চট্রগ্রাম টেষ্টে অভিজ্ঞতা ও দলীয় শক্তির বিচারে বাংলাদেশ পরিষ্কার ফেভারিট ছিল। তবুও পঞ্চম দিনে এসে হেরে গেল বাংলাদেশ। শেষদিনে ভাল খেলেই জিতেছে ওয়েষ্ট ইন্ডিজ। তবে বাংলাদেশের পরাজয়ের কারন হিসাবে কিছু ক্রিকেটীয় এবং এর বাইরের বিষয় পর্যালোচনা করা যায়। নীচে ওয়েষ্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে টেষ্ট ক্রিকেটে চট্রগ্রামে বাংলাদেশের পরাজয়ের পাঁচটি কারন চিহ্নিত করা হল।
(১) দল নির্বাচনে অদূরদর্শিতা
টেষ্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ এখনও অনেক পিছিয়ে। এর অন্যতম কারন লম্বা সময়ের জন্য ক্রিজে কাটিয়ে দিতে পারেন এমন ব্যাটসম্যানের অভাব। কিংবা দুই ইনিংসে প্রতিপক্ষের ২০টি উইকেট তুলে নিতে পারেন এমন কার্যকর বোলিং আক্রমন নেই। সেজন্য টেষ্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের দলে নির্বাচন করাটাই যুক্তিসঙ্গত হত। কিন্তু বাংলাদেশের সেরা একাদশে অভিজ্ঞ এবং ইনফর্ম ব্যাটসম্যান মাহমুদুল্লাহ রিয়াদকে নেয়া হয়নি। অন্যদিকে পাঁচদিনের খেলায় লম্বা সময়ে বোলিং করার জন্য পেস বোলার নেয়া হয়েছে মাত্র একজন। তাও ইনজুরি আক্রান্ত মোস্তাফিজ। যিনি ইনজুরিতে পড়ে আজ খেলতে পারেন তো পরের ম্যাচে অনিশ্চয়তায় পড়েন। এই ম্যাচে বাংলাদেশের দরকার ছিল কমপক্ষে দুইজন সম্পূর্ণ ফিট পেস বোলার। দলীয় স্কোয়াডে থাকা তাসকিন ও রাহী হতে পারতেন সেরা পছন্দ।
(২) লম্বা সময়ের জন্য ব্যাটিং করতে না পারা
ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতার খেসারত গুণতে হয়েছে বাংলাদেশ দলকে। প্রথম ইনিংসে আড়াইশ রানের আগেই পড়ে যায় ৬ উইকেট। ৮ নাম্বারে ব্যাট করতে নেমে মেহেদী হাসান মিরাজ সেঞ্চুরী না করতে পারলে বাংলাদেশের বিপদ আরো বেশী হত। টপ অর্ডারে সেট হয়েও ইনিংস বড় করতে পারেন নি প্রথম পাঁচজন ব্যাটসম্যান। তাদের ব্যর্থতা অনেকটা পুষিয়ে দিয়েছেন অলরাউন্ডার সাকিব ও মিরাজ।
কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশের ব্যাটিং ব্যর্থতা অমার্জনীয়। অধিনায়ক মুমিনুল হক এ উইকেটরক্ষক লিটনকে কে বাদ দিলে বাকিরা চরমভাবে ব্যর্থ। টেষ্টে ক্রিকেটে বাংলাদেশের সবচেয়ে ধারাবাহিক ব্যাটস্ম্যান মুশফিকুর রহিম আউট হয়েছেন মাত্র ১৮ রানে। বাকি যারা ব্যাট করেছেন তারা দুই অংকেও পৌঁছাতে পারেননি।
আরো পড়ুন: আইসিসির টেষ্ট রেটিংয়ে বাংলাদেশ যেভাবে নবম স্থানে
(৩) চট্রগ্রাম টেষ্টে বাংলাদেশের পরাজয়ের কারন প্রতিপক্ষকে হালকাভাবে নেয়া
ওয়েষ্টইন্ডিজের এই দলটি এসেছে তাদের শীর্ষ খেলোয়াড়দের ছাড়াই। বর্তমান সময়ে প্রতিষ্ঠিত টেষ্ট খেলোয়াড়দের প্রায় কেউই আসেননি এই দলে। শক্তিমত্তার বিচারে এই দলটিকে তাদের তৃতীয় সেরা বলা যায় কীনা সেই প্রশ্নও তোলা যায়। এই দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করেছে গোটা বাংলাদেশ শিবিরে। বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের শারীরিক ভাষা ও আচরনে প্রকাশ পেয়েছে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস। তারা মনে করেছিলেন হয়তো মাত্র আড়াইদিনে হারিয়ে দিবেন ওয়েষ্টইন্ডিজকে। এই দৃষ্টভঙ্গির খেসারত দিয়েছেন সবাই নিজেদের মাঠে খর্বশক্তির একটি দলের বিরুদ্ধে হেরে।
