রানী মুখার্জী মানেই ছিল বাঙালির বুক ফুলিয়ে ঘোরা


১৯৯০ এর দশকে আর ২০০০ এর দশকে হিন্দি সিনেমার মহারানী ছিলেন রানী মুখার্জী।

পরনে লালপাড় গরদের শাড়ি, গলায় জবাফুলের মালা, সিঁদুরের টিপ, পুজো দিয়ে মন্দির থেকে আজও বের হন রানী মুখার্জী। শৈশব কাল থেকেই তিনি পূজা অর্চনা করে থাকেন।

একবার বাবা -মায়ের সঙ্গে কলকাতায় এলেন রানী, বয়স তখন কত আর মেরেকেটে পনেরো। দিদু আরতি রায়ের ছবি ‘দেবাঞ্জলি’র শুভ মহরতে। দেবশ্রী রায়কে রানী ‘চুমকি মাসি’ বলে ডাকতেন। কিছুতেই দেবশ্রী প্রথম শট দেবেন না। তখন দিদার কথায় রানীকেই দিতে হয় সেই ‘মহরত শট’। সেদিন ছবির শুটিং দেখতে এসে অদ্ভুত ভাবে ঢুকে পড়লেন চলচ্চিত্র জগতে। অজান্তে ফিল্ম দুনিয়ায় পা রাখা মুখার্জী বাড়ির ছোট্ট রানী, এরই কয়েক বছর পরে হয়ে উঠলেন বলিউডের ‘রাজরানী’।

এক দশকের আগেও সেই ২০০৮ সাল পর্যন্ত রানী মুখার্জী ছিলেন সাফল্যের চূড়ায়। সেই দিনগুলিতে সাফল্য তাঁর মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারেনি এক, না -না থুড়ি, আধ ডিগ্রিও। সেই দিনগুলিতে মুম্বাইয়ের ইয়ারি রোডের ধারে বিরাট হাউসিং কমপ্লেক্সে মা – বাবা, দাদা, বউদি আর একমাত্র আদরের ভাইঝি মিষ্টিকে নিয়ে রানীর সুখের মায়া নিকেতন ছিল। সেই দিনগুলিতে তিনি ভীষণই পরিবার কেন্দ্রিক ছিলেন।

তখন দিনের কাজ শেষ হলে, মুম্বাইয়ের স্টুডিও পাড়া থেকে বেরিয়ে নিজের গাড়িতে চেপে ঘরে ফিরতেন। বাড়ি ফিরে প্রথমেই কোলে তুলে নিতেন পরিবারের সবচেয়ে ছোট্ট সদস্য, আদরের মিষ্টিকে।

কিন্তু সেই সোনালী দিন আজ আর নেই, ততদিনে মিষ্টি যুবতী হয়ে গেছে, রানী মুখার্জীও বিয়েশাদি করে সংসার গৃহে বধূ হিসেবে আজ ব্যস্ত।

রানী মুখার্জি
রানী মুখার্জি: ছবি- গ্যেটি ইমেজ

কিছু কিছু সুন্দরী থাকেন, যাঁরা সৌন্দর্যের নিত্য নতুন সংজ্ঞা তৈরি করেন। তাঁকে দেখার পর বিশেষজ্ঞরা খাতা কলম নিয়ে বসেন। লিখে ফেলেন পাতার পর পাতা। কাকে বলে সুন্দরী, এই সুন্দরীর গোপন রহস্য কী? আর রাণী মুখোপাধ্যায় তাঁদের অন্যতম। কালো মেয়ের কালো হরিণ চোখ। সেই কালো চোখের ইশারায় এক লহমায় হয়ে যায় পাক – ভারত মসৃণ পথটা। রাণীর উচ্চতা আকাশছোঁয়া নয়। রাণীর ত্বক নিস্তরঙ্গ পুকুরের পিছল ঘাট নয়। রাণীর গ্ল্যামারে নেই চর্চিত বৈভব। তবু রাণীর উদাহরণ রাণীই। বাজি ধরে বলা যায়, রাণীর হাসিতে মিটে যাবে বিশ্বযুদ্ধ। অস্ত্র নামিয়ে রডোডেনড্রনগুচ্ছ তুলে দেবে শত্রুর কড়া হাতে, অপরপক্ষ। রাণীর চোখের তারার ঔজ্জ্বল্যে লজ্জা পাবে সন্ধ্যাতারা। পরে ফেলবে ঘোমটা। রাণীর মুখ গোল ? চাঁদ কেন আসে না আমার ঘরে ? বলে যারা গলা ফাটান, রাণী সগর্বে বলতে পারেন –একই আকাশে দু’টি চাঁদ ওঠে না। মর্ত্যের চাঁদ বা চন্দ্র তো আমিই।

আরও পড়ুন: সোয়াত উপত্যকার আলকোজাইন পশতুন থেকে যেভাবে সালমান খান

১৯৯৭ সালের কথা, মুম্বাইয়ের ফিল্মিস্তানে ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’ ছবির শুটিং চলছে। এক সাংবাদিক ফ্লোরে ঢোকার আগে বাঁ দিকে সার সার মেক -আপ রুম দেখতে দেখতে হঠাৎ রানি মুখার্জির দেখা পেয়ে গেলেন। আর দুটি মেক -আপ রুমে ছিলেন যথাক্রমে কাজল ও শাহরুখ খান। রানীর সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলার পর, কলকাতার ওই চিত্র সাংবাদিক তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন, শাহরুখের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়ার জন্য। একটা ইন্টারভিউ নিতে চেয়েছিলেন ওই সাংবাদিক ভদ্রলোকটি। শুনে আঁতকে উঠেছিলেন রানী। রানী ওই সাংবাদিককে বললেন, ‘পাগল না কি। আমি যাব ওই ঘরে, আপনার সঙ্গে ওঁর আলাপ করাতে? কোথায় শাহরুখ খান, কোথায় রানী মুখুজ্জে।’

২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। এক সাংবাদিক সন্মেলনে বেশ জোরের সঙ্গে শাহরুখ খান বললেন, ‘আসলে রানীর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা বন্ধুত্বের নয়। বলতে পারেন, ও আমার ছাত্রী, বাধ্য ছাত্রী। করণ জোহর বহু বছর আগে একবার আমাকে এসে বললো, ও একটা নতুন মেয়ে চায়। তো আমি ওকে রানীর কথা বলেছিলাম। ভারী ইন্টারেস্টিং মুখ। আর অভিনয়টাও আছে। রানীর সঙ্গে ওটাই আমার প্রথম ছবি। কুছ কুছ হোতা হ্যায় – এই ছবিটি মুক্তির পর তো রানী মুখার্জীকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।’

রানী মুখার্জী – শাহরুখ জুটির ‘চলতে চলতে’ সুপার ডুপার হিট হলো। তার আগে ‘সাথিয়াঁ’ রানীকে বসিয়ে দিয়েছিল দক্ষ অভিনেত্রীর সারিতে। রানী যখন নায়িকা ছিলেন তখন মুম্বাইয়ের অনেক নায়কই আশায় তাকিয়ে থাকত রানীর দিকে। কারণ, রানী মানেই ছিল ছবির মোটামুটি একটা সাফল্য। সেদিন রানী মানেই ছিল মিষ্টি মুখের জয়জয়কার। রানী মানেই ছিল বাঙালির বুক ফুলিয়ে ঘোরা।

raani

২০০০ এর দশকের বলিউডের অন্যতমা এই জনপ্রিয় নায়িকা সেই সময়ে ছবির জন্য সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পেতেন। কর্মজীবনে রানী সাতটি ফিল্মফেয়ার পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরষ্কার সহ একাধিক পুরস্কার লাভ করেছিলেন।

