একদা সিনেমাহলগুলোয় লাইন দিয়ে টিকিট কেটে সিনেমা দেখতেন এক লম্বা রোগাটে চেহারার তরুণ। তাঁর বাবা ছিলেন নামী কবি। কিশোরীমল লেজ থেকে আর্টস নিয়ে পাশ করা এই ছেলেটির দু’ চোখে স্বপ্ন হয়ে দেখা দিল, তাঁকে ছবির নায়ক হতেই হবে যে করেই হোক ……. ।
ছেলেটি যুবক বয়সে সাদা – কালো ছবি ” সাত হিন্দুস্তানি ” দিয়েই প্রথম পা রাখলেন রূপালী পর্দার জগতে। কিন্তু কোথাও দাগ কাটতে পারলেন না। একেবারে হারিয়েই গেলেন। এরই বছর দুই পরে হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের ‘আনন্দ’ ছবিতে অভিনয় করার পর চিত্র নির্মাতাদের নজরে পড়লেন এই অমিতাভ বচ্চন।
এরপরই চারিদিক থেকে আসতে লাগলো ছবির অফার। ১৯৭২ সালে জয়া ভাদুড়ীর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ এল ‘বংশী বিরজু’ ছবিতে। ছবি হিট হলো। আর অতঃপর নায়ক হিসেবে অমিতাভ বচ্চনের নাম ঢুকে পড়লো প্রযোজকদের নোট বুকে।
১৯৭০ এর দশক – ১৯৮০ এর দশকে অমিতাভ বচ্চন ছাড়া বোম্বের হিন্দি ছবি যেন ছিল বড়ই অচল। বলা যায়, একচ্ছত্র রাজত্ব করেছিলেন তিনিই। আজও অমিতাভ বচ্চনকে বলা হয় – মুম্বাইয়ের চিত্র জগতের ‘বড়ে মিঞা।’
অমিতাভ বচ্চন অভিনীত – জঞ্জীর, দিওয়ার, শোলে, ত্রিশূল, কালাপাথ্বর, শক্তি, চুপকে চুপকে, অমর আকবর অ্যান্টনি, নসিব, কভি কভি, সিলসিলা, কুলি, লাল বাদশা, বড়ে মিঞা ছোটে মিঞা – ইত্যাদি ছবি যেনো এক মহা ইতিহাস।
অমিতাভ বচ্চন অভিনীত শোলে ছবিটি দেখুন এখানে
১৯৭৩ সালে ওমপ্রকাশ মেহরার ‘জঞ্জীর’ এ বিজয় খন্নার চরিত্রে জ্বলে উঠলেন, ছবি দেখে দর্শকেরা বেশ অভিভূত। রাস্তাঘাটে অমিতাভ বচ্চনকে দেখা মাত্র ওঁকে সবাই বলত, ইন্সপেক্টর বিজয়।
১৯৭০ এর দশকের মধ্য সময় থেকেই তাঁর অ্যাংরি ইয়ংম্যান ভাবমূর্তির শুরুটা ওই সময়ের ছবির মধ্যে দিয়েই। এরই পাশাপাশি কমেডি চরিত্রেও তুখোড় অভিনয় করে যাচ্ছিলেন অমিতাভ বচ্চন। তবে রোমান্টিক চরিত্রেও কিন্তু তিনি পিছিয়ে ছিলেন না। কভি কভি আর সিলসিলা ছবির রোমান্টিক নায়ক হিসেবে তাঁর অসাধারণ অভিনয় আজও অনেকের হৃদয়ে গেঁথে রইল।
অ্যাকশন, কমেডি, রোমান্টিক সহ সব ধরনের চরিত্রে অভিনয় করে সর্বশ্রেণীর দর্শকের হৃৎস্পন্দন তারকা হয়েছিলেন তিনি।
অভিনয় করতে গিয়ে গিয়ে তিনি মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছেন, এমন ঘটনাও আছে এই বড়ে মিঞারূপী অমিতাভ বচ্চনের জীবনে। যেমন – ১৯৮২ সালে ‘কুলি’ ছবির শুটিংয়ে পুনিত ইশারের সঙ্গে শুটিং করতে গিয়ে ক্ষুদ্রান্ত্রে সেই ঐতিহাসিক চোট। তা যেন অমিতাভ বচ্চনকে সেদিন মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছিল।
রাজনীতিতেও পিছিয়ে ছিলেন না অমিতাভ বচ্চন।
১৯৮৪ সালে যোগ দিলেন কংগ্রেসে। কংগ্রেস প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে দাঁড়ালেন। বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ হেমবতীনন্দন বহুগুণাকে বিপুল ভোটে হারিয়ে দিয়ে ছিলেন তিনি। অবশ্য রাজনীতির অলিন্দে অমিতাভ বচ্চন বেশি দিন ছিলেন না। রাজনীতিতে ছিলেন মাত্র তিনটি বছরের মতো।
