেতরে যতটা না সফল ছিলেন,মাঠের বাইরের অধিনায়কত্বে মাশরাফির সমকক্ষ বাংলাদেশে তো দূরে থাক,বিশ্ব ক্রিকেটেই রীতিমতো বিরল। ড্রেসিংরুম কিংবা ড্রেসিংরুমের বাইরে প্রতিটি খেলোয়াড়কে মাশরাফি যেন আগলে রাখতেন নিজের আপন ছোট ভাইয়ের মত। ক্রিকেট একটি মনস্তাত্ত্বিক খেলা।

একজন খেলোয়াড় যতই প্রতিভাবান কিংবা টেকনিক্যালি দৃঢ় হোক না কেন,মানসিকভাবে চূড়ান্ত শক্তিশালী কিংবা পর্যাপ্ত আত্মবিশ্বাস না থাকলে শত চেষ্টা সত্ত্বেও সফল হতে পারেনা। আর এ জায়গাতেই প্রতিটি খেলোয়াড়ের চূড়ান্ত আস্থার নাম মাশরাফি। বাংলাদেশ দলে প্রতিভাবান খেলোয়াড়ের অভাব কোনকালেই ছিল না,কিন্তু মানসিকভাবে পর্যাপ্ত শক্তিশালী ও আত্নবিশ্বাসী না হওয়ায় তারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদেরকে তেমনভাবে মেলে ধরতে পারছিল না। এদেরকে মাশরাফিই চূড়ান্ত আত্নবিশ্বাস যুগিয়ে শতভাগ উজ্জ্বল পারফরম্যান্স নিংড়ে বের করে এনেছিল। দিয়েছিল চূড়ান্ত ভরসা। বারবার ব্যর্থতার পরও পিঠ চাপড়ে সাহস যুগিয়েছিল তাদের। ফলাফল হিসেবে তারাও দিয়েছিল প্রতিদান।

মাশরাফি জানতেন,হাতের পাঁচ আঙুল সমান না। তাই,একেক খেলোয়াড়ের জন্য একেক রকম টোটকা জানা ছিল তাঁর। কখনোবা আদর করে,কখনোবা শাসন করে বোঝাতেন তাদের। সিনিয়র কিংবা জুনিয়র,যখনই যে খেলোয়াড় সমস্যায় পড়ত,তারা ছুটে আসত মাশরাফির কাছে। সেখানেই যেন তারা পেত সেই বহুল প্রতীক্ষিত সমাধান।

মাশরাফি যখন অধিনায়কত্বের দায়িত্ব নেন,তখন বাংলাদেশ ছিল এক চূড়ান্ত ভঙ্গুর দল। একের পর এক হারে যেন জিততেই ভুলে গিয়েছিল বাংলাদেশ। আত্নবিশ্বাস গিয়ে পৌঁছেছিল চূড়ান্ত তলানিতে। এক কথায়,বাংলাদেশ দল ছিল এক দিশাহারা জাহাজে। সেই দলকে সঠিক পথে নিয়ে আসার মত প্রায় অসম্ভব গুরুদায়িত্ব দেয়া হল মাশরাফিকে। তবে মাশরাফি তাতে এতটুকুও চিন্তিত হননি। নেতৃত্ব দেওয়া তো তাঁর রক্তে মিশে আছে।

Mashrafi

সেই ছোটবেলা থেকে স্কুল,পাড়া,অনুষ্ঠান কিংবা খেলা,সব জায়গাতেই নেতৃত্বগুণে সকলকে মুগ্ধ করেছেন তিনি। তাই,এই পাহাড়সম কঠিন চ্যালেঞ্জটি নিতেও ঘাবড়ালেন না মাশরাফি। দায়িত্ব নিয়েই মাশরাফি বুঝে গেলেন দলটার মূল সমস্যা মানসিকতায়। তাইতো পর্যাপ্ত সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র ভঙ্গুর মানসিকতার কারণেই বারবার ব্যর্থ হচ্ছে দল। মাশরাফিই প্রথম যিনি কিনা দলের সবার মধ্যে প্রচন্ড সাহস ছড়িয়ে দিলেন যে-“আমরাও জিততে পারি,মাঠে নামার আগেই আমরা হেরে যাব না। প্রতিপক্ষ যতই শক্তিশালী হোক না,আমরা আমাদের সামর্থ্যের শতভাগ নিংড়ে দেব। তাতে ফলাফল যাই হোক না কেন।” আর মাশরাফির সেই বজ্রহুংকার তো এখনও তুমুল জনপ্রিয়-“ধরে দিবানে!”

ব্যাস! ব্যর্থতার বৃত্তে ঘুরপাক খেতে থাকা দলটা যেন হঠাৎই কোন এক জাদুমন্ত্রে গা ঝাড়া দিয়ে উঠল। ভয়ের পরিবর্তে লড়াই করতে লাগল প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে। সমীহ আদায় করে নিতে লাগল প্রতিপক্ষের। হারতে হারতে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া দলটা এবার যেন জেতাটাকে অভ্যাসে পরিণত করে ফেলল। ওরা যেন যুদ্ধের রণাঙ্গণে একদল টগবগে সাহসী সৈনিক,যাদের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে মাশরাফি নামক এক লড়াকু,অকুতোভয় সেনাপতি!

বারবার হারের চূড়ান্ত ব্যর্থতা দেখে মুখ ফিরিয়ে নেয়া সমর্থকরাও যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পেলেন। আবারও যেন আশায় বুক বাঁধতে শুরু করলেন। সমর্থনে গর্জে উঠে টাইগারদের সাহস যোগাতে শুরু করলেন। মাশরাফির কাছে যেন তাদের চাওয়া-পাওয়ার কোন শেষ নেই। এক মাশরাফিতেই ঘুরে দাঁড়াল দেশের গোটা ক্রিকেট সংস্কৃতি। আবারও ক্রিকেট উত্তাপে কাঁপতে লাগল গোটা বাংলাদেশ। মাশরাফি ও তাঁর দল একের পর এক আনন্দের উপলক্ষ উপহার দিতে থাকল দেশবাসীকে।

আরও দেখুন:যুবা টাইগারদের হাত ধরেই আবার ঘুরে দাঁড়াক বাংলাদেশের ক্রিকেট

মাশরাফি এমনই অধিনায়ক ছিলেন,যিনি কিনা শুধু বাইশ গজ নয়,গোটা বাস্তব জীবনেরই অধিনায়কত্ব করেছেন। নের্তৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা যাঁর রক্তে মিশে আছে। সময়ের পরিক্রমায় মাশরাফিকেও অধিনায়কত্ব ছাড়তে হয়েছে। কিন্তু,অধিনায়ক মাশরাফিকে কি ভুলে যাওয়ার কোন অবকাশ আছে? চিত্রা নদীতে সাঁতার কাটা সেই ছোট্ট কৌশিক তো তাঁর নেতৃত্বগুণ দিয়েই হয়ে উঠেছেন “ক্যাপ্টেন ফ্যান্টাস্টিক মাশরাফি”। বাংলাদেশ দলে বহু অধিনায়ক এসেছিল,আছে,আসবে। তবে,”ক্যাপ্টেন ফ্যান্টাসিক” একজনই!