যিশুখ্রিষ্টের জন্মস্থান যে দেশে 


পশ্চিম এশিয়া তথা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে ইসরায়েল রাষ্ট্রটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ দেশটি ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণ -পূর্ব তীরে ও লোহিত সাগরের উত্তর তীরে অবস্থিত। দেশটির উত্তর স্থলসীমান্তে লেবানন, উত্তর -পূর্বে সিরিয়া, পূর্বে জর্দান ও ফিলিস্তিন -অধ্যুষিত ভূখণ্ড। পশ্চিমে ফিলিস্তিন ভূখণ্ড, গাজা উপত্যকা রয়েছে। তাছাড়া দক্ষিণ -পশ্চিমে মিশর অবস্থিত। লিখেছেন দুই বাংলার অন্যতম সেরা ভ্রমণ লেখক লিয়াকত হোসেন খোকন

ইসরায়েলের রাজধানী বসেছে জেরুজালেমে বা জেরুসালেমে। এ দেশের বৃহত্তম শহর হলো তেল আবিব। 

ইসরায়েলের সরকারি ভাষা হিব্রু। তবে এ দেশে আরবি ভাষা স্বীকৃত। নৃগোষ্ঠীরা হলো – ইহুদি, আরব ও অন্যান্য। 

ইসরায়েলের প্রায় শতকরা ৭৫ ভাগ লোক ইহুদি ধর্মে বিশ্বাসী। ইসলাম ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা শতকরা প্রায় ১৮ ভাগ। খ্রিস্টান ও দ্রুজ ধর্মের লোকরাও এখানে বসবাস করে থাকে। 

ইসরায়েলের আয়তন প্রায় ২১,৭৭০ বর্গকিলোমিটার। 

জনসংখ্যা ৯,৩৪৮,৮৫০ জন। 

ভূমধ্যসাগরের উপকূলে অবস্থিত তেল আবিব দেশটির অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত প্রাণকেন্দ্র এবং বৃহত্তম মহানগর এলাকা। ইসরায়েল সমগ্র জেরুজালেম শহরকে তাদের রাজধানী হিসেবে দাবী করে আসছে। যদিও এই মর্যাদা বিশ্বের সংখ্যা গরিষ্ঠ রাষ্ট্রই স্বীকার করে না। 

জেরুজালেম শহরের পশ্চিম ভাগ ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে। পশ্চিম ভাগে দেশটির সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি অবস্থিত। 

ইসরায়েলের হাইফা ও বে -এরশেভা শহর দু’টিও বেশ বড়ো। 

অর্থনৈতিক ভাবে ইসরায়েল একটি অত্যন্ত উন্নত শিল্পপ্রধান রাষ্ট্র। বিশ্বব্যাঙ্কের হিসাব মতে, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে এ দেশটি এশিয়ার তিনটি উচ্চ আয়ের রাষ্ট্রগুলির একটি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতে, এ দেশটি বিশ্বের ৩৯ টি অগ্রসর অর্থনীতি সমৃদ্ধ দেশগুলির একটি। 

১৯৪৮ খৃষ্টাব্দে দেশটির স্বাধীনতা লাভের সময় নাম রাখা হয় ‘স্টেট অফ ইসরায়েল’। আবার হিব্রু ভাষায় নাম রাখার কথা ভাবা হয়েছিল যেমন – ইস্রায়েল দেশ, সিয়োন অথবা যিহূদিয়া। তবে ইসরায়েল নামটি হিব্রু ও আরবি দু’টো ভাষায়ই হওয়াতে এই নামই রাখাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়।

সপ্তম শতকে মুসলিমরা ইসরায়েল ভূখণ্ডটি তাদের দখলে নিয়ে নেয়। ১০৯৯ খৃষ্টাব্দে এটি খ্রিস্টানদের দখলে যায়। ১১৮৭ খৃষ্টাব্দে এটি আবার আইয়ুবীয় রাজবংশের অধীনে চলে যায়। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ইসরায়েল মিশরের নিয়ন্ত্রণে আসে, ১৫১৭ খৃষ্টাব্দে এটি উসমানীয় সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। ইহুদিরা সপ্তম শতাব্দী থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে বেড়িয়েছে। একসময় ইহুদিরা ইউরোপ মহাদেশে পাড়ি জমায়। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনের পর ইসরায়েল দেশটি ইহুদিরা জোরপূর্বক দখল করে নেয়। আবার ব্রিটিশরা তাদের অধীনে নিয়ে নেয় এবং নাম রাখে মেন্ডেটরি প্যালেস্টাইন। 