আরও পড়ুন: সঞ্জীবনী সুধায় কঙ্কাবতীর ঘাট থেকে উত্তম কুমারের যাত্রা হল শুরু
এক সময় বুঝেছিলেন, অভিনয় থেকেও সরে যাওয়া দরকার। তাই খুদা গাওয়া ছবিতে অভিনয় করার পরেই চিত্রজগত থেকে সরে যাওয়ার সাময়িক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তবে বেশি দিন সরে থাকতে পারেননি। আবার ফিরে এসেছিলেন। ফিরে এসে অমিতাভ বচ্চন আবারও অভিনয় করলেন – লাল বাদশা, বড়ে মিঞা ছোটে মিঞা’র মতো কয়েকটি ছবিতে।
এক যুগ আগেও চিত্রজগতে অমিতাভ বচ্চন পাল্লা দিয়েছিলেন তাঁর নিজের ছেলের সঙ্গে। তখন দারুণ উৎসাহে ঠাট্টা করে অমিতাভ বচ্চন নিজেই নিজেকে বলতেন, ‘আরে বাবা, আমি হেয়ার উইভ করিনি। শুধু চুলগুলো রং করেছি। ফাঁকা হয়ে আসা জায়গাগুলো ঢেকে নিয়ে ফ্লোরে নেমে পড়েছি’। আর দাড়ির কথা বলতেন, ‘ওটা তো আমি স্টেপলার দিয়ে আটকে রাখি অর্থাৎ চওড়া করে হাসলে যাতে সরেটরে না যায়’।
অমিতাভ বচ্চনের জন্ম তারিখ ১৯৪২ সালের ১১ অক্টোবর – সে হিসেবে বর্তমান বয়স তাঁর আশি। গৃহ সংসারে তিনি এ সময় বেশি সময় দিচ্ছেন। অমিতাভ বচ্চন অভিনীত কিছু স্মরণীয় ছবি হল –
১৯৭০ এর দশকের উল্লেখযোগ্য ছবি -১. রেশমা আওর শেহরা, ২. পেয়ার কি কাহানি, ৩.বোম্বে টু গোয়া, ৪. এক নজর, ৫. সংযোগ, ৬. রাস্তে কে পাথ্থার, ৭. সওদাগর, ৮. আদালত, ৯. মঞ্জিল, ১০.ডন।
১৯৭০ এর দশকে তাঁর অভিনীত ছবির সংখ্যা ছিল মোট ৪৬ টি।
১৯৮০ এর দশকে অমিতাভ বচ্চন অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবি হল – ১. রাম বলরাম, ২. বরষাত কি এক রাত, ৩. নসীব, ৪. দেশ প্রেমী, ৫. আন্ধা কানুন, ৬. মহান, ৭. পুকার, ৮. ইনকিলাব, ৯. শরাবী, ১০. কালিয়া।
১৯৯০ এর দশকে অমিতাভ বচ্চন অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবি হল – ১. অগ্নিপথ, ২. হাম, ৩. খুদা গাওয়া, ৪. মেজর সাব, ৫. সূর্যবংশম। ২০০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত অমিতাভ বচ্চন অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবি হল – ১. মোহাব্বতে, ২. অক্ষ, ৩. ব্ল্যাক, ৪. পা, ৫. পিকু, ৬. কভি খুশি কভি গম, ৭. আঁখে, ৮. আরমান, ৯. ভগবান, ১০. ভূতনাথ – ইত্যাদি।
বেশ কয়েকটি ছবিতে অভিনয়ের পাশাপাশি কন্ঠশিল্পীও ছিলেন তিনি। সেই ছবিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো – মিস্টার নটবরলাল, লাওয়ারিশ, নসীব, সিলসিলা, মহান, পুকার, শরাবী, তুফান, জাদুগর ইত্যাদি।
ভারতীয় চলচ্চিত্র অভিনেতা শুধু তিনি নন, তিনি প্রযোজক, টেলিভিশন উপস্থাপক হিসেবেও সমধিক খ্যাত। তাঁর অভিনীত ছবির সংখ্যা সর্বমোট প্রায় দুই শত।
ভারতের হিন্দি ছবির জগতে দিলীপ কুমার নামটি যেমন স্মরণীয় হয়ে আছেন, তেমনই এরই পাশাপাশি অমিতাভ বচ্চন নামটি ধ্রুব তারার মতো জ্বলজ্বল করছে। জীবদ্দশায় অমিতাভ বচ্চন এক কিংবদন্তি মহাতারকা হয়ে আছেন।