অশোক কুমার নামটি আমাদের শৈশবে প্রিয় নায়কদের মধ্যে বিশেষভাবে উলেখযোগ্য। উপমহাদেশ জুড়ে তাঁকে সবাই বলতেন, ‘চির সবুজ অশোক কুমার।’ উপমহাদেশের কিংবদন্তী নায়ক বলা হয় – অশোক কুমারকে। লিখেছেন লিয়াকত হোসেন খোকন।
১৯৩৫ সালে ‘জীবন নাইয়া’ ছবিতে প্রথম নায়ক হিসেবে অভিনয় শুরু তাঁর। নায়িকা ছিলেন দেবিকা রানী। তিনশ’রও বেশি ছবিতে অভিনয় করে ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে দিকপাল অভিনেতা হয়ে রইলেন অশোক কুমার। তিনি নেই, তবুও তার পরবর্তী [web_stories title=”false” excerpt=”false” author=”false” date=”false” archive_link=”true” archive_link_label=”” circle_size=”150″ sharp_corners=”false” image_alignment=”left” number_of_columns=”1″ number_of_stories=”5″ order=”DESC” orderby=”post_title” view=”circles” /]প্রজন্মের নায়ক-নায়িকারা তাকে ‘দাদামণি’ বলে থাকেন । এই মহাতারকার ওপর দু’চারটি কথা লিখে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি ।
হারানো দিনের কিংবদন্তী নায়ক চির সবুজ অশোক কুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯১১ সালের ১৩ অক্টোবর মধ্যপ্রদেশের ভাগলপুরে। মৃত্যু ২০০১ সালের ১০ ডিসেম্বর মুম্বাইতে।
‘চন্দ্রশেখর’ ছবিতে চির সবুজ অশোক কুমার অভিনয় করেন প্রতাপের ভূমিকায়। প্রতাপের বাল্যের সখা, কৈশোরের বন্ধু, যৌবনের বন্ধু শৈবালিনী। আর শৈবালিনীর যৌবনের রাজকুমার হলেন প্রতাপরূপী অশোক কুমার গঙ্গোপাধ্যায়। অশোক কুমারকে না পেয়ে কানন দেবী ব্যথিত হয়েছিলেন- আহা অমন দৃশ্যের কথা আজো দর্শক ভোলেনি যারা চন্দ্রশেখর দেখেছিলেন । ‘চন্দ্রশেখর’ ছবিতে চোখে চোখে রেখে কানন ও অশোক গেয়েছিলেন – ‘অন্যদিকালের স্রোতে ভাসা মোরা দুটি প্রাণ।’ এই গান এ প্রজন্মের শিল্পীরা টেলিভিশনের পর্দায় যখন গেয়ে থাকেন তখন মনে পড়ে কানন দেবীর নায়ক অশোক কুমারকে।
১৯৩৩ সালে অশোক কুমারের ছোট বোন সতী রানীর বিয়ে হয় চিত্র পরিচালক শশধর মুখার্জির সঙ্গে। রবার্টসন কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করার পর ১৯৩৪ সালে ভগ্নিপতি শশধর মুখার্জির আহবানে বোম্বাই গিয়ে বম্বে টকিজের রসায়নগারে চাকরি নিলেন। একদিন চিত্রনায়িকা দেবিকা রাণী ও তার স্বামী হিমাংশু রায় স্টুডিও পরিদর্শন করার সময় রসায়নগারে গানের আওয়াজ শুনে এগিয়ে যান এবং দেখতে পান অশোক কুমার মনের সুখে গান গেয়ে চলেছেন। তাদের দেখে একটু লজ্জিত হলেন : কিন্তু হিমাংশু রায় বললেন, তোমাকেই গান গাইতে হবে। এভাবেই অশোক কুমারের শুরু । ১৯৩৬ সালে ‘অচ্ছুৎকন্যা’ মুক্তি