(৪) সাকিবের ইনজুরিতে পড়া
খেলার মত ফিটনেস সাকিবের ছিল কীনা তা বলতে পারা কঠিন। প্রথম ইনিংসে ভাল ব্যাটিং করলেও বেশি সময় বোলিং করতে পারেননি বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। মাত্র ৬ ওভার বল করেছেন। ম্যাচে তিনি ভূমিকা রাখতে পেরেছেন এই পর্যন্তই। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিং কিংবা বোলিং কিছুই করতে পারেন নি সাকিব। বাংলাদেশ দলের দ্বিতীয় ইনিংসে অন্তত ব্যাটিংয়ে নেমেও যদি কিছু রান করতে পারতেন সাকিব তাহলে হয়তো হার এড়ানো যেত।
(৫) ম্যাচের টার্নিং পয়েন্টে রিভিউ না নেয়া
আম্পায়ারের সিদ্বান্তের বিরুদ্ধে রিভিউ নেয়াটা ক্রিকেটে বেশ কার্যকর পন্থা। ব্যাটসম্যানের একটি দুর্ভাগ্যজনক আউট কিংবা প্রয়োজনীয় সময়ে বোলারের একটি উইকেট ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। বড় দলগুলো রিভিউ নিতে কখনোই কার্পণ্য করেনা। কিন্তু বাংলাদেশ দলের বেলায় এটি সেভিং একাউন্টে টাকা জমিয়ে রাখার মত বিষয়ই বলা যায়। রিপ্লেতে দেখা গেছে শাদমান ইসলামের আউট রিভিউ নিলে ঠেকানো যেত। একইভাবে বোলার নাইম বঞ্চিত হয়েছেন আম্পায়েরে ভুলে এলবিডব্লু থেকে একটি উইকেট নিতে। দুটি ক্ষেত্রেই রিভিউ না নেয়াতে ক্ষতি হয়েছে বাংলাদেশের।
চট্রগ্রাম টেষ্টে বাংলাদেশের পরাজয়ে ক্রিকেটের বাইরের কারন
খেলাধুলায় বাজিকরদের দৌরাত্ম্য অনেকটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে। পশ্চিমা বিশ্বের একটি অন্যতম প্রধান শিল্প হচ্ছে জুয়া। বড় বড় ধনকুবেররা জড়িত এই শিল্পের সাথে। ইদানিং বাংলাদেশের অনেক বড় ধনকুবেরও জড়িত হয়েছেন এই শিল্পের সাথে। কিছুদিন আগে বাংলাদেশের ক্লাবপাড়ায় ক্যাসিনো কান্ডে জুয়ার বড় আসরগুলোতে যারা নেপথ্যে ছিলেন তাদের অনেকেরই যোগসাজশ রয়েছে বিসিবি প্রধান পাপনের সাথে। এরসাথে আইসিসির তদন্তে ইতিমধ্যে ক্রিকেট জুয়ার সাথে সংশ্লিষ্টতা প্রমানিত হয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেটের অন্যতম প্রধান হর্তাকর্তা খালেদ মাহমুদ সুজনের নাম। তার সাথে ছিল বাংলাদেশের সাবেক ম্যানেজার খালেদ মাসুদ পাইলটের নাম। এরা পূর্বে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা প্রতিভাবান ক্রিকেটার আশরাফুলের ক্যারিয়ার শেষ করে দিয়েছেন।
চট্রগ্রাম টেষ্টের চতুর্থদিনের খেলা শুরুর আগে বাংলাদেশের পক্ষে বাজির দর ছিল ১.০৯। যেখানে ওয়েষ্টইন্ডিজের পক্ষে ছিল ২৫। অর্থাৎ বাংলাদেশের জয়ের পক্ষে দশটাকা বাজি ধরলে যদি বাংলাদেশ জিতে তাহলে পাওয়া যাবে ১০.৯০ টাকা। আর ওয়েষ্টইন্ডিজের জেতার পক্ষে ১০ টাকা বাজিতে মিলবে ২৫০ টাকা। এবার হিসাবটা মিলিয়ে নিন। বোর্ডের যারা প্রধান হর্তাকর্তা, তারা যদি বাংলাদেশের হারের ব্যাপারে সামান্য ইঙ্গিত দিয়ে থাকেন তাহলে এখান থেকেই হাতিয়ে নিয়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকা!