প্রেম নহে মোর মৃদু ফুলহার, দিল সে দহন জ্বালা 

অনন্তাল ধরে সবার উপরে প্রেম সেরা – বোধহয় তাই। আর তা না হলে প্রেমে পড়লে অনেকেই দিশাহারা হবেনই বা কেন। প্রেম একজন যুবক, একজন যুবতীকে কাছে টেনে আনে। খাঁটি প্রেম কিছুই বাধা মানে না। সকল বাধাবিঘ্ন দূর করে প্রেমিক -প্রেমিকা একত্রে মিলিত হয়। প্রেমিক – প্রেমিকা কাছাকাছি আসা মানে একত্রে দূরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া, একত্রে পাঁচতারা হোটেলে কিম্বা রিসোর্টে অবস্থান করা ইত্যাদি আরও কত কি হতে পারে।

হতে পারাটাই স্বাভাবিক। এ সব এখন কিছুই না। এই আধুনিক যুগে অনেক রীতিনীতি পাল্টেছে। বিয়েকে অনেক যুবক -যুবতী তোয়াক্কা না করে লিভ টুগেদারে মজেছে। বিয়ে না করেও ইদানীং কোনো কোনো তারকা সন্তানের মা হয়ে যাচ্ছেন। যা কিনা সাম্প্রতিক সময়ের সবচাইতে আলোচিত ঘটনা।

কেউ কেউ মনে করেন, জন্ম -মৃত্যু -বিয়ের সংবাদ কখনও চাপা থাকে না। এটা একদিন না একদিন প্রকাশ পাবেই।

তবে ইদানীং ঢাকার সিনেমা জগতে ছবির মুক্তির খবরাখবর ; ছবি নির্মাণের কোনো সংবাদ কারো দৃষ্টিতে আর পড়ছে না।

আজ সর্বত্র নায়ক শাকিব খানের খবরের মহাপ্লাবন চলছে, তবে সে খবর তাঁর ব্যক্তিগত জীবনকে কেন্দ্র করেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁকে নিয়ে কতজনে কত কথার মালা যাচাই বাছাই না করে ইচ্ছেমতো ভিডিও সহকারে ছেড়ে দিচ্ছে।

আজ ঘরে ঘরে সবার মুখে আলোচনার বিষয়বস্তু হলো, শাকিব খান, অপু বিশ্বাস, বুবলি, রাত্রি, পূজা – এদেরকে নিয়ে।

যখন যার যা মুখে আসে তাই ভিডিও করে সোশ্যাল মিডিয়ায়, ইউটিউবে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। কেউ কেউ এমন সব কথাবার্তা বলছেন, যা দেখে ও শুনে লজ্জায় মাথা নত হয়ে আসছে। একজন মানুষকে নিয়ে যে যা ইচ্ছে তাই বলবে, এটা কি ঠিক? সবারই ব্যক্তিগত জীবন বলতে একটা কিছু আছে, যা তার নিজস্ব একান্ত ব্যাপার। সে প্রসঙ্গ টেনে এনে যারা এ সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিও পোস্ট করছেন – সম্ভবত তারাও মানসিকভাবে বিকারগস্ত। আর তা না হলে সাকিব খানের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তারা ভিডিও করবেনই বা কেন?

শাকিব খান: সিনেমা তৈরি না বাচ্চা উৎপাদন?

কেউ কারো নিজের দোষের দিকে না তাকিয়ে অপরের দোষ খুঁজে তা প্রচার করে রীতিমতো গর্হিত কাজ করে যাচ্ছে।

চিত্রজগতের কোনো কোনো তারকা বিয়ে না করেও একত্রে বসবাস করেছেন ; কেউবা সন্তান প্রসব করেও সন্তানটির পিতৃ পরিচয় দিতে পারেননি। এ তো নতুন কিছু নয়। বহু পুরনো আমলের কথা।  বিখ্যাত চিত্র পরিচালিকা, সঙ্গীতশিল্পী জদ্দনবাঈয়ের জীবনটা ছিল অন্য রকমের। তার গর্ভে জন্মলাভ করে দুই পুত্র সন্তান ও এক কন্যা সন্তান। কে কার সন্তান, তা নিয়ে একসময় বিতর্কের ঝড় সৃষ্টি হয়েছিল। জদ্দনবাঈ তাঁর যৌবনে বাঈজী বাড়িতেই নাচতেন, সেখানে আসতেন বড় বড় জমিদার ও ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গ। তাদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে রাত্রিযাপন করেছিলেন জদ্দনবাঈ। বিয়ে না করেও তিনি সন্তানের মা হয়েছিলেন।

জদ্দনবাঈয়ের গর্ভে জন্মলাভ করা সুন্দরী ফুটফুটে সেই মেয়েটি বড় হয়ে হিন্দি সিনেমা জগতের মস্তবড় নায়িকা হয়েছিলেন, মনে পড়বেই তাঁর কথা। তিনি হলেন ‘বরষাত’, ‘আন্দাজ’, ‘মাদার ইন্ডিয়া’, ‘শ্রী ৪২০’, ‘লাহোর’, ‘মেলা’, ‘আওয়ারা’ খ্যাত ছবির সেই নার্গিস। রাজ কাপুরের প্রেমে জড়িয়ে এই নার্গিস যখন প্রেমিকের সঙ্গে মাখামাখি করছিলেন তখন বেশ হৈচৈ হয়েছিল। জদ্দনবাঈয়ের কানে বিষয়টা যেতেই তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, ‘রাজ কাপুর বিবাহিত – তাঁর সঙ্গে তোমার বিয়ে হলে মুখ দেখাবো কি ভাবে?’ পাল্টা নার্গিস জবাব দিয়েছিলেন, ‘কোনো ভদ্রলোক তোমার মেয়েকে বিয়ে করার আগে যদি সত্যিকারের পিতৃ পরিচয় জানতে চান – তার উত্তর কি দিবে?’

বিখ্যাত অভিনেত্রী শোভনা সমর্থ তাঁর স্বামীর ঘর থেকে তিনকন্যা ও একপুত্রকে সঙ্গে নিয়ে এসে উঠেছিলেন নায়ক মতিলালের বাসায়। মতিলাল অবশ্য বিবাহিত হয়েও দাম্পত্য জীবনে চিকিৎসক স্ত্রীকে নিয়ে সুখী হতে পারেননি, যে জন্য তিনি স্ত্রীর কাছ থেকে আলাদা হয়ে যান।

সেই শোভনা সমর্থ বছরের পর বছর ধরে মতিলালের সঙ্গে একই বাড়ির ছাদের তলায় একই বিছানায় রাত্রিযাপন করেছিলেন। সেদিন এই ঘটনা নিয়ে চিত্রসাংবাদিকরা বিভিন্ন ধরনের মুখরোচক সংবাদ লেখালেখি করেন। কিন্তু মতিলাল আর শোভনা সমর্থ সে ব্যাপারটাকে তেমন একটা গুরুত্ব দেননি। কারণ, মতিলাল ও শোভনা সমর্থ মনে করতেন, বিয়ের চাইতে প্রেম বড়।

কিন্তু এ সময়ের অভিনেত্রী অপু বিশ্বাস কি ভাবেন?  তা তিনিই জানেন। তবে তাঁর ভক্তরা মনে করেন, ‘তিনি হয়তো ভাবছেন, প্রেম নহে মোর মৃদু ফুলহার, দিল সে দহন জ্বালা।’

আবার কেউবা বলছেন, ‘বাচ্চা নিয়ে আছি বড় যন্ত্রণায়।’

বিখ্যাত নায়িকা -গায়িকা কানন দেবী বড় হয়ে জেনেছিলেন, তিনি যার গর্ভে জন্মলাভ করেন অর্থাৎ তাঁর মায়ের সঙ্গে রতন চন্দ্র দাসের বিয়ে হয়নি। তবুও কানন দেবী রতনচন্দ্র দাসকে পিতৃ পরিচয় দিতে ভুল করেননি। আবার তাঁর মায়ের সঙ্গে যে তাঁর বাবার বিয়ে হয়নি, এ কথাও তিনি গোপন রাখেননি।