বিভিন্ন সময়ে রানী মুখার্জীকে নিয়ে কম রটনা রটেনি। বিভিন্ন সময়ে গোবিন্দ, আমির খান, অভিষেক বচ্চন ও আদিত্য চোপড়ার সাথে তার প্রেম সম্পর্কিত খবরাখবর বলিউডের পাড়ায় সরব ছিল।

অবশেষে আদিত্য চোপড়াকে বিয়ে করার পর থেকে সকল গুজবের অবসান ঘটে। অভিনেত্রী প্রীতি জিনতার সঙ্গে তার ঝগড়াও জয়েছিল – এরপর তো তাদের মধ্যে মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যায়।

রাণী মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৭৮ সালের ২১ শে মার্চ মহারাষ্ট্র রাজ্যের রাজধানী মুম্বাইয়ে। তাঁর পিতার নাম রাম মুখোপাধ্যায় – তিনি একসময় পরিচালক ছিলেন। রাণীর মা কৃষ্ণা মুখোপাধ্যায় এক সময় সিনেমার প্লেব্যাক সিঙ্গার ছিলেন।

বিখ্যাত প্রযোজক – পরিচালক যশ চোপড়ার বড় ছেলে আদিত্য চোপড়াকে বিয়ে করেন ২০১৪ সালে।

রাণীর স্বামী আদিত্য চোপড়াও চিত্রজগতের প্রযোজক ও পরিচালক।

রানী মুখার্জী বর্তমানে মুম্বাইয়ের জুহু এলাকায় নিজের বাড়িতে বনবাস করছেন।

রাণী মুখোপাধ্যায় অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবি হল –

১৯৯৬ সালে – বিয়ের ফুল, ১৯৯৭ সালে – রাজা কি আয়েগি বারাত, তা রা রাম পাম, ১৯৯৮ সালে – কুছ কুছ হোতা হ্যায়, গোলাম, মেহেন্দি, ১৯৯৯ সালে — হ্যালো ব্রাদার, বাদল, হে রাম, মন, ২০০০ সালে – হার দিল যো পেয়ার কারেগা, হে রাম, হদ কর দি আপনে, চোরি চোরি, বিচ্ছু, কহি প্যার না হো জায়ে,

২০০১ সালে – বাস ইতনা সা খোয়াব হ্যায়, নায়ক দ্য রিয়েল হিরো, কাভি খুশি কাভি গাম, পেয়ার দিওয়ানা হোতা হ্যায়, মুঝছে দোস্তি করোগে, চোরি চোরি চুপকে চুপকে, ২০০২ সালে — সাথিয়াঁ, চলো ইশক লড়ায়ে, চলতে চলতে, মুঝসে দোস্তি করোগে, প্যার দিওয়ানা হোতা হ্যায়, ২০০৩ সালে – চোরি চোরি, ক্যালকাটা মেইল, কাল হো না হো, এলওসি কার্গিল, ২০০৪ সালে – যুবা, হাম তুম,

বীর -জারা, ২০০৫ সালে -বান্টি অউর বাবলি,  পহেলি, ব্ল্যাক, মঙ্গল পান্ডে -দ্য রাইজিং,

২০০৬ সালে – কভি আলবিদা না কেহনা, বাবুল, তা রা রাম পাম, ২০০৭ সালে – লাগা চুনরি মে দাগ, ওম শান্তি ওম, সাওয়ারিয়া, ২০০৮ সালে – থোড়া প্যার থোড়া ম্যাজিক, ২০০৯ সালে – দিল বোলে হাড়িপ্পা,

২০১১ সালে – নো ওয়ান কিলড জেসিকা,

২০১২ সালে  – আইয়া, তলাশ, ২০১৩ সালে – বম্বে টকিজ, চেন্নাই এক্সপ্রেস, ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি, ২০১৪ সালে – মর্দানি, ২০১৫ সালে – বাজীরাও মাস্তানী, ২০১৮ সালে – হিচকি, জিরো,

২০১৯ সালে – মর্দানি ২ , ২০২১ সালে – বান্টি অউর বাবলি ২, ২০২২ সালে – মিসেস চ্যাটার্জি ভি।