পাওয়ার পরে ‘অশোক কুমার- দেবিকা রানী জুটি সারা ভারতে জনপ্রিয় হয়ে উঠল। সারা ভারত গাইতে লাগল – ‘ম্যায় বনকা পংছি বনমে…’। একে একে দেবিকা রানীর বিপরীতে রোমান্টিক নায়ক হিসেবে অভিনয় করলেন ‘জন্মভূমি’, ‘ইজ্জত’, ‘সাবিত্রী’, ‘বচন’, ‘নির্মলা’, ‘আনজান’, ‘মমতা’ প্রভৃতি ছবিতে। সে সময় বম্বে টকিজ থেকে অশোক কুমার মাসে ২৫০ রূপি করে পেতেন।
১৯৩৮ সালের ১৪ এপ্রিল অশোক কুমার বিয়ে করলেন শোভা রানীকে। এ বিয়ে তার বাবা-মায়ের পছন্দে হয়েছিল। বিবাহিত জীবন তার অভিনয় জীবনে বাধা হয়ে আসেনি বরং এলো যেন অনুকুল আবহাওয়া নিয়ে। ‘নয়া সংসার’, ‘কংগন’, ‘বন্ধন’, ‘ঝুলা’, ‘আজাদ’-এর পরপরই অশোক কুমার ‘কিসমত ‘ – এ অভিনয় করে ভারতজুড়ে খ্যাতি পেলেন।
১৯৪৩ সালে ‘কিসমত’ রিলিজ হয়। ‘কিসমত’ ছবিতেই অশোক কুমার গেয়েছিলেন – ‘মেরে বুলবুল শো রাহা হ্যায়’। ১৯৩৫ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত — অশোক কুমার ছবিতে আছেন মানেই তিনি গান গাইবেনই – এটা দর্শক ধরেই নিতেন। কামিনী কৌশল, লীলা চিৎনিশ, রেণুকা রায়, নিরূপা রায়, নার্গিস, মীনাকুমারী, নতুন, মধুবালা, সুরাইয়া, বীণা, সুচিত্রা সেন, কানন দেবীর মতো সুন্দরী বিদুষী নায়িকাদের বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন তিনি। নাসিম বানুর বিপরীতে ‘চল চলরে নওজোয়ান’, মধুবালার বিপরীতে ‘মহল’, ‘হাওড়া ব্রিজ’, সুমিত্রা দেবীর বিপরীতে ‘সমর’, নার্গিসের বিপরীতে ‘হুমায়ুন’, ‘আঁধিরাত, ‘রেওয়াফা’, ‘দিদার’, সুচিত্রা সেনের বিপরীতে ‘হসপিটাল’, মীনা কুমারীর বিপরীতে ‘ভাই ভাই’, ‘বেনজির’, ‘পরিণীতা’ প্রভৃতি ছবিতে অশোক কুমারের অভিনয় এখনো মনে দাগ কাটে।
১৯৩৫ সাল থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত— অর্থাৎ দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে চির সবুজ অশোক কুমার ছিলেন নায়করূপে। ১৯৬৬ সালে ‘বার্মা রোড’ ছবিতে প্রথম চরিত্রাভিনেতার রোল করা শুরু করেন । নিজের প্রযোজিত ছবি ‘মমতা’য় ওই একই বছর চরিত্রাভিনেতার চরিত্রে অভিনয় করলেন। ১৯৪৯ সালে চলচ্চিত্র প্রযোজক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। বিনা পারিশ্রমিকেও তিনি কয়েকটি ছবির কাজ করে দেন। ফিল্মস্তানের ব্যানারে অশোক কুমার ইংরেজি ছবি ‘বোম্বে ফ্লাইট ৪১৭’তে অভিনয় করেন। বাংলায় ‘চন্দ্রশেখর’ ছবিটি করার ৬ বছর পরে ১৯৫৩ সালে ‘সমর’ ছবিতে অভিনয় করেন । এরও ৭ বছর পরে ১৯৬০ সালে ‘হসপিটাল’ ছবিতে সুচিত্রা সেনের নায়ক হিসেবে কাজ করেন।