১৯১৭ খৃষ্টাব্দে ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করে। এরপর ফিলিস্তিনে ইহুদিদের আলাদা রাষ্ট্রের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়। অতঃপর বিপুলসংখ্যক ইহুদি ইউরোপ থেকে ফিলিস্তিনে এসে বসতি স্থাপন করতে থাকে। 

১৯৪৮ খৃষ্টাব্দে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডকে দ্বিখণ্ডিত করা সংক্রান্ত ১৮১ নম্বর প্রস্তাব গৃহীত হয়। জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে দ্বিখণ্ডিত করার প্রস্তাব পাশ করে ৪৫ শতাংশ ফিলিস্তিনীদের হাতে এবং বাকি ৫৫ শতাংশ ভূমি ইহুদিবাদীদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আর এ ভাবে ১৯৪৮ খৃষ্টাব্দের ১৪ মে ইসরায়েল আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। 

ইসরায়েলে ৭টি জেলা আছে, এগুলো হলো – জেরুজালেম জেলা, উত্তর জেলা, হায়ফা জেলা, মধ্য জেলা, তেল আবিব জেলা, দক্ষিণ জেলা এবং জুডিয়া এ্যান্ড সামারিয়া।

ইসরায়েলের সংস্কৃতি পশ্চিমা ঘরানার। 

ইসরায়েলের পর্যটন মূলত ইহুদি, ইসলাম ধর্মের পবিত্র ও ঐতিহাসিক স্থানগুলিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। দেশটির সর্বত্র ইহুদি ধর্মের ও সভ্যতার স্মৃতিবিজড়িত নানা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। 

ইহুদিদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় শহর এবং মুসলিম ও খ্রিস্টানদেরও গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান হল জেরুজালেম শহর। 

জেরুজালেমের ইহুদি মন্দির ও পশ্চিম দেওয়াল বিখ্যাত। 

এছাড়া আছে যিশুখ্রিষ্টের জন্মস্থান বেথেলহাম বা বেথলেহামে তাঁর বাসস্থান নাজারেখ। 

এখানে হারাম আল শরীফ তথা আল -আকসা মসজিদ অবস্থিত। ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ যা মুসলমানদের প্রথম কিবলা হিসেবে পরিচিত। 

জেরুজালেম –

জেরুজালেম বা জেরুসালেম এশিয়া মহাদেশের মধ্যপ্রাচ্যে ভূমধ্যসাগর ও মৃত সাগরের মধ্যবর্তী যোধাইয়ান পর্বতের মালভূমিতে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় নগরী। 

জেরুজালেম শহরটি কয়েকটি ধর্মের মানুষের কাছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ। 

তন্মধ্যে রয়েছে ইব্রাহিমীয় ধর্মের ইহুদি ধর্ম, খ্রিস্টান ধর্ম এবং ইসলাম ধর্ম। এই তিন ধর্মাবলম্বীদের কাছে জেরুজালেম পবিত্র স্থান বা পবিত্র শহর। 

এই জেরুজালেম শহরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সহস্র বছরেরও প্রাচীন ইতিহাস। জেরুজালেম শহরটি বর্তমানে ইসরায়েলে অবস্থিত। বিশ্বের সবচেয়ে 

পবিত্র স্থানগুলির মধ্যে জেরুজালেম অন্যতম। 

প্রাচীন কাল থেকে ভয়াবহ সংঘর্ষ চলে আসছে নানান কিছুকে কেন্দ্র করে। 

বাইবেল অনুসারে, রাজা ডেভিড জেরুজালেম শাসন করেন এবং এটিকে ইসরায়েল রাজ্যের রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর পুত্র রাজা সলোমন টেম্পল মাউন্টে প্রথম ইহুদি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ইতিহাস বলে, এটিই প্রথম প্রার্থনালয় জেরুজালেমে। 

৫৮৬ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে ব্যবিলনীয়রা জেরুজালেম অধিকার করে। তারা সেই সময়ে ইহুদিদের সব মন্দির ধ্বংস করে এবং ইহুদিদের নির্বাসনে পাঠায়।

এভাবেই ইহুদিদের সাথে শুরু হয় বৈরিতা। 

মহান কুরুশ ব্যাবিলনের ইহুদিদের বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে জেরুজালেমে ফিরে যেতে দেন। এরও প্রায় ৫০ বছর পরে পার্সিয়ান রাজা সাইরাস ইহুদিদের আবারও জেরুজালেমে ফেরত আসতে দেন এবং আবার মন্দির স্থাপন করেন। এছাড়াও ৫৩৯ এবং ৫৩০ খ্রিস্টপূর্বের মাঝামাঝি কোন এক সময়ে সাইরাস সিলিন্ডার ঘোষণা পত্রের মাধ্যমে বৈশ্বয়ীক মানবাধিকার ঘোষণা করেছিলেন যা বিশ্বের ইতিহাসে ঐতিহাসিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রথম মানবাধিকারের সনদ। 

৩৩২ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে এসে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ নেন। পরবর্তীতে কয়েক শত বছর ধরে নানান দল বা গোষ্ঠী এই শহরটিকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের মধ্যে রোমান, পার্সিয়ান, আরবস, সেলজুক, তুর্কী, ক্রুশাডার, ইজিপশিয়ান, মামেলুকিস ও মুসলিমরা ছিল। 

জেরুজালেম শহরটি খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের কাছে অনেকভাবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, এখানেই শিশু হিসেবে এসেছিলেন যিশুখ্রিস্ট। এই যিশুখ্রিস্ট হলেন খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারক। প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় এখানেই ধর্ম প্রচার করেছেন তিনি এবং জীবনের শেষে এখানেই ক্রুশে বিদ্ধ হয়েছেন ও ঈশ্বরের দ্বারা পুনরুত্থিত হয়েছেন বলে বর্ণিত আছে। 

আবার ইহুদিদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তাদের ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মোজেসেরেরও পূণ্যভূমি এই জেরুজালেম। ইহুদিদের প্রথম মন্দির এই শহরে অবস্থিত ছিল। যা টেম্পলে অবস্থিত ছিল। যা ৩৭ খ্রিস্টাব্দে রাজা হেরড সেখানে দ্বিতীয় মন্দির তৈরি করেন এবং সেটার চারপাশে দেয়াল তুলে দেন। রোমানরা এগুলো ধ্বংস করে দেয় ৭০ খ্রিস্টাব্দে। 

৬৩২ খ্রিস্টাব্দে ইসলামের নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) বোরাকে চড়ে মিরাজে গমন করেন। যা ধর্মীয়ভাবে খুবই মর্যাদাকর ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে। পাশাপাশি ইসলাম  ধর্মীয় ইতিহাসে পবিত্র নগরী হিসেবেই আলোকপাত করা হয়েছে বেশি।  

তেল আবিব – 

তেল আবিব হচ্ছে ইসরায়েলের একটি অন্যতম প্রধান নগরী। এ শহরটি হচ্ছে ইসরায়েলের অর্থনৈতিক কেন্দ্র এবং প্রযুক্তির সূতিকাগার। সাড়ে চার লাখ জনসংখ্যা নিয়ে তেল আবিব ইসরায়েলের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। এ শহরের দর্শনীয় হলো – ইসরায়েলী সেন্টার, গর্ডন বিচ, সিটি হল, জাফা ক্লক টাওয়ার, হোয়াইট সিটি। 

উন্নত রাস্তা, পার্ক, বাগান, কৃত্রিম বন, নৈশ ক্লাব, মদের বার সহ আধুনিক সকল নাগরিক সুবিধাই তেল আবিব শহরটিতে রয়েছে। 

ইসরায়েলের ভূমধ্যসাগর তীর জুড়ে রয়েছে অসংখ্য অবকাশ কেন্দ্র যাপন ও ট্যুরিস্ট স্পট। 

আরও আছে লবণাক্ত মৃত সাগর, যার পানিতে ভেসে থাকা যায়। 

ইসরায়েলের পাশে লোহিত সাগরের উপকূল এবং গ্যালিলির সাগরের উপকূল জুড়ে রয়েছে ট্যুরিস্ট স্পট।