হিন্দি সিনেমার বিখ্যাত নায়িকা গোহরবাঈ বিয়ে না করে সারাটা জীবন কাটিয়েছিলেন চিত্রপরিচালক চন্দুলাল শাহের সঙ্গে। একবার চন্দুলাল শাহ দেনাগ্রস্থ হয়ে পড়লে গোহরবাঈ তাঁকে দশ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন ঋণ শোধ করার জন্য।

নাসিম বানু
Naseem Banu: image copyright ToI

 

নাসিম বানু ছিলেন হিন্দি সিনেমার বিখ্যাত নায়িকা, তিনি তাঁর স্বামী মোহাম্মদ এহসানের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করার পেছনে অন্যতম কারণও ছিল। যা আজ ইতিহাস। তিনি পরিচালক ও প্রযোজক সোহরাব মোদির প্রেমে পড়েছিলেন। নাসিম বানু যে বাড়িটিতে সেই ১৯৫০ এর দশকে বসবাস করতেন, সেই বাড়িটি

তাঁকে দিয়েছিলেন সোহরাব মোদি।

আরও পড়ুন: সঞ্জীবনী সুধায় কঙ্কাবতীর ঘাট থেকে উত্তম কুমারের যাত্রা হল শুরু

চলচ্চিত্র জগতে যারা অভিনয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের অধিকাংশের জীবনটা সিনেমার গল্পের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। বিয়ে করেও অনেকে তা গোপন করেন, এর পেছনে অন্যতম কারণ, যদি ইমেজ কমে যায় আশঙ্কায়। তাই বিয়ের বিষয়টি গোপন রাখার মধ্যে এমন দোষের কী? এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে হাস্যকর বিষয় হলো, বাচ্চা প্রদর্শন করা।

ঢাকার সিনেমার জগতে ইদানীং যা কিছু ঘটছে, তাতে মনে হয়, শিয়াল পণ্ডিতের মতো কেউ যদি এলাকা ছাড়া হয় তা হবে আরও হাস্যকর।

তাছাড়া চলচ্চিত্র তারকাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে যাচ্ছে তাই বক্তব্য দিয়ে ইউটিউবে আর সোশ্যাল মিডিয়ায় যারা বানিয়ে বানিয়ে উদ্ভট কথাবার্তা দিয়ে ভিডিও পোস্ট করছেন, সেটাও কাম্য নয়। বানিয়ে বানিয়ে যারা অবিরত বলে যাচ্ছেন তাদেরকে আইনের আওতায় আনা উচিত।

আরও পড়ুন: ঢালিউড: সিনেমা তৈরি না বাচ্চা উৎপাদন?

লিয়াকত হোসেন খোকন: চলচ্চিত্র গবেষক ও লেখক। সিনেমা বিষয়ক অসংখ্য গ্রন্থ প্রণেতা।

Share on:

লিয়াকত হােসেন খোকন ১৯৫৩ সালের ১৪ মার্চ পিরোজপুর শহরের রায় বাহাদুর রোডে (আদর্শপাড়া) ‘স্মৃতি ভবনে’ জন্মগ্রহণ করেন । পিতা মৃত আমির হােসেন মিয়া এবং মাতা মৃত্যু আমেনা খাতুন | লেখক ১৯৭৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভের পর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার ইতি টানেন । ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত, সহধর্মিণী শওকত আরা ডলি । ১৯৯৬ সালে তার লেখা বাংলাদেশ ভ্ৰমণ পুস্তিকাটি প্রকাশিত হয় হাক্কানি পাবলিশার্স থেকে । তার দ্বিতীয় গ্ৰন্থ ৬৪ জেলা ভ্ৰমণ অনিন্দ্য প্রকাশ থেকে বের হয় ২০০৭ সালে । ২০০৮ সালে প্রকাশ হয় তাঁর তৃতীয় গ্রন্থ ভারত নেপাল ভূটান ভ্ৰমণ । ১৯৭৩ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের প্রতিটি প্রদেশ তিনি ঘুরে দেখেছেন । বাংলাদেশের সংবাদপত্রে ভ্রমণ বিষয়ক লেখা জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে লিয়াকত হোসেন খোকনের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। এছাড়া দুই বাংলার চলচ্চিত্র বিষয়ে তিনি অন্যতম সেরা লেখক।