যে দেশের প্রাচীন সভ্যতা হরপ্পা ও মহেন্জোদারো


পাকিস্তানের সিন্ধু অঞ্চল যা মোটামুটি বর্তমান পাকিস্তানের দক্ষিণ -পশ্চিম অংশ ছাড়া বাকিটা নিয়ে গঠিত। প্রাচীনকালে নব্য প্রস্তর যুগীয় মেহেরগড় সহ অনেক উন্নত সভ্যতার উৎপত্তিস্থল ছিল এই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল। ব্রোঞ্জ যুগে সিন্ধু সভ্যতায় অর্থাৎ ২৮০০ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো নামে দুটি উন্নত নগর গড়ে উঠেছিল।

বৈদিক যুগে অর্থাৎ ১৫০০ থেকে ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে ইন্দো আর্যদের মাধ্যমে এখানে হিন্দুদের গোড়াপত্তন হয়, যা পরবর্তীতে পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। সেই সময়ে মুলতান হিন্দুদের গুরুত্বপূর্ণ তীর্থকেন্দ্রে পরিণত হয়। মুলতান মূলত একটি প্রাচীন শহর। এই প্রাচীন শহরটি খ্যাতনামা মুলতান সূর্য মন্দিরের এলাকায় ছিল। ম্যালিয়ান অভিযানের সময় আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট তা অবরোধ করেছিলেন। মুলতান মধ্যযুগীয় ইসলামী ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল। একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীতে একাধিক সুফি সাধকের আগমন ঘটে এই শহরে। যার ফলে একসময়ে একে সুফিদের শহর, সন্ন্যাসীদের শহর, মাদিনাত -উল আউলিয়া প্রভৃতি নামে পরিচিত ছিল। মুলতান শহরটি সুফি -আউলিয়াদের মাজারের জন্য বিখ্যাত। কয়েক হাজার বছর আগে এই মুলতানে  হিন্দুদের হতে প্রহ্লাদপুরী মন্দির গড়ে উঠেছিল। কিন্তু বর্তমানে এটি ধ্বংসাবশেষ অবস্থায় রয়েছে।

ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে পাকিস্তানের বর্তমান অঞ্চলগুলি স্বাধীনভাবে রাজারা শাসন করতো। তারপর ধীরে ধীরে পাকিস্তান অঞ্চলটি ব্রিটিশ অধিভুক্ত হয়।

আরও পড়ুন: হুগলীর তীরে প্রিয় শহর কলকাতায়, পর্ব-4

১৯৪৭ খৃষ্টাব্দে দখলদার ব্রিটিশ রাজশক্তি ভারতীয় উপমহাদেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হলে সেই সময়ে উপমহাদেশ বিভাজনের মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তান এ দু’টি দেশের জন্ম হয়।

পাকিস্তানের দর্শনীয় স্থান –

মহেঞ্জোদাড়ো – মহেঞ্জোদাড়ো ছিল প্রাচীন ভারতের সিন্ধু সভ্যতার বৃহত্তম নগর বসতিগুলির মধ্যে অন্যতম। এটি সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলায় অবস্থিত। ২৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ নির্মিত মহেঞ্জোদাড়ো শহরটি ছিল পৃথিবীর প্রাচীনতম শহরগুলির অন্যতম। মহেঞ্জোদাড়ো শহরটি প্রাচীন মিশর, মেসোপোটেমিয়া ও ক্রিটের সভ্যতার সমসাময়িক।

তক্ষশীলা – পাঞ্জাব প্রদেশের রাওয়ালপিন্ডি জেলায় তক্ষশীলা শহরটি অবস্থিত। এটিও ছিল প্রাচীন শহর।

হরপ্পা – হরপ্পা পাঞ্জাব প্রদেশের একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এলাকা। বর্তমানে এটি একটি ছোটো শহর।

মেহেরগড় – মেহেরগড় সভ্যতা ৭০০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বের মধ্যে গড়ে উঠেছে। মেহেরগড় সভ্যতা আবিষ্কার হয় ১৯২৯ খৃষ্টাব্দে। এটি বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতা হিসাবে পরিচিত।