অশোক কুমার মারা যাওয়ার ৫ বছর আগে তার স্ত্রী শোভা রাণী মারা যান। ছেলেমেয়েদেরকেও ফিল্মে এনেছিলেন, কিন্তু এরা কেউই চলচ্চিত্রে তেমন প্রতিষ্ঠিত হতে পারেননি । মেয়ের ঘরের নাতনি অনুরাধা দু’চারটি ছবিতে অভিনয করার পরে হারিয়ে গেলেন; কিন্তু চির সবুজ অশোক কুমার হারিয়ে যাননি, ছিলেন যেন চির কুমার হয়ে।
চির সবুজ অশোক কুমার অভিনীত স্মরণীয় ছবি – ১. জীবন নাইয়া (১৯৩৬, নায়িকা – দেবিকা রানী) ২. জন্ম ভূমি (১৯৩৬, নায়িকা – দেবিকা রানী) ৩. অচ্ছুৎকন্যা (১৯৩৬, নায়িকা- দেবিকা রানী) ৪. সাবিত্রী (১৯৩৭, নায়িকা – দেবিকা রানী) ৫. ইজ্জত (১৯৩৭, নায়িকা – দেবিকা রানী), ৬. প্রেম কাহানী (১৯৩৮, নায়িকা-দেবিকা রানী) ৭. নির্মলা (১৯৩৮, নায়িকা-দেবিকা রানী) ৯. কংগন (১৯৩৯ নায়িকা লীলা চিৎনিশ) ১০ বন্ধন (১৯৪০, নায়িকা – লীলা চিৎনিশ) ১১. বন্ধন (১৯৪০, নায়িকা- লীলা চিৎনিশ) ১২. আজাদ (১৯৪০, নায়িকা – লীলা চিৎনিশ) ১৩. আনজান (১৯৪১, নায়িকা-দেবিকা রানী) ১৪. নয়া সংসার (১৯৪১) ১৫. ঝুলা (১৯৪১, নায়িকা লীলা চিৎনিশ) ১৬. নাজমা (১৯৪৩ নায়িকা – বীণা ) ১৭. কিসমত (১৯৪৩, নায়িকা – মমতাজ শান্তি) ১৮ আংগুতি (১৯৪৩), ১৯. কিরণ (১৯৪৪) ২০. চলচলরে নওজোয়ান (১৯৪৪ নায়িকা- নাসিমবানু) ২১. হুমায়ুন (১৯৪৫, নায়িকা – নার্গিস ও বীনা) ২২. বেগম (১৯৪৫) ২৩. শিকার (১৯৪৬) ২৪. এইটি ডেস (১৯৪৬) ২৪. চন্দ্র শেখর (১৯৪৭, নায়িকা – কানন দেবী) ২৫. সাজন (১৯৪৭) ২৬. বাঘিনী (১৯৪৮) ২৭. মহল (১৯৪৯, নায়িকা – মধুবালা) ২৮. সংগ্রাম (১৯৫০ নায়িকা-নলিনী জয়ন্ত) ২৯. সমাধি (১৯৫০, নায়িকা -নলিনী জয়ন্ত —) ৩০. মশাল (১৯৫০) ৩১. আঁধি রাত (১৯৫০) ৩২. দিদার ১৯৫১ নায়িকা-নার্গিস) ৩৩. আফসানা (১৯৫১) ৩৪. নওবাহার (১৯৫২, নায়িকা – নলিনী জয়ন্ত—) ৩৫. পুনম (১৯৫২) ৩৬. কাফিলা (১৯৫২) ৩৭. জলপরী (১৯৫২, নায়িকা-নলিনী জয়ন্ত ) ৩৮. পরিনীতা (১৯৫৩, নায়িকা-মীনা কুমারী ) ৩৯. নাজ (১৯৫৪) ৪০. সর্দার (১৯৫৫), ৩১ বন্দিশ (১৯৫৫) ৪২. ভাই ভাই (১৯৫৬) ৪৩. রাগিনী (১৯৫৮) ৪৪. নাইট ক্লাব (১৯৫৮) ৪৫. হাওড়া ব্রিজ (১৯৫৮ ) ৪৬. চলতি নাম গাড়ি (১৯৫৮) ৪৭. নাচঘর (১৯৫৯) ৪৮. ধূল কা ফুল (১৯৫৯) ৪৯. কল্পনা (১৯৬০) ৫০. হসপিটাল (১৯৬০, নায়িকা- সুচিত্রা সেন) – প্রভৃতি।
অশোক কুমার অভিনীত ছবির সংখ্যা মোট ৩১১টি। শেষ অভিনীত ছবি আনোছে তুম হো (১৯৯৭)। চির সবুজ অশোক কুমারের স্ত্রীর নাম শোভা দেবী (মৃত্যু – ১৯৯৭ সালে)। তাদের ছেলে মেয়েদের নাম ১. প্রীতি গাংগুলী (মৃত্যু ২০১২ সালে ৫৯ বছর বয়সে)। ২. রূপা গাঙ্গুলী ৩. অরুণ গাঙ্গুলী।
চির সবুজ অশোক কুমার ভাইদের মধ্যে বড়। অন্য ২ ভাইয়ের নাম অনুপ কুমার ও কিশোর কুমার। একমাত্র বোনের নাম সীতা দেবী। এরা কেউ-ই বেঁচে নেই।