বাংলাদেশের শিল্পী ফেরদৌসী রহমান । তাঁর গান একসময় বাংলা ছবিতে শুধু জনপ্রিয়তা ও সাফল্যই দেয়নি, দিয়েছিল এক ধরনের সুরমগ্ন মাদকতাও। বলা যায় বাংলাদেশের ( পূর্ব বাংলা ) শ্রেষ্ঠ সংগীত শিল্পী ফেরদৌসী রহমান । লিখেছেন দুই বাংলার অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র ও ভ্রমণ লেখক লিয়াকত হোসেন খোকন ।
তাঁর সুমধুর কন্ঠে গাওয়া ‘মনে যে লাগে এত রং ও রঙিলা’, ‘নিশি জাগা চাঁদ হাসে কাঁদে আমার মন’, ‘আমি রূপনগরের রাজকন্যা রূপের জাদু এনেছি’, ‘এই সুন্দর পৃথিবীতে আমি এসেছিনু নিতে’ মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে।
এছাড়াও ফেরদৌসী রহমানের আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল ‘এই রাত বলে ওগো তুমি আমার’, ‘বিধি বইসা বুঝি নিরালে’, ‘এই যে নিঝুম রাত ঐ যে মায়াবী চাঁদ’, ‘মনে হলো যেন এই নিশি লগনে’, ‘ঝরা বকুলের সাথি আমি সাথিহারা’, ‘আমার প্রাণের ব্যথা কে বুঝবে সই’, ‘যে-জন প্রেমের ভাব জানে না’, ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’, ‘পদ্মার ঢেউরে’ – এমনি শত শত গান সিনেমায় আর রেকর্ডে গাওয়ার কারণে একসময়ে তাঁর জনপ্রিয়তা হয়ে উঠেছিল গগনচুম্বী।
ঢাকার সিনেমা হিট হওয়ার অনিবার্য হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল ফেরদৌসীর গান। ১৯৫৯ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ফেরদৌসী ছাড়া সিনেমার গান ছিল প্রায় অচল। ফিল্মে গান করা ছেড়ে দিয়েছেন বহু বছর হয়। অথচ তাঁর গাওয়া অতীতের সে-সব গান আজ অবধি জনপ্রিয় হয়ে থাকল। আর এজন্য সংগীতভুবনে ফেরদৌসী রহমান কিংবদন্তি।
জন্ম তাঁর ১৯৪১ সালের ২৮এ জুন। সে হিসেবে ফেরদৌসী রহমানের বয়স এখন প্রায় ৮১ ।
এ বয়সে তিনি মাঝেমধ্যে সংগীতবিষয়ক আলোচনাসভা, অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি কিংবা বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত সংগীত সম্মেলনের উদ্বোধক হিসেবেও তিনি উপস্থিত হন হঠাৎ হঠাৎ।
ফেরদৌসী রহমান ১৯৪৬ সাল থেকে বেতারে গান করা শুরু করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র সাড়ে পাঁচ বছর। একটু বড়ো হয়েই রেকর্ডে ‘আমার প্রাণের ব্যথা কে বুঝবে সই’ গানখানি গাইলেন। এই গান দিয়েই তিনি বাঙালি শ্রোতাদের মনে গেঁথে গেলেন।
সিনেমার গানে প্রথম কণ্ঠ দেন ১৯৫৮ সালে ‘আসিয়া’ ছবিতে। তবে ‘আসিয়া’ ছবিটি একটু বিলম্বে মুক্তি পাওয়ার কারণে প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে তাঁর প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ছিল – ‘এদেশ তোমার আমার’। এ ছবিতে ফেরদৌসী রহমান গেয়েছিলেন ‘চুপিসারে এত করে কামিনী ডাকে’ গানখানি।
ফেরদৌসী রহমান ১৯৫৯ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ফিল্মে যে-সব গান করেছেন তাঁর সবগুলো আজও সমান জনপ্রিয় হয়ে আছে। তাঁর সময়ের গানগুলোর আবেদন কোনোদিন ফুরিয়ে যাবার নয়। এ প্রজন্মের শিল্পীরাও তাঁর গাওয়া সেদিনের গান আজও নতুন করে গাইছেন।
ফেরদৌসী রহমানের শিল্পীজীবনের একটি বিরাট সৌভাগ্য, তিনি এদেশের অনেক সুরকারের সুরে গান গাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। আবদুল আহাদের সুর করা আধুনিক গান সবচেয়ে বেশি তিনিই গেয়েছেন।
এ ছাড়া খন্দকার নুরুল আলম, আজাদ রহমান, জালাল আহমেদ, আবদুল লতিফ, ওসমান খান, কানাইলাল শীল, আনোয়ার উদ্দিন খান, সমর দাস, সুবল দাস, অজিত রায় প্রমুখ খ্যাতনামা সুরকারের সুরেও গান গেয়েছেন। প্রথম সুরকার হিসেবে তার আত্মপ্রকাশ ১৯৬১ সালে ‘রাজধানীর বুকে’ ছবির মাধ্যমে। ওই ছবিতে ফেরদৌসী রহমানের সঙ্গে রবীন ঘোষও সুরকার হিসেবে ছিলেন।
স্বাধীনতার পর ফেরদৌসী রহমান ‘মেঘের অনেক রং’, ‘গাড়িয়াল ভাই’, এবং ‘নোলক’ ছবির সংগীত পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছেন।
আজকাল ফেরদৌসী রহমান তাঁর বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত আব্বাসউদ্দিন সংগীত একাডেমিকে আরও সম্প্রসারণ করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর বাবা আব্বাসউদ্দিন আহমেদের গাওয়া গানগুলো তাঁর মনে আগের মতোই নাড়া দেয়। শুধু তার অন্তরে নয়, এ প্রজন্মের সংগীতশিল্পীরাও আবার গাইছেন আব্বাসউদ্দিনের গান।
বিয়ের পরেই (১৯৬৬ সালে) ফেরদৌসী বেগম থেকে তিনি হলেন ফেরদৌসী রহমান। তাঁর দুই ছেলে রুবাইয়াত আর রাজন আজ প্রতিষ্ঠিত। ওরা যে যার সংসার ও কর্মজীবন নিয়ে ব্যস্ত। এ বয়সে সময় পেলে বিদেশে ছেলেদের কাছে তিনি বেড়াতে যান। নবীন শিল্পীদের লোকসংগীত গাইবার ব্যাপারে উৎসাহ দেওয়া ছাড়াও শিশু-কিশোরদের বহু বছর ধরে তিনি গান শিখিয়ে আসছেন। এভাবেই একের পর এক কাজ নিয়ে ফেরদৌসী রহমান এখনো ব্যস্ত।
আরও পড়ুন: হারানো দিনের কিংবদন্তী নায়ক চির সবুজ অশোক কুমার
বিদেশে গান গাইবার স্মৃতি এখনো তাঁর মনে নাড়া দেয়। এ প্রসঙ্গে ফেরদৌসী রহমান একবার জানিয়েছিলেন, “১৯৬৩ সালের কথা এখনো আমার বার বার মনে পড়ে। সেবার আমি ও লায়লা আরজুমান্দ বানু দু’জনে একত্রে মস্কোয় গিয়ে গান করেছিলাম।
এককভাবে এক অনুষ্ঠানে আমি গাইলাম ‘ও মোর চান্দোরে ও মোর সোনারে’ গানটি। এ গান শেষ হতেই প্রচুর হাততালি শুরু হলো। আমি তো গান গেয়ে চলে এসেছি কিন্তু হাততালি থামছে না চলছেই। পরে লোকজন আমাকে টেনেটুনে আবার স্টেজে পাঠাল। তখন বুঝলাম এই হাততালি মানে আরও গান গাইতে হবে এবং তাই করলাম।
চীনে গান গাইতে গেলাম ১৯৬৬ সালে। চৌ এন লাই তখন চীনের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর সামনে গাইলাম ‘চুং ফাঙ হোং’ গানটা। এটি ছিল চীনা ভাষার গান। এ গান শুনে প্রধানমন্ত্রী আমার প্রশংসা করে বললেন, তুমি তো চীনা ভাষা জানো না। এত দরদ দিয়ে গাইলে কীভাবে? তিনি বার বার আমার প্রশংসা করে যাচ্ছিলেন। এটা আমার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা। সেই কবেকার ঘটনা, যা আজও ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়ে।”
আরও পড়ুন:বিশ্বের সেরা সিনেমা দেখুন বিনামূল্যে ১৬ মাস আনলিমিটেড!
ফেরদৌস শব্দের অর্থ স্বর্গীয়। ফেরদৌসী শব্দের অর্থ ‘শ্রবণের স্বর্গ’। বাস্তবে অর্থাৎ শিল্পীজীবনেও তাই প্রমাণ করে যাচ্ছেন। তিনি এদেশের সিনেমার গান প্রথম জনপ্রিয় করে গেছেন। সিনেমার স্বর্ণযুগের শিল্পী তিনিই। তাঁর প্রতিটি গানই ফেরদৌসী রহমানকে স্মরণে আনবে দীর্ঘকাল।