পাকিস্তানের দর্শনীয় শহরগুলো হলো – লাহোর, করাচী, পেশোয়ার, রাওয়ালপিন্ডি, মুলতান, জিয়ারাত, মুরী, মারি, শিয়ালকোট, গুজরানওয়ালা, কোয়েটা, হায়দ্রাবাদ, উমরকোট, সোনমিয়ানি, জিয়ানি, জেকোবাবাদ, লারকানা, ভাওয়ালপুর, মজফঃরগড়, শাহিওয়াল, সারগোদা, কসুর, চিত্রাল, ফয়সালাবাদ।

পাকিস্তানের কয়েকটি ভ্যালি বা উপত্যকা খুবই আকর্ষণীয়। এগুলো হলো – নীলম ভ্যালি, হুনজা ভ্যালি, কঙ্গন ভ্যালি।

লাহোর দেখা –

কী করেইবা ভুলি ১৯৯২ সালের কথা। ওই বছরই গিয়েছিলাম লাহোরে। লাহোরে গিয়ে সম্রাট জাহাঙ্গীর আর সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের সমাধি দেখলাম দু’নয়ন ভরে। সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের সমাধি দেখে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা – ‘গরিব গোরে দ্বীপ জ্বেলো না,  ফুল দিও না কেউ ভুলে, শামা পোকার না পোড়ে পাখ, দাগা না পায় বুলবুলে।’ কবিতার এই লাইনটি। অবশ্য সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের লেখা কবিতারই  অনুবাদ ছিলো সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা ওই কবিতাটি।

সম্রাট জাহাঙ্গীরের মৃত্যু হয় ১৬২৭ সালের ২৮ অক্টোবর, তাঁকে লাহোরে সমাহিত করা হয়েছিল। এরই ১৮ বছর পর ১৬৪৫ সালের ১৮ ডিসেম্বর মারা যান সম্রাজ্ঞী নুরজাহান। নুরজাহানের সমাধির দেয়ালে হাত স্পর্শ করে বলেছিলাম নুরজাহান – নুরজাহান – নুরজাহান সিন্ধু নদীতে ভেসে এলে মেঘলা মতির দেশে…..!  আমি যে এসেছি পূর্ব বাংলার এক শ্যামল গাঁও হতে একটিবার সাড়া দিন – একটি বার সাড়া দিন’ !

তবে লাহোরে গিয়ে আরও বেশি ব্যাকুল হয়েছিলাম  উপমহাদেশ ভাগাভাগির আগেকার হিন্দি ছবির নায়িকাদেরকে দেখবার জন্য।

ভালো করেই জানা ছিলো-  নূরজাহান, মমতাজ শান্তি, স্বর্ণলতা প্রমুখ থাকেন লাহোরে।

হরপ্পা ও মহেন্জোদারো

নূরজাহানের বাড়ির সামনে গিয়ে শুনি, উনি এখন আর লাহোরে থাকেন না । নূরজাহান থাকেন করাচিতে নিজ বাড়িতে। নূরজাহানকে না-দেখতে পারা আমার সারা জীবনের দুঃখ হয়েই থাকলো। শৈশবে নূরজাহান অভিনীত ছবি কিম্বা পরবর্তীতেও তাঁর ছবি দেখা নিয়ে আছে কতই না স্মৃতিগাঁথা। নূরজাহানের ‘আনমোল ঘড়ি’ ছবিটি কতবার যে দেখেছি –  সে-কথাও তো ভোলার নয়। ‘আওয়াজ দে কহা হ্যায়’ কিম্বা ‘ জাওয়া হ্যায় মোহাব্বত ‘ গানের  কথা বার বার মনে পড়ছিল লাহোরে গিয়ে।

তবুও দুঃখ নেই, দেখেছি মমতাজ শান্তিকে এককালের সাড়া জাগানো, সর্বকালের সুপারহিট ছবি ‘কিসমত’-এর নায়িকা মমতাজ শান্তিকে লাহোরে তাঁর বাড়িতে গিয়ে সরাসরি দেখেছিলাম।

উনি উর্দুতে যা বলেছিলেন তা বাংলায় হলো, ‘আমি যখন নায়িকা তখন তোমার বয়স ২৪ বছর হলে ভালো হতো। ইশ! তুমি আমাকে আমার শেষ বয়সে এসে দেখলে।’ মমতাজ শান্তির সাথে দেখা হওয়ার এক বছর পরে ১৯৯৩ সালে তিনি মারা যান। তাই বলতে হয়, আমি কীই না ভাগ্যবান –  ১৯৯৩ সালে লাহোরে গেলে দেখতেই পেতাম না ‘কিসমত’ এর নায়িকা মমতাজ শান্তিকে।

‘ঘর কি ইজ্জত’, ‘বসন্ত’ ছবি দু’টির কথাও বেশ করে মনে পড়ে‌ –  ওই দুই ছবিতে মমতাজ শান্তি নায়িকা ছিলেন।

স্বর্ণলতা –

‘রতন’ ছবি দেখেই স্বর্ণলতার প্রতি দুর্বলতা জেগেছিল। লাহোরে গিয়ে সেই ১৯৯২ সালেই তাঁর সাথে দেখা করেছিলাম।

স্বর্ণলতা আমাকে উর্দুতে যা বলেছিলেন, তা বাংলায় হলো ‘আমার জন্মস্থান রাওয়ালপিন্ডি। ‘খুবই সুন্দর শহর। ওখানে বেড়াতে যেতে পারো…।’ স্বর্ণলতার দিকে চোখে চোখ রেখে বললাম,

‘রুমঝুম বরষে বদর অঁ পিয়া ঘর আজ।’

গানখানি কী করে ভুলি! তখন তাঁর বয়স ৬৮ বছর ছিল সম্ভবত। স্বর্ণলতা হাসলেন । উর্দুতে যে কথাগুলো বললেন তা বাংলা ভাষায় হলো – ‘এ গানের কৃতিত্ব তো আমার নয় –  এ গানের শিল্পী জোহরাবাঈ আম্বালওয়ালি। পাঞ্জাবের আম্বালায়  কিম্বা বোম্বেতে গিয়ে তাঁর সাথে কখনো কি কোনোদিন দেখা করেছিলে? জোহরা তো বছর দুই আগে ১৯৯০ সালে মারা গেল। পারলে ওর কবরটা মুম্বাইতে গিয়ে দেখে যেয়ো। তুমি তো আমারই ভক্ত নও, জোহরার প্রচণ্ড ভক্ত।’

পাকিস্তান দক্ষিণ এশিয়ার একটি রাষ্ট্র। এর সরকারি নাম ইসলামি প্রজাতন্ত্র পাকিস্তান। ২১,২৭,৪২,৬৩১ জনের অধিক জনসংখ্যা নিয়ে এ দেশটি জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম রাষ্ট্র। আর আয়তনের দিক থেকে ৩৩তম বৃহত্তম দেশ।

পাকিস্তানের দক্ষিণে আরব সাগর এবং ওমান উপসাগরীয় উপকূলে ১০৪৬ কিলোমিটার উপকূল রয়েছে। পাকিস্তানের পূর্ব দিকে ভারত ; ইরান দেশটি এর দক্ষিণ -পশ্চিমে রয়েছে। পাকিস্তানের উত্তর -পূর্ব দিকে চীন আর উত্তর -পশ্চিমে আফগানিস্তান। তবে আফগানিস্তানের ওয়াগন করিডোরের দ্বারা তাজিকিস্তান থেকে সংকীর্ণভাবে বিভক্ত আছে। ওদিকে ওমানের সাথে সমুদ্রের সীমান্ত ভাগ করা রয়েছে পাকিস্তানের সঙ্গে।

দেশের নীতিবাক্য – ‘বিশ্বাস, একতা, শৃঙ্খলা’।

পাকিস্তানের স্বীকৃত জাতীয় ভাষা – উর্দু। এছাড়াও দেশটিতে পাঞ্জাবি, সিন্ধী, সারাইকি, পশতু, বেলুচি, ব্রাহুই ইত্যাদি ভাষা প্রচলিত রয়েছে।

দেশের প্রায় ৯৭ শতাংশ লোক ইসলাম ধর্মাবলম্বী। এছাড়া এ দেশে হিন্দু, খ্রিস্টান ও আহমদিয়া ধর্মের লোকও বসবাস করে থাকে।

জাতীয়তাবাদ – পাকিস্তানি।

ফার্সি ও উর্দু ভাষায় পাকিস্তান অর্থ পবিত্র স্থান বা এলাকা।

পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ডটি কয়েকটি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত। যেমন – পাঞ্জাব, সিন্ধু, খাইবার পাখতুনখোয়া, বেলুচিস্তান, গিলগিট -বালতিস্তান, ইসলামাবাদ রাজধানী অঞ